আজ এই লেখাটি নাও প্রকাশিত হতে পারতো, এমনও হতে পারতো আজকে আমাদেরকে পাকিস্তানের বন্দনায় লিখতে হতো কোনো কবিতা কিংবা গল্প। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্কে স্মরণ করতে হতো আজ আমাদের কিংবা সেনা শাসক আইয়ুব খান অথবা ইয়াহিয়া খানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হতো। কিন্তু আমাদের তা করতে হয়নি, আজকে আমরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাত্রিকে স্মরণে রেখে আন্তর্জাতিকভাবে গণ্যহত্যা দিবস পালনের জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, একটি জাতির জন্মক্ষণকে স্মরণ করছি জাতীয় মর্যাদায়।

বাঙালি হিসেবে হাজার বছরের শাসন-শোষণ-বঞ্চনার যে ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত আছি তা আসলে পাকিস্তান মাত্র ২৫ বছরের অত্যাচারের কারণে বাকি ৯৭৫ বছরকে হার মানিয়েছিল। ফলে বাঙালি-হৃদয়ে পরাজয় আর অপ্রাপ্তির গ্লাণি এমন এক বিস্ফোরণের জন্ম দিয়েছিল যে, গোপালগঞ্জের এক অখ্যাত গ্রামের অখ্যাত বামা-মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া শেখ মুজিবকে বাঙালির মুক্তিসনদ লিখতে বাধ্য করেছিল বাঙালি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের একমবেদ্বিতীয় নেতা। যিনি পাকিস্তানের ভেতরে বসেই পাকিস্তানীদের পরাজিত করেছেন শুধুমাত্র নেতৃত্বগুণ আর দূরদর্শিতা দিয়ে, বাঙালিকে নিয়ে গিয়েছেন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কাছে, যেখানে দাঁড়িয়ে বাঙালি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।

সকল নিয়মতান্ত্রিক পথ যখন ব্যর্থ হয়েছে তখনই কেবল এই সশস্ত্র পথকে বঙ্গবন্ধু বেছে নিয়েছিলেন, আজকের আধুনিক বিশ্বেও এরকম গণতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জনের নজির খুব কমই রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, পাকিস্তানের এই ভয়ঙ্কর অপমান, নিগ্রহ আর অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করেছেন যে মহান মানুষটি সেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতে বাঙালি এখনও গড়িমসি করে, এখনও এ নিয়ে চলে তুমুল রাজনীতি- এটাই আসলে গত ৪৮ বছর ধরে আমাদের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণভাবে উদযাপনের পথে মূলতঃ প্রথম ও প্রাথমিক বাধা। আর এই অপরাজনীতির শুরু ও শেষ নিয়ে আমাদের আলোচনা হওয়া প্রয়োজন এ কারণেই যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটিও নিহিত এই রাজনৈতিক-সূত্রেরই মধ্যে।

একাত্তর টেলিভিশনের জনপ্রিয় টকশো একাত্তর সংযোগে এবারের ২৬শে মার্চকে কেন্দ্র করে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল ২৪ মার্চ রাতে আলোচনার বিষয় ছিল ৪৮ বছর পরেও স্বাধীনতা বলতে বাঙালি আসলে কী বুঝেছে? কী পেয়েছে এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাঙালির আছে কিনা? মূলতঃ এসব প্রশ্নই ঘুরেফিরে আলোচকদের জিজ্ঞেস করেছেন উপস্থাপক। আলোচনায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, তারা যার যার মতো করে স্বাধীনতার ৪৮ বছরের মাথায় এসে বাঙালির রাজনৈতিক প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে এই প্রশ্নটি অনালোচিতই থেকে গেছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানের সাবেক সেই সামরিক-ধারায় নিয়ে যাওয়ার কারিগর কারা? এবং কী ভাবে সেখান থেকে এখনও বাংলাদেশকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

৪৮ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি কী পেয়েছে আর কী পায়নি, তা হিসাব কষে বের করার প্রয়োজন হবে না যদি আমরা কেবল পাকিস্তানের দিকে একবার তাকাই। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে টিকে আছে বটে কিন্তু কি তার সম্মান, কি তার অর্থনৈতিক অবস্থা, কি তার রাজনৈতিক অবস্থান সে বিষয়ে আমরা কমবেশি সকলেই জানি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশে পাকিস্তান শব্দটি একটি অত্যন্ত ‘নেতিবাচক’ শব্দ হিসেবেই চিহ্নিত এবং এই শব্দের পরিচয়ে পরিচিতদের ক্ষেত্রে ভ্রু-কুঁচকে তাকানোটা পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রও ঠিক ঠেকাতে পারছে না।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পশ্চিম শুরু করেছে তার প্রধান শত্রুরাই যে পাকিস্তানের সঙ্গে কেবল আঁতাত করেছে তাই-ই নয়, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-প্রশিক্ষণ দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে সাধারণ পশ্চিমা ধারণায় পাকিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রটি নিজেই সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক এবং এ কারণেই রাষ্ট্রটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নিজের নাম লেখানোর দিকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। অনেক তাত্ত্বিক পণ্ডিতই বিশ্বাস করেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিমের বোঝাপড়া একটু থিতিয়ে এলেই নজরটা এসে পড়বে পাকিস্তানের ওপর এবং তখন আর এই রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

অপরদিকে বাংলাদেশের অবস্থানটি কি? বহুবিধ অপপ্রচার ও বাংলাদেশের ভেতর থেকেই বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতা চালানো রাজনৈতিক শক্তির শত অপচেষ্টার পরও পশ্চিমে এখনও বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক চেতনার রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। বিশেষ করে ২০০১ সালের পর থেকে বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম স্টেইট’ হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করা হলেও সেই পরিচয় পশ্চিম গ্রহণ করেনি, উল্টো বাংলাদেশে অব্যাহত গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষার সংগ্রামকেই পশ্চিম প্রাধান্য দিয়ে দেশটির অর্থনীতিসহ সামগ্রিক উন্নয়নকে বাহাবা দিতে কার্পণ্য করছে না।

বর্তমানেও যখন বাংলাদেশকে টার্গেট করে এখানে গণতন্ত্র নেই বলে অপপ্রচারের বন্যা বইয়ে দেওয়ার পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে তখনও বিশ্ববিবেক বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবেই দেখছে এবং পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রের নির্যাতিত ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। এরকম স্বীকৃতি খুব কম দেশের ভাগ্যেই জুটেছে সাম্প্রতিক অতীতে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে, রাজনৈতিক ভাবে বাঙালির প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, এবং সে প্রশ্ন আমাদেরই নিজস্ব, সেকথাও মানতেই হবে। একাত্তর টেলিভিশনের এই অনুষ্ঠানটি তাই অত্যন্ত সময়োপযোগী ও আলোচনায় উঠে আসার দাবিদার বলেও আমি মনে করি।

আর সে কারণেই আমাদের প্রথমে খুঁজতে হবে কেন এবং কোন্ কারণে বাঙালি স্বাধীনতার পরেও রাজনৈতিক ভাবে পরাজিত হয়েছে বার বার, কেন গণতন্ত্রকে এখনও স্থিতিশীলতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন এখনও বাঙালিকে এই ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয় যে, এই বুঝি গণতন্ত্র হাতছাড়া হয়ে গেলো, কেনই বা গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে সাধারণ মানুষকে সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভুল পথে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা থেকে বাঙালি বেরুতেই পারছে না এখনও পর্যন্ত।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরে যদি সত্যিকার অর্থেই কিছু অপ্রাপ্তি বাঙালির থেকে থাকে তাহলে সে অপ্রাপ্তিটা আর কিছুই নয়, সেটা হলো, বাঙালিকে রাজনৈতিক ভাবে অন্ধ করে দেওয়া এবং ভুল রাজনীতির ফাঁদে ফেলে প্রকৃত অগণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বাঙালির সামনে গণতন্ত্রের মোড়কে হাজির করা এবং কখনও কখনও তাদেরকে ক্ষমতায় বসানোয় বাধ্য করা। আর আরো দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াটিও শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে এবং এদেশে সামরিক ছাউনি থেকে একের পর এক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

আমরা স্বীকার করি কি না করি, তাতে সত্যের হেরফের হবে না যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে শুরু করে দেশের বাম ও উদারনৈতিক রাজনীতিরই সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করা হয়েছিল, সেকথা আজকের বাম-রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারেন না কেন সেটা এক চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের মতো বড় ও জনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল কিন্তু ৭৫-এর পর ২১ বছর রাস্তায় থেকে ঠিকই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত বাঙালির রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামটি জারি রেখেছে।

অপরদিকে গণতন্ত্রের মোড়কে অগণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এতোটাই মোহনীয় করা হয়েছিল যে, এদেশের বাম রাজনীতি সেই মোহ থেকে মুক্ত না হয়ে এখন বরং আরো মোহাবিষ্ট হয়ে ‘দেশে গণতন্ত্র নেই’ বলে জিকির তুলে দেশের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে। যদিও তাদের নিজেদের রাজনীতি কতোটা গণতান্ত্রিক কিংবা ক্ষমতা পেলে তারা কতোটা গণতান্ত্রিক থাকতেন সে প্রশ্নের মীমাংসা কোনোদিনও সম্ভব নয় কারণ তাদের পক্ষে ক্ষমতা নিয়ে এদেশ পরিচালনার সম্ভাবনা কম।

তবে তারা সামরিক শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করে তাদেরকে রাজনৈতিক দল খুলে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করার কৌশল বাতলে দেওয়া থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেরা গিয়েও সামরিক শাসকদের তৈরি রাজনীতিতে গিয়ে নাম লিখিয়ে তাদেরকে এদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করায় ভূমিকা রেখেছেন বাঙালির সবচেয়ে বড় হারটি সেখানেই ঘটেছে যে, মানুষকে প্রকৃত গণতন্ত্র কি জিনিস সেটা বুঝতে না দেওয়া, তাদেরকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ‘বিকল্প’ নয়, প্রকৃত জননেতা বাছাইয়ের পদ্ধতি শিখতে না দেওয়া এবং রাজনৈতিক ভাবে অনেকটাই মোহগ্রস্ত করে রাখা, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও বাঙালির এই ‘রাজনৈতিক পরাজয়’ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় পরাজয় যদি হয় তাহলে এই পরাজয়ের জন্য যে সকল ব্যক্তিবর্গ ও রাজনীতি সবচেয়ে বেশি দায়ী তারা আর কেউ নন, ১৯৭৬ সালে গঠিত রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকেই চিহ্নিত করতে হবে- এবং আমরা যদি আজকেও সেকথা জোর গলায় বলতে না পারি তাহলে আগামী ৪৮ বছরেও আমাদের রাজনৈতিক এই পরাজয়ের গ্লাণি বয়ে বেড়াতে হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
ঢাকা ২৫ মার্চ, সোমবার ২০১৯

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/জেআইএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews