বিশ্ব অর্থনীতিতে যেন হঠাৎই ঝড় উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক পাল্টা শুল্ক আরোপ করে কাঁপিয়ে দিয়েছে বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামো। শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়—উন্নত অর্থনীতিগুলোও পড়েছে চাপে, জব্দ হয়েছে বহুসময়ের স্থিতিশীল হিসাব-নিকাশ।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান আর বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন আগ্রাসী অবস্থানে, তখন রপ্তানিনির্ভর বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে সরাসরি চাপ। কারণ, আমাদের বৈদেশিক আয়ের বড় একটি অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রমুখী রপ্তানি থেকে।

এই চাপে মাথা নত না করে, বাংলাদেশ বরং পথ খুঁজছে কৌশলগতভাবে। মার্কিন প্রশাসনের মন জয় করতে শুরু হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ—যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত শুধু একটি বাণিজ্যিক ক্রয়াদেশ নয়, বরং এতে লুকিয়ে আছে কূটনৈতিক বার্তা, বন্ধুত্বের হাতছানি—আর সম্ভবত শুল্ক কমানোর এক অলিখিত দরজার তালা খোলার চাবিও।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রাজনীতির খেলোয়াড় হিসেবে নিঃসন্দেহে একেবারে ছোট। বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো যখন নিজেদের অবস্থান রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের মতো দেশ আত্মরক্ষায় বিভিন্ন কৌশলে অবলম্বন করতে বাধ্য। বোয়িং বিমান কেনা ঠিক এমনই একটি পদক্ষেপ। প্রথমত, এটি অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হলেও এর কূটনৈতিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না।

বোয়িং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় একটি কোম্পানি, যার স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বাণিজ্য নীতি। তাই বোয়িংয়ের ব্যবসায়িক সাফল্য অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কূটনৈতিক আচরণে প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টে (এনডিএ) স্বাক্ষর করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, বিষয়টি শুধু বাণিজ্যিক নয়, রয়েছে রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিকও। বোয়িং বিমান কেনার পাশাপাশি গম, সয়াবিন, তুলা আমদানির উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার অংশ। এমন একটি সময়ে, যখন পাল্টা শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি হুমকির মুখে, তখন আমদানির মাধ্যমে সম্পর্ক ‘উষ্ণ’ করার এই চেষ্টা বাস্তববাদী হলেও প্রশ্ন থেকেই যায়—এতে আদৌ কোনো লাভ হবে?

যুক্তরাষ্ট্র এখন যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে, তা মূলত তাদের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রয়াস। দেশটির সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সে দিক থেকে বাংলাদেশ তাদের মূল সমস্যা না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ‘সাইড এফেক্ট’ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সবচেয়ে বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রেই। এই খাতে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বোয়িং কেনা, খাদ্যশস্য আমদানি, এমনকি উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় অংশগ্রহণ—সবই একটি নরম কূটনৈতিক চাপ লাঘবের কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যদি হয় একতরফাভাবে ঘাটতি কমানো, তাহলে বাংলাদেশের এসব ‘গুড গেসচার’ কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকাই স্বাভাবিক।

আমাদের বোঝা উচিত, যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি শক্তিধর রাষ্ট্র নয়, এটি একটি সুগঠিত নীতিনির্ধারক ব্যবস্থাও। তাদের বাণিজ্যনীতি একদিনে বদলায় না, আর তা বদলালেও তা হয় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ মাথায় রেখে। ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) অফিস কিংবা অন্যান্য সরকারি সংস্থা কোনো নির্দিষ্ট দেশের ‘সহানুভূতিশীল বন্ধু’ নয়—তারা কেবল আমেরিকার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় অটল। ফলে, বোয়িং কেনার মতো বড় ক্রয়াদেশ কিংবা খাদ্যশস্য আমদানির মতো সিদ্ধান্ত হয়তো আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা ইতিবাচক করতে পারে, কিন্তু সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র শুল্কে ছাড় দেবে—এমন প্রত্যাশা করা বাস্তবতা বিবর্জিত হতে পারে।

এখানে আরও একটি বাস্তবতা মাথায় রাখা জরুরি: যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক অনেক ক্ষেত্রেই আসলে ‘ঝিকে মেরে বউকে বোঝানোর’ কৌশল। অর্থাৎ, তাদের মূল টার্গেট অনেক সময় চীন, কিন্তু ‘মুক্ত বাণিজ্যের নামে সুবিধা পাওয়া’ অন্যান্য দেশকে শাস্তি দিয়ে চীনকে বার্তা দেওয়াই হয় আসল লক্ষ্য। বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতি তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই বার্তার বাহক হয়ে পড়ে। এই মনোভাবের ফলে আমেরিকা এমন দেশগুলোকে শুল্ক দিয়ে চাপে ফেলে, যেগুলোর আসলে বড় কোনো ভূরাজনৈতিক ভূমিকা নেই। অথচ এতে ক্ষতিটা হয় ঠিক সেই দেশগুলোর, যারা রপ্তানির মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখার চেষ্টা করছে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি দিক অনুধাবন করা জরুরি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার বিশ্বজুড়ে থাকা অর্থনৈতিক অংশীদারদের ওপর বাড়তি চাপ দিয়ে তাদের চীনমুখিতা কমাতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অবকাঠামোগত ও কৌশলগত সম্পর্ক বেড়েছে, বিশেষ করে বন্দর, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে। এমতাবস্থায় বোয়িংয়ের ক্রয়াদেশ, খাদ্যপণ্য আমদানি, এমনকি সয়াবিন ও তুলা কেনার উদ্যোগও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একধরনের ‘নৈতিক আনুগত্যের ইঙ্গিত’ হতে পারে। অর্থাৎ, এটি শুধু একটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নয়, বরং চীন থেকে কিছুটা কৌশলগত দূরত্ব তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতায় প্রবেশের একটি রাজনৈতিক অঙ্গভঙ্গিও।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমনই—এখানে প্রতীকী কার্যক্রমেরও অর্থ হয়, প্রভাব পড়ে। বোয়িং কেনা কিংবা গমের মতো মৌলিক খাদ্য আমদানি আসলে এক ধরনের বার্তা: ‘আমরা কেবল রপ্তানিকারক নই, আমদানিতেও মার্কিন বাজারকে প্রাধান্য দিচ্ছি।’ যদিও এসব পদক্ষেপে অর্থনৈতিকভাবে বড় কোনও লাভ হবে এমন নিশ্চয়তা নেই, তবে রাজনৈতিক পয়েন্ট অর্জনের চেষ্টা হিসেবে এগুলোকে একেবারে খাটো করে দেখা যাবে না।

তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। বোয়িং কেনা বা খাদ্যশস্য আমদানি সহায়ক হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মন জয়ের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। এজন্য চাই গভীর কূটনৈতিক পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারাবাহিক চর্চা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সূক্ষ্ম বোঝাপড়া। একইসঙ্গে, দেশের রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্য (ডাইভারসিফিকেশন), নিজস্ব উৎপাদন খাতের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানো, এবং নন-ট্যারিফ ফ্যাসিলিটি অর্জনে জোরালো প্রচেষ্টা চালানো এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ যে এসব দিক ভাবছে এবং আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে, সেটিই ইতিবাচক দিক। তবে, এই সমস্ত প্রতীকী কৌশল বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে—তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে সময়ের আদালতের রায়ের জন্য। এই মুহূর্তে প্রশ্নটা তাই খুব স্বাভাবিক—আমরা কৌশলের পথে হাঁটছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর গন্তব্য কী? লাভ না লোকসান—উত্তরটা সময়ই দেবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews