চীন ও পাকিস্তানের সাথে বিস্তৃত ইস্যুতে সহযোগিতার একটি ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফর্ম গঠনের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে চায়। আর এ কারণে সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত ঢাকা, বেইথজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এমনকি এই বৈঠককে ‘আনুষ্ঠানিক’ বলতেও নারাজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত ১৯ জুন কুনমিংয়ে ষষ্ঠ চীন-দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সাইডলাইনে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডং, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিক এবং পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী উপস্থিতিতে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ আলোচনার প্রথম পর্বে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। এই আলোচনার পর কোনো যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়নি। চীন ও পাকিস্তান ২০ জুন পৃথকভাবে বিবৃতি দিয়েছে, যা দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ তারও একদিন পর অর্থাৎ ২১ জুন রাত সাড়ে ১০টায় একটি বিবৃতি দেয়। চীন ও পাকিস্তানের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে হওয়া সমঝোতার ভিত্তিতে তিন পক্ষ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করবে। কিন্তু বাংলাদেশের দেয়া বিবৃতিতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এটিকে ‘অনানুষ্ঠানিক বৈঠক’ হিসাবে উল্লেখ করেছে। তবে তিনটি বিবৃতিতে অন্যান্য বিষয়বস্তুতে কমবেশি সামঞ্জস্য ছিল।

সংশ্লিষ্টদের মতে, চীন ও পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফর্ম গঠনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক স্পর্শকাতরতা রয়েছে। কেননা এই তিনটি দেশের সাথেই ভারতের সীমান্ত রয়েছে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী এই তিন দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। কাশ্মিরের পেহেলগাঁওয়ে বন্দুকধারীদের গুলিবর্ষণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক পশলা যুদ্ধ হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তা আপাতত বন্ধ রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং দলটির প্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে ভারত সরকার ও সে দেশের গণমাধ্যম সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপ্রমাণিত অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আবার অবৈধ বাংলাদেশীর ধোঁয়া তুলে সীমান্তে ধারাবাহিকভাবে পুশইন চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষি মানুষজনও রয়েছে। আর ভাষার ওপর নির্ভর করে মানুষের জাতীয়তা নির্ধারণ করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এছাড়া চীনের সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্তবিরোধ রয়েছে, যা সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন রয়েছে- এ কথা স্বীকার করে নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার এই মুহূর্তে এমন কোনো কিছুতে জড়াতে চাইছে না, যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। এই কারণেই চীন ও পাকিস্তানের সাথে বিস্তৃত ইস্যুতে সহযোগিতার ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফর্ম গঠনের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ পরবর্র্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে।

কুনমিং বৈঠকের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিন পক্ষ সুপ্রতিবেশীসুলভ, সমতা ও পারস্পরিক বিশ্বাস, উন্মুক্ততা ও অন্তর্ভুক্তি, উন্নয়ন এবং সবার জন্য লাভজনক সহযোগিতার নীতির ওপর ভিত্তি করে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। এই ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার লক্ষ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। সব পক্ষ শিল্প, বাণিজ্য, মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স, জলসম্পদ, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, মানবসম্পদ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং যুবসমাজ সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সম্মত হয়েছে। বৈঠকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, চীন-বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহযোগিতার ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিকতা এবং উন্মুক্ত আঞ্চলিকতার নীতি মেনে চলবে। কোনো তৃতীয় পক্ষ এর লক্ষ্যবস্তু নয়। বৈঠকে হওয়া সমঝোতার ভিত্তিতে তিন পক্ষ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করবে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, আমনা বালুচ তার বক্তব্যে চীন এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সম্পৃক্ততা আরো গভীর করার জন্য পাকিস্তানের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন। তিনি চীন ও বাংলাদেশ উভয়ের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। সেই সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, কৃষি, ডিজিটাল অর্থনীতি, পরিবেশ সুরক্ষা, সমুদ্র বিজ্ঞান, সবুজ অবকাঠামো, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুই দেশের সাথে কাজ করার জন্য পাকিস্তানের আগ্রহের কথা জানান।

অন্যদিকে অনেক দেরীতে দেয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কুনমিংয়ে ষষ্ঠ চীন-দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা বৈঠকের সাইডলাইনে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে তিনপক্ষ পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং এই অঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে মতবিনিময় করেছে। তারা অবকাঠামো, কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, সমুদ্র বিষয়ক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়সহ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার জন্য বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। তিনপক্ষ উন্মুক্ততা, অন্তর্ভুক্তি, সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ এবং পরস্পরের জন্য লাভজনক পরিস্থিতির নীতিতে সহযোগিতা গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব উল্লেখ করেছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশীদার হিসেবে তিনটি দেশ জাতিসঙ্ঘের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার (এসডিজি) সাথে নিজ নিজ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার জন্য একসাথে কাজ করতে পারে। রুহুল আলম সিদ্দিক তিনটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের জনগণের প্রকৃত সুবিধা প্রদান এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews