প্রাচীনকাল থেকেই পানিকে মানুষ পবিত্রতার প্রতীক ভেবেছে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতিটি স্তম্ভে পানির উপস্থিতি এক অনিবার্য পরিপূরক। যে পানি নবজাতকের মুখ ধুয়ে দেয়, যা দিয়ে মৃতদেহ পরিশুদ্ধ করা হয়, ধর্মীয় আচার সম্পন্ন হয়, চাষাবাদ হয়, জীবন চলে- সেই পানির চার পাশেই আজ অবরুদ্ধ পাপের এক নিঃশব্দ উপাখ্যান।
সব ধর্মে পানিকে দেখা হয় পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। ইসলাম ধর্মে পানি হচ্ছে তাহারাত বা পবিত্রতার প্রধান মাধ্যম। আর তাহারাত ইবাদতের শর্ত। ফরজ গোসল পবিত্র পানির কাছে আপনাকে নিয়ে যাবেই। অজুর জন্য প্রতিদিন বারবার আপনাকে যেতে হবে পানির সমীপে। হিন্দুরা গঙ্গার জল দিয়ে পিতৃতর্পণ ও শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন; খ্রিষ্টধর্মে ‘holy water’ দ্বারা পাপমোচন হয়; প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মেও জলপূজা আত্মশুদ্ধির একটি অংশ। বৈশ্বধর্মের প্রতিটি দৃষ্টিকোণে পানি কেবল বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম নয়; বরং আত্মিক ও সামাজিক পবিত্রতার এক নিঃশব্দ ভাষ্য।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই ধার্মিকতা কেবল গ্রন্থে ও আচারে থাকছে, নাকি এর বাস্তব রূপায়ণ ঘটছে সমাজে? লোকেরা যেভাবে নদীকে পূজার উপাদানে রূপ দিচ্ছে, একইভাবে তো তার মধ্যে ঢেলে দিচ্ছে বিষ; শিল্পবর্জ্য, বর্জিত রাজনীতি ও মুনাফার বীজ। একদিকে গঙ্গাজল বা পদ্মার পাড়ে পূজা, অন্যদিকে নদী ভরাট করে বাণিজ্যিক প্লট নির্মাণ; একদিকে ‘জলই জীবন’ লেখা স্লোগান, অন্যদিকে জলাশয়কে বর্জ্যভাণ্ডারে রূপান্তর- এই দ্বিচারিতার মধ্যে ধর্ম কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে?
পানির সাথে যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা এখন একটি আনুষ্ঠানিকতা ও প্রতীকী রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। ‘পবিত্র জল’ এখন রাজনৈতিক মঞ্চের আবহবাণী কিন্তু জনজীবনের কোলাহলে তা এক নির্মম তামাশা।
ফলে এ প্রশ্ন ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে যে, পানি ও নৈতিকতা জীবনের স্বচ্ছ প্রতিফলন নাকি চোরাবালি?
মানবসভ্যতার বিবর্তনে পানি বরাবরই ন্যায়ের মূল স্তম্ভে অবস্থিত। সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্পদের পুনর্বণ্টন, নৈতিক বোধ- সব কিছুর কেন্দ্রে ছিল এই মৌলিক উৎস। পানি যেমন শারীরিক প্রয়োজন, তেমনি তা একটি নৈতিক অধিকার। কিন্তু আমাদের সমসাময়িক সমাজে পানির প্রাপ্যতা এখনো শ্রেণীভেদে নির্ধারিত। একজন দরিদ্র মানুষকে হয়তো দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে এক কলস পানি পেতে হয়, অথচ শহরের অভিজাত এলাকায় সুইচ টিপলেই আসে বিশুদ্ধ ফিল্টার পানি।
পানির এই বণ্টনে তৈরি হয়েছে নৈতিক বৈষম্য। পানি এখন কেবল মৌলিক অধিকার নয়; বরং এক প্রকার নির্বাচনযোগ্য সুবিধা। ফলে জন্ম নিচ্ছে গভীর অসাম্য, যার শিকড়ে রয়েছে বেসরকারীকরণ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে- পানি কি এখনো একটি নিরপেক্ষ উপাদান? নাকি তা হয়ে উঠেছে এক ‘নৈতিক চোরাবালি’, যেখানে স্বচ্ছতা মুখে বলা হয় কিন্তু ভেতরে জমে থাকে অবিচার ও পাপ?
পানির অঙ্গনে মানুষ গড়েছে অপরাধবলয় বা ক্ষমতার জলদস্যুতা। বাংলাদেশের শহর, উপশহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে জলাশয়, খাল, পুকুর, নদী দখল নিত্যনৈমিত্তিক সংবাদ। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জলাধার দখল করে তৈরি হয়ে যায় বাসাবাড়ি কিংবা শপিংমল। এমনকি পরিবেশ অধিদফতরের রিপোর্ট বলছে, ঢাকার অধিকাংশ খাল দখল হয়ে গেছে ‘অপরাধের বৈধ ছায়ায়’।
এই দখল শুধুই জায়গা নয়; বরং একটি সমাজের আদর্শিক ও নৈতিক জলদস্যুতার প্রতীক। এই অপরাধ আর কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং তা সভ্যতাগত পাপ। যেখানেই পানি আছে, সেখানেই লুকিয়ে থাকে এক শোষণের ইতিহাস; একটি মিউনিসিপ্যালিটির পানির লাইনে ঘুষ, এক নেতার দখলে থাকা খাল, এক বেসরকারি কোম্পানির বোতলজাতকরণ।
পাপের এই জোয়ারে পানি আর কি পবিত্র থাকছে?
‘পানি ও পাপ’-এই দুইয়ের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিবিড় কিন্তু অস্বীকারযোগ্য নয়। আমরা দেখছি, কিভাবে ধর্ম, নৈতিকতা ও অপরাধবোধের ভেতরে পানি ঢুকে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে লিখেছিলাম-
‘মরা নদীর পাশে হাঁটলে আমার মনে হয়, আমরা তার পাড়ে নয়, আমাদের সম্মিলিত পাপের প্রায়শ্চিত্তের সীমায় দাঁড়িয়ে আছি।’
এ যেন এক প্রতীকী সত্য। কারণ আজকের পানি আমাদের পাপের প্রতিবিম্ব- যা একদিন ছিল পবিত্রতার প্রতীক।
আমরা যেন লক্ষই করছি না, কিভাবে পানির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল ‘জলবিচার’, কিভাবে তা রূপান্তরিত হয়েছে বৈষম্যের অস্ত্রে, কিভাবে নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি ও ভবিষ্যতের সঙ্কটে পরিণত হয়েছে এই এক ফোঁটা পানি!
মরুভূমিতে পরিণত জনপদের কৃষক জানে নদীর মৃত্যু তার মৃত্যুকে কিভাবে দরোজায় নিয়ে এসেছে। সেই এলাকার প্রাণ ও প্রকৃতি জানে- যার পানি লুণ্ঠিত, তার জন্য আইন ইতোমধ্যে মরে গেছে। যার নদী নেই, তার ভবিষ্যৎও নেই।
পানি তো পরম করুণাময়ের প্রাকৃতিক দান। তা এখন এক জটিল রাজনৈতিক মালিকানা ও বণ্টন সমস্যার বিষয়। একদিকে পানির ঘাটতিতে কৃষক আত্মহত্যা করছে, অন্যদিকে মেগা প্রকল্পের জন্য নদীর গতিপথ বদলে দেয়া হচ্ছে। একদিকে একটি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে লবণাক্ত পানির ব্যবহারে, অন্যদিকে শহরে বোতলজাত পানির বিপণন হচ্ছে বিলাসপণ্যের মতো।
এই বৈষম্য, এই বিভাজন আর কেবল সামাজিক বা অর্থনৈতিক নয়; এটি একটি নৈতিক ও আইনি প্রশ্নও বটে। ‘জলবিচার’ এখন অবিশ্বাস, অপরাধ এবং বৈষম্যের এক সঙ্ঘাতময় ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সেদিকে দৃষ্টি দিলে সঙ্গতই প্রশ্ন ওঠে যে, জলবিচার : মৌলিক অধিকার না দুর্নীতির বাজার?
পানির প্রাপ্যতা ও ব্যবহার কিভাবে নির্ধারিত হবে, তা শুধু প্রকৃতির বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্র, আইন ও প্রশাসনের সরাসরি দায়িত্ব। সংবিধান ও মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, নিরাপদ পানি নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পানি এখন এক বাজারচালিত পণ্য- বিতরণে প্রভাব খাটায় রাজনৈতিক শক্তি, আর ব্যবহারের ফয়সালা হয় অর্থনৈতিক শ্রেণী অনুযায়ী।
এমনকি যখন পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে- যেমন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে, খাল খননের নামে অর্থ আত্মসাৎ, বা পানির পাইপলাইন বসানোর নামে কমিশন বাণিজ্য- তখন বোঝা যায়, ‘জলবিচার’ একটি শুদ্ধ নীতির বিষয় নয়; বরং ক্ষমতার খেলার একটি নিঃশব্দ মঞ্চ।
বৈষম্যের ভূগোলটা কত বড়, তা স্পষ্ট হয়, যখন দেখবেন খরার মাঝে মেগা প্রকল্প। বাংলাদেশে পানির বৈষম্য কেবল ব্যক্তি বা শ্রেণীগত নয়; বরং ভৌগোলিক বৈষম্যেরও প্রতিফলন। উত্তরাঞ্চলে বর্ষার পর শুকিয়ে যায় নদী, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ এই পানি সঙ্কটের বিপরীতে বরাদ্দ হয় সিটি প্রকল্প, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ও পর্যটন উন্নয়ন। পানি সঙ্কটে কৃষক মরছে, কিন্তু নগরে ‘ওয়াটার ফাউন্টেন’ বসছে বিনোদনের জন্য।
এই বৈষম্য একটি নতুন সামাজিক স্তর সৃষ্টি করছে- জলদরিদ্র শ্রেণী, যারা প্রতিদিনের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে পানি খুঁজে। এই শ্রেণী তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক উদাসীনতা, দুর্বল নীতিমালা ও পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন কৌশলের ফলস্বরূপ।
এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের নয়, অন্যত্রও একই বাস্তবতা।
ফলে পানি সঙ্কটের আয়নায় ভবিষ্যৎকে রাখলে দেখি, দুর্ভিক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সভ্যতা।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিদরা বারবার সতর্ক করছেন, পানি হবে পরবর্তী শতকের যুদ্ধ ও সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু। দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবাহ নির্ভর করে পার্বত্যাঞ্চল থেকে নেমে আসা নদীর ওপর। জলাধার নিয়ন্ত্রণ, হিমবাহ গলন, চুক্তিভিত্তিক পানি বিতরণ- সব কিছু এখন পরিণত হয়েছে ভূরাজনীতির জটিল চাল ও চক্রে।
বাংলাদেশ এই সঙ্কটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, সুরমা ও কুশিয়ারা- সব নদীরই অববাহিকা ও প্রবাহধারা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাতে। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ শুধু নিজেদের নীতির ওপর নয়; বরং আন্তর্জাতিক পানিনীতির ওপরও নির্ভরশীল। প্রশ্ন হলো- আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত?
পানি সঙ্কট শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি খাদ্য নিরাপত্তা, গণস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যদি এখনই জলবিচার নিশ্চিত না হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু নদীশূন্য নয়, আদর্শশূন্য এক রাষ্ট্রে জন্মাবে।
এই পরিস্থিতিতে সম্মিলিত দায় আমাদের মাথার উপর। কারণ, পাপ কেবল দূষণে নয়, নীরবতাতেও। এই নীরবতা ভাঙতে হবে। পানি নিয়ে ভাবতে হবে নৈতিকতা, আইন, পরিবেশ ও রাজনীতির সমন্বয়ে। তাহলেই ‘পানি ও পাপ’-এই সঙ্কেত একদিন রূপান্তরিত হবে ‘পানি ও প্রাপ্তি’তে। মনে রাখতে হবে, পানিতত্ত্ব সত্তাগতভাবে ন্যায়ের বাহক। সে ন্যায়ের প্রতিরূপ। ‘নদী শুধু পানি নয়, ইতিহাসের এক চলমান ভাষ্য। যার ধারা বিচ্যুত, তার বিচারও অনুপস্থিত।’
পানির প্রশ্নটি অতএব নিছক কোনো প্রকৌশল সমস্যা নয়। এটি হয়ে উঠেছে নৈতিক সঙ্কট, নীতিগত ব্যর্থতা এবং রাষ্ট্রীয় নীরবতার এক প্রতীক।
‘পানি ও পাপ’ শিরোনাম দেখাতে চায় জলবিচার কিভাবে মৌলিক অধিকার থেকে পণ্যতান্ত্রিক শৃঙ্খলে আটকে পড়েছে; কিভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন ব্যবস্থা জন্ম দিচ্ছে এক জলদরিদ্র শ্রেণীর। যাকে আমরা স্পর্শ করতে চেয়েছি।
এখন আমাদের খোঁজা উচিত প্রতিকার, প্রতিরোধ ও পুনর্নির্মাণের পথ। এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির সওয়াল জরুরি। কারণ এটি স্পষ্ট হতে হবে যে, নদী : প্রাণরেখা না পরিত্যক্ত ভূখণ্ড?
বাংলাদেশ একসময় নদীমাতৃক দেশ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ বহু নদী মৃতপ্রায়। দখল, ভরাট, দূষণ এবং ভুল নদীশাসনের ফলে একদিকে হ্রাস পাচ্ছে পানির প্রবাহ, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ভাঙন ও খরার প্রকোপ। এই মৃত্যু শুধু নদীর নয়, সভ্যচিন্তার মৃত্যুও বটে।
নদীর গায়ে পিচঢালা রাস্তা, খালের ওপর মার্কেট, বাঁধের নামে অবরুদ্ধ স্রোত- এসব প্রকল্প যন্ত্রচালিত উন্নয়নের ছদ্মবেশে প্রকৃতির ওপর সহিংসতা। এই সহিংসতা আমাদের রাজনীতি, নীতিনির্ধারণ, এমনকি শিক্ষার দর্শনকেও বিপন্ন করে তুলছে।
এখন প্রশ্ন হলো- নদী কাকে বলে? সে কেবল জলপ্রবাহ? না কি ইতিহাস, পরিচয়, সভ্যতা ও প্রাণের এক অখণ্ড ধারাবাহিকতা?
যদি দ্বিতীয়টি সত্য হয়, তাহলে নদী-রক্ষা কেবল পরিবেশবাদী নৈতিকতা নয়- এটি হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের এক সাংবিধানিক দায়িত্ব। ফলে আমাদের কাছে পানিতত্ত্ব হচ্ছে পুনর্নীতিকরণ ও বিকল্প দর্শন। যা নির্মাণের দায়িত্ব আমাদেরই।
আজ প্রয়োজন একটি নতুন পানিতত্ত্ব (hydro-ethics)-যেখানে নদীকে শুধু প্রযুক্তির বস্তু নয়, জীবন্ত সমাজচেতনার অংশ হিসেবে দেখা হবে। এই দর্শনে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে চারটি বিষয়-
১. পানি-অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে সংবিধানে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়ন।
২. নদী ও জলাভূমিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া (যেমন- ইকুয়েডর ও ভারতের কিছু রাজ্যে হয়েছে)
৩. পানি ব্যবস্থাপনায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৪. উন্নয়ন নীতিতে নদী-সম্পর্কিত পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতা।
এই দর্শন মানে শুধু পলিসি পরিবর্তন নয়, চেতনার বিপ্লব। এখানে নদী হয়ে ওঠে রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রস্থল, জনসাধারণের সহচর ও সংস্কৃতির আয়না।
একটি নতুন জল-সমাজ নির্মাণে তরুণদের অংশগ্রহণ অনিবার্য। স্কুল-কলেজ থেকে নদী সংরক্ষণ ও পানি ব্যবস্থাপনার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পানির গুরুত্ব বয়ান এবং অপচয় বা দূষণকে নিন্দা করা এবং এর ক্ষতিকে উপস্থাপন করা যায়। ইসলামে বলা হয়েছে- ‘আমি পানির মাধ্যমে প্রত্যেক জীবিত বস্তু সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া-৩০) এই আয়াত কেবল সৃষ্টি-তত্ত্ব নয়; বরং এক নৈতিক আহ্বান- পানি হলো জীবন এবং তার সংরক্ষণ হলো ঈমানের অংশ।
প্রতিটি ধর্মেই পানির পবিত্রতা, তার ন্যায্য বণ্টন এবং অপচয়বিরোধিতা রয়েছে। এসব নৈতিক শক্তিকে একত্রিত করে গড়ে তোলা যেতে পারে বহুধর্মীয় পানিনীতি জোট। পানিনীতির কার্যকারিতার জন্য রাষ্ট্র ও জনসচেতনতাকে এক অভিন্ন প্রতিজ্ঞায় দাঁড়াতে হবে।
এখন সময় হয়েছে- রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ, আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও পরিবেশকর্মীদের নিয়ে একটি জাতীয় পানিনীতি ও ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়নের। প্রয়োজন পানিনীতি সংলাপ ও সম্মেলন। যা কেবল বাজেট বা প্রকল্পভিত্তিক আলোচনার জায়গা হবে না; বরং এটি হবে নীতিগত পুনর্গঠনের জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। একই সাথে গঠন করতে হবে পানি-অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। নদী-নাগরিক চুক্তির রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পানিসম্পদে স্বশাসনভিত্তিক স্থানীয় সরকার কাঠামো গঠনও দরকার। নদী আগ্রাসন প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্য, সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আইনি, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যকর ভূমিকা।
এসব আইনি ও সামাজিক পদক্ষেপ পানিবিষয়ক আমাদের দায় ও প্রতিজ্ঞাকে সমন্বিত করবে এবং পানির স্বাভাবিকতাবিরোধী বৈরিতার প্রতিকারকে দৃশ্যমান করবে। আমাদের নদ-নদীকে বাক-মুখর করবে আবারো। কারণ যাদের নদী কথা বলে, সেই জাতি বাঁচে। আজ যদি আমরা শুনতে না পাই নদীর কান্না, কাল সে কথা বলবে ধ্বংসের ভাষায়। যদি আমরা এখনো নদী ও পানিকে আদর্শচ্যুত রাখি, তবে শুধু ফসল নয়, সমাজের বিবেকও শুকিয়ে যাবে।
পানি নিয়ে যে নীরবতা তৈরি হয়েছে তা ভাঙতে হবে। সেই সাথে গড়তে হবে এমন এক ‘জলসভ্যতা’, যেখানে নদীর প্রতিটি মোড় রাষ্ট্রচিন্তার অংশ হবে এবং প্রতিটি নাগরিক বুঝবে- পানি শুধু বেঁচে থাকার উপায় নয়; বরং ন্যায়ের পরীক্ষাও।
লেখক : কবি ও সাহিত্যক