মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য-এর বিখ্যাত কবি বিজয় গুপ্তের জন্মস্থান বরিশালের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম গৈলা। এখন থেকে ৫০০ বছর আগে কবি তাঁর কাব্যে বলেছিলেন, ‘স্থান গুণে যেই জন্মে সেই গুণময়।’ তাঁর কথাগুলো গৈলার বেলায় যেন শতভাগ সত্য। বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান গৈলা নামের সেই জনপদে ১২৫ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজি মাধ্যমে সহশিক্ষার বিদ্যাপীঠ গৈলা উচ্চবিদ্যালয়। বরিশালের শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ অশ্বিনীকুমার দত্তের সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তৎকালীন জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি আধুনিক শিক্ষা প্রসারের যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তারই ফসল গৈলা উচ্চবিদ্যালয় এবং এর আশপাশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন গ্রামের কৃতী সন্তান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট কৈলাস চন্দ্র সেন। এই মহাত্মা সরকারি উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দীর্ঘ তিন দশকের অধিক কাল অবৈতনিকভাবে পরম নিষ্ঠা ও সফলতার সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে বিদ্যালয়টিকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বিদ্যাপীঠের মর্যাদায় আসীন করেন। এই গ্রাম ও বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে অনেকেই যশস্বী হন। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ডক্টর সুরেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত, ডক্টর সুরমা দাশগুপ্ত গৈলার কৃতী সন্তান। তাঁদেরই মেয়ে বিখ্যাত লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রখ্যাত অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের থিসিস গাইড। ১৯৫৪ সালে অর্থনীতিতে অমিয় দাশগুপ্তকে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে মর্মে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এখনো আলোচনা রয়েছে। তিনিও গৈলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন।

এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত বিচারক রায়বাহাদুর বিপিন বিহারি দাশগুপ্ত। কোনো এক বিচারে প্রজা স্বার্থে তিনি তাঁর পিতাকে এক টাকা জরিমানা করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দাশের বাড়ির সন্তান ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কবি কুসুম কুমারী দেবী। তিনিও গৈলা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। জ্ঞানচর্চায় গৈলা স্কুল সেদিন যে আলোড়ন তুলেছিল, তার দু-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১৮৯৩ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই গ্রাম থেকে অন্তত ৪০ জন ছাত্রছাত্রী ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। মেয়েরাও সেদিন সমানতালে বিদ্যাচর্চার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এই স্কুলের সিঁড়ি পেরিয়ে সেই স্বর্ণযুগে এমএ, এমএসসি সমমর্যাদার পরীক্ষায় কলকাতা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন ২২ জন ছাত্রছাত্রী। এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ছিলেন ৩৩ জন এবং বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ৪৩ জন। কথিত আছে, গৈলার একটি বাড়িতে ৭০ জন বিএ পাস ছেলেমেয়ে ছিলেন। ‘স্থান গুণে যেই জন্মে, সেই গুণময়’-কথাটি তাই এমনি এমনি কবি বলেননি।

গৈলা স্কুলের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল আরও ১৭ বছর আগে ১৮৭৬ সালে মাইনর স্কুল হিসেবে গৈলার বিখ্যাত দাশের বাড়ির একটি আটচালা ঘরে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের আগে পর্যন্ত সেখানেই স্কুলটি পরিচালিত হয়। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পরবর্তীকালে স্কুলটির জন্য দাশের বাড়ির বিদ্যানুরাগীরা সুবিশাল খেলার মাঠ, দিঘিসহ বর্তমান স্থানটি দান করেন।

কালের স্রোতে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্কুলটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেলেছিল। মহান শিক্ষানুরাগী কৈলাস চন্দ্রের বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে, তাঁর সমাধি অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত। স্কুলের দিঘি হাতছাড়া। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বিষয়গুলো দেখতে পারেন।

সমস্যার বাধা ডিঙিয়ে মহান ঐতিহ্যের ধারক স্কুলটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সরকারি সহায়তায় গড়ে উঠেছে সুরম্য ভবন। দেড় হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর কলকাকলিতে মুখরিত আজ স্কুলটি। গৈলা স্কুলের বর্তমান এবং প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা বিপুল উদ্দীপনায় পালন করছেন তাঁদের প্রিয় বিদ্যালয়ের ১২৫ তম জয়ন্তী, স্মরণ করছেন সর্বস্ব ত্যাগী মহাপুরুষ কৈলাস চন্দ্রকে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটি বিচ্ছিন্ন জনপদকে এমন উচ্চ মার্গে নিতে পেরেছিলেন বলেই কৈলাস চন্দ্র সেন গৈলাবাসীর কাছে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর স্মৃতিসৌধে খচিত ‘ডেথ ডিভাইডস, মেমরি লিংগারস’ প্রবাদবাক্যটি বারবার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

অসীম দাশগুপ্ত: গৈলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews