গোপাল অধিকারী

নিউজ আপলোড : ঢাকা , শনিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২০

ঋতু বদলের ধারাবাহিকতায় বিদায় নিয়েছে শরৎকাল। তবে শরৎ আভায় ছেয়ে আছে মহাকাল। আকাশ ছুঁয়েছে যেন কাশফুল। স্থায়ী-অস্থায়ী সকল মন্ডপে আওয়াজ তুলেছে ঢাকী। ড্যাং ড্যাডাং ড্যাং ড্যাডাং কাঁইনানা কাঁইনানা, ট্যাং ট্যাটাং ট্যাং ট্যাটাং। চন্ডীপাঠ চলছে। মা আসছেন। পূজা নেবেন সবার তরে। বিভাজন রেখা সীমানা পেরিয়ে। মা যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বাঙালির ঘরে ঘরে মা আসেন বিশ্বলয়ে।

শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গোৎসব। পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন। পরদিন সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার-অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

এ বছর মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা হচ্ছে না। পূজা হচ্ছে কার্তিক মাসে। সেই হিসাবে এবার দেবী দুর্গা ‘মর্ত্যে আসছেন’ মহালয়ার ৩৫ দিন পরে।

দুর্গা নামের বুৎপত্তিগত অর্থ যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট হতে ত্রাণ করেন। শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটির একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘দুর্গা’র ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ (ু) বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ (র্) রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ (া) ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

পন্ডিতরা বলছেন, শরৎকালের প্রথম শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার দিনে দেবীঘট স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। শরতকালের এ পক্ষকে দেবীপক্ষও বলা হয়ে থাকে। শাস্ত্রে আছে, দেবীদুর্গা হিমালয়বাসিনী দক্ষরাজার কন্যা। পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষে ষষ্ঠীর দিনে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মর্ত্যলোকে মা দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। এটিই দেবীর বোধন। এরপর যথাক্রমে মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী ও সন্ধিপূজা এভাবে নবমী পার হয়ে দশমীর দিনে দেবী বিসর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও পক্ষকাল চলে বিজয়া পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ উৎসব।

দেবী দুর্গার সৃষ্টি-রহস্যসমৃদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীশ্রী চন্ডীতে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন কোন পুরুষ তোমাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহিষাসুর। একে একে বিতাড়ন করেন স্বর্গের সব দেবতার। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবতারা অবশেষে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু কী করবেন তিনি। নিজের দেয়া বর ফেরাবেন কী করে? এ অবস্থায় শিব ও অন্যান্য দেবতা সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মা যান স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের দুর্দশার কথা শুনে দেবতাদের বলেন, দেবতাদের নিজ নিজ তেজকে জাগ্রত করতে হবে। তখন দেবতাদের সমবেত তেজের মিলনে আবির্ভূত হবে এক নারী মূর্তি। সেই নারীই বিনাশ করবে মহিষাসুরকে। বিষ্ণুর থেকে সবকিছু অবগত হয়ে দেবতারা হিমালয়ের পাদদেশে পুণ্যসলিলা গঙ্গার সামনে এসে প্রার্থনা শুরু করেন। দেবতাদের সম্মিলিত তেজরাশি থেকে দশদিক আলোকিত করে আবির্ভূত হন এক নারীমূর্তি। ইনিই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত। তিনি আবির্ভূত হন দশভুজারূপে। দেবতাদের সব দুর্গতি বিনাশ করায় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী এবং অসুরদলনী নামেও পরিচিত। বৈদিক সূত্রে এ দেবীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বসন্তকালে। এ সময় দেবী দুর্গা ‘বাসন্তী’ নামে পূজিত হতেন যা এখনও প্রচলন আছে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সেদিন ‘কন্যারূপে’ বাপের বাড়ি অর্থাৎ মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দূর হবে সব পাপ। সমাজে ফিরে আসবে শান্তি। এ বছর দেবী দুর্গা আসছেন ঘোটকে। এতে রবি শস্য ভালো হবে। দেবী বিদায়ও নেবেন ঘোড়ায় চরে। এতে দূর হবে সব অসুখ বিসুখ। দেবীর যাত্রার সময় সব অসুখ বিসুখ ধূলোর সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন।

মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পরিবারসমন্বিতা মূর্তির প্রচলন হয় ষোড়শ শতাব্দির প্রথম পাদে। পরিবারসমন্বিতা এই মূর্তিকাঠামোর মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তার উপরিভাগে ধ্যানমগ্ন মহাদেব। মহিষাসুরমর্দিনীর ঠিক ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিক। পরিবারসমন্বিতা এ রূপে দুর্গাপূজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরে। কংসনারায়ণের পূজার পরপরই আড়ম্বরপূর্ণ দুর্গাপূজার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা। নতুন আঙ্গিকের এই পূজার শাস্ত্রীয় ও সামাজিক আয়োজন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দুর্গাপূজা পরিনত হয় জমিদারদের উৎসবে। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর দুর্গোৎসবে জমিদারদের অংশগ্রহণের হার কমে আসে স্বাভাবিকভাবেই। নব্য ধণিকশ্রেণীর উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গোৎসব আয়োজকগোষ্ঠীতে যুক্ত হয় অনেক নতুন মুখ। তবে প্রতিটি দুর্গোৎসবই তখন আয়োজিত হত সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে। আনুমানিক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে একটি ঘটনা ঘটে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়। গুপ্তিপাড়ার একটি ধনী পরিবারের আকস্মিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় বাড়িটির বাৎসরিক পূজার আয়োজন। গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধুস্থানীয় যুবক তখন এগিয়ে আসে সামনে। এই ১২ জন ‘ইয়ার’ বা বন্ধু সংঘবদ্ধভাবে গ্রহণ করে পূজাটির দায়িত্ব। গুপ্তিপাড়ার এই পূজাটি মানুষের কাছে পরিচিত হয় ‘বারোইয়ারি’ বা বারোয়ারি পূজা নামে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায় দুর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ল ব্যাপকহারে। তারপর থেকেই বিভিন্ন বারোয়ারী মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবটি।

পূজা মানেই আনন্দ, পূজা মানেই উৎসব। ধর্ম আলাদা হলেও উৎসব আর আনন্দ সবার। ঈদের সময় ধর্মভেদে সবাই যেমন আনন্দ উপভোগ করে, ঠিক তেমনি পূজার ক্ষেত্রেও নিজ নিজ ধর্মকে পাশে রেখে একসঙ্গে সময় কাটায়, আনন্দের পসরা সাজায় মানুষ। আর এটি যেমন বাংলাদেশের জন্য সত্য, তেমনি সত্য পৃথিবীর অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেও।

প্রচলন অনুযায়ী পূজা হলেও এবছর পূজাটি হবে ব্যতিক্রম। আমার কাছে এবছরের পূজাটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করি। কথায় বলে, হিন্দুধর্ম চলে আচারে। করোনার কারণে বারবার হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এগুলো হবে উপাসনার নিয়মানুবর্তিতা। তবে এবার উৎসব হবে আনন্দ হবে না এমনটাই অভিমত অনেকের। স্মরণকালের প্রথম এমন পূজায় হয়ত আমরা অনেকেই হতবাক ও বিচলিত। এবারের পূজা উদযাপন পরিষদের ২৬ দফার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, ভক্ত-পূজারি ও দর্শনার্থীদের জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রেখে, মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, নারী-পুরুষের যাতায়াতের আলাদা ব্যবস্থা করে, বেশি সংখ্যক নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক নারী-পুরুষ রেখে, ভক্তিমূলক সংগীত ছাড়া অন্য কোন গান না বাজিয়ে, সব ধরনের আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা, মেলা, আরতি প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিহার করে, প্রতিমা নিরঞ্জনে শোভাযাত্রা পরিহার করে ইত্যাদি ইত্যাদি। বছরের একটি বার তবুও এমন বাধা-নিষেধে হয়ত অনেকে বিচলিত। কিন্তু ভাবতে হবে প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। একটু সচেতনতা বাঁচিয়ে দিতে পারে বড় ভয়াবহতা। আমরা দেখেছি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা কীভাবে পালিত হয়েছে? তাই আনন্দ কম হোক, তবুও দেশ ও বিশ্ব থেকে করোনা নামক অশুভ বিদায় হোক। মায়ের মহিমান্বিতরূপে জগতে আসুক শান্তির ছায়া। প্রাণে ফিরে পাক নির্মল আনন্দ। নির্মল পৃথিবী ও বিশুদ্ধ বাতাসের সঙ্গে সবার মাঝে আবারও পূর্বের ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হোক। সবাই মিলে বাজাই প্রাণের সানাই, শারদীয় শুভেচ্ছা সবাইকে জানাই।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

gopalodikari1213@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews