গরমের দগ্ধ বাতাসে জনজীবন নাজেহাল। গ্রীষ্মকালীন লু হাওয়ায় দেশের যে নাকাল অবস্থা তা বৈশাখ মাসের শেষ সময়ের চরম দাবানল। সামনে অপেক্ষমাণ জ্যৈষ্ঠ মাসের তীব্র তাপপ্রবাহ। কবি গুরুর বয়ানে ‘তাপস নিঃশ্বাসওবায়ে’র যবনীকা পাতের পর মধু মাস জ্যৈষ্ঠের শুভাগমন বাংলার ঘরে ঘরে ফল উৎসবের পরম সুসময়। এখন চলছে চরম ভাবাপন্ন রৌদ্রের রুদ্রমূর্তি। আর রাজধানী ঢাকায়ও তাপদাহ তার বিপন্ন পরিবেশে মানুষের নিত্যদিনযাপনকে অসহনীয় দগ্ধতায় উত্তাল করে তুলছে। গণমাধ্যমের তীক্ষè নজরও রয়েছে তাপপ্রবাহের চরম উষ্ণতায়। উঠে আসছে দেশের ৪৫ জেলায় তীব্র গরমে সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবন অসহনীয় এক জ্বালা-যন্ত্রণার। ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা উঠেছে ৪১ ডিগ্রির উপরে। গোটা জ্যৈষ্ঠ মাস সামনে অপেক্ষমাণ। ষড়যঋতুর বিচিত্র লীলাভূমি আমাদের ক্ষুদ্র শ্যামল আবহমান বাংলা। ঋতুর পালাবদল ও এই পলিমাটির উর্বর দেশটির অনন্য বিচিত্র নৈসর্গিক আবহ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাও তাপদাহে ভারাক্রান্ত। নিদারুণ এক যন্ত্রণায় অস্থির। আবার বৈশাখ মাসের কালবৈশাখীর ঝাপটা থেকেও পরিত্রাণ নেই নির্ভীক বাঙালির। এমন সব নৈসর্গের লীলাখেলাকে সামাল দিয়ে চলতে হয় সমুদ্র পরিবেষ্টিত আর নদ-নদী বিধৌত চিরায়ত এই বরেন্দ্র ভূমিকে। প্রকৃতির বিচিত্র আর উম্মত্ত লীলাখেলায় অভ্যস্ত জাতি বিপরীত প্রদাহকে মোকাবিলা করেই আপন শৌর্যে টিকে থাকে মাথা উঁচু করে। এখন পর্যন্ত সেভাবে বৃষ্টির ধারায় জলসিক্ত পরিবেশ শুরুই হয়নি। প্রকৃতি যেন খরার আবর্তে নিতান্ত অগ্নিশিখা প্রায়। কবি গুরুর ভাষায়Ñ‘দারুণ অগ্নিবানে’ যথার্থই অগ্নিস্নাত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের পরম নির্মাল্য। আবার খরা আর বিদগ্ধ তাপপ্রবাহের চরম দুঃসময়ে রোগবালাইও যেন পেয়ে বসে। কোমলমতি শিশু আর বয়োবৃদ্ধ মানুষের চরম ভোগান্তি হিসেবের মধ্যেই থাকে না। বাংলাদেশ এখনো সিংহভাগ গ্রামের একই সবুজের আবৃত্ত দেশ। গ্রামে পল্লী বিদ্যুতায়ন সহজলভ্য হলেও লোডশেডিংয়ের পাল্লায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতে সময়ও লাগছে না বেশি। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে লোডশেডিংয়ের মতো আরেক দুর্ভোগ। তবে এ দেশের মানুষ এমন সব বিপরীত প্রদাহকে মোকাবিলা করে টিকে থাকে। অভ্যস্তও হয়ে পড়ে। অস্বস্তি কিংবা যন্ত্রণা কোনোভাবে কমেও না। রোদের প্রচণ্ড খরতাপে রাস্তায় চলাচল এক প্রকার নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। ঘরে বসে থাকার উপায়ও নেই। কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনও হেলা-ফেলায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এক প্রকার নিয়মের মধ্যেই। সবার ঘরে বিকল্প বিদ্যুতের জন্য আইপিএসের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার বিদ্যুৎ ঘাটতি যত বাড়ে আইপিএসের অবস্থাও সঙ্গীন হওয়ার যোগাড়। তবে সংশ্লিষ্ট আবহাওয়াবিদরা আশার কোনো বাণী দিতে পারছেন না। তারা বলছেন বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের গ্রীষ্মকাল সামলানো যুগ-যুগান্তরের ঋতুকালীন প্রদাহ। যার ব্যত্যয় হওয়ার জোই নেই। তবে ধনে ধান্যে, পুষ্পে ভরা এই দেশে ফসলি জমি কিংবা পরিশ্রান্ত ক্লান্ত কৃষকের সংখ্যাও কম নয়। পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে উদয়াস্ত খাটাখাটনিতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দেশের মানুষের মুখে অন্ন জোগানো অত সহজ সাধ্য নয় কিন্তু। আবার প্রখর রৌদ্রোজ্জ্বল তাপদাহ ছাড়া শস্য খেতে সোনালি রৌদের অনেক বেশি দরকার। স্বস্তির বৃষ্টি নামতে কত দেরি হবে তারই প্রতীক্ষায় খেতের কৃষক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। এখন চলছে মে মাসের ২য় সপ্তাহ। চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ৪১ ডিগ্রি পার হওয়ার দুরবস্থায়। সামনে যে আর কত উঠতে পারে ধারণা করা মুশকিল। বৃষ্টি পড়লেও যে গরম কমে এমন নয় কিন্তু। পরিবেশ হয়ে ওঠে দুর্বিষহ এক অশান্ত প্রকৃতির দাপট, যা মানা যায় না। প্রতিকারেরও তেমন কোনো উপায় থাকে না। সামান্য বৃষ্টির মধ্যে যে রোদ-বর্ষার খেলা তাতে ভ্যাপসা গরমের যে নিদারুণ যন্ত্রণা তা খরতাপের চাইতেও কম কিছু নয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪১ পর্যন্ত। দেশের উত্তর প্রান্তে। তাপদাহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একভাবে থাকে না। কোথাও বেশি আবার অনেক স্থান অপেক্ষাকৃত কম। তবে দহনের পাল্লায় পড়ে গেলে কম-বেশি আসলে ধর্তব্যের মধ্যে থাকেই না। তবে রাজশাহী শহরসহ উত্তরাঞ্চলে মে-জুন মাস পর্যন্ত যে তাপদাহ প্রভাব বিস্তার করে তা অঞ্চলবাসীর জন্য চরম দুরবস্থার এক বিপন্নকাল। শুধু কি প্রখর সূর্যের খরবায়ু মোকাবিলা করা? তার চেয়েও বেশি মানুষের উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় লাগাতর কার্বন নিঃসরণ প্রকৃতিতে যে দাহ্য বস্তু ছড়িয়ে দিচ্ছে তাকে বিবেচনায় আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী ‘ধরিত্রী বাঁচাও’ স্লোগানে তৎপর হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই। এখন আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যগগনে। ১৭৬০ সালের শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তিগত অভিগমনে এগিয়েছে বহুদূর। কিন্তু নিত্যজীবন প্রবাহ কতখানি বিষময় আবর্তে ধাবিত হচ্ছে তেমন হিসাব-নিকাশও জরুরি। ধারণা করা হচ্ছে শিল্প প্রযুক্তি থেকে যে দূষিত কার্বন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে নৈসর্গের সহজাত পরিবেশের ওপর প্রচণ্ড আঁচড় বসানো হচ্ছে। তবে খরতাপের উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়াও সহজাত নৈসর্গকে নয়ছয় করে দিতে যথেষ্ট। শুধু কি তাই? উন্নয়ন মহাযজ্ঞের নামে সবুজের সমারোহের গাছপালা কর্তনেও স্বাভাবিক প্রকৃতির যে বিদগ্ধ প্রতিবেশ তাও এক নৃশংস আঁচড়ে বসানো। শুধু কি গাছপালা কেটে ফেলা? বন-বনান্তর উজাড় করে শ্যামল ছায়াঘন নৈসর্গকে যে মাত্রায় দগ্ধতার আগুনে পোড়ানো হচ্ছে তার শোধ নেওয়া ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। আগুনে কাঁপানো এমন রৌদ্রস্নাত প্রতিবেশকে বলা হচ্ছে প্রকৃতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেন ভাঙনের খেলায় উন্মুত্ত হয়ে উঠছে, যা এক প্রকার সহজাত প্রকৃতির চরম প্রতিশোধ। তাই নৈসর্গবাদীরা জোরেশোরে বলে যাচ্ছেন প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করে এমন অসহনীয় যন্ত্রদানবের লাগাম টেনে ধরা প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানদের জন্যই নিতান্ত জরুরি। আমরা জানি গাছ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে নিজের শেকড়ের শুদ্ধ অক্সিজেন ছেড়ে দেয় চারপাশের বায়ুমণ্ডলে, যা কিনা পরিশুদ্ধ বাতাসকে জনজীবনে ছড়িয়ে দিতে এক প্রকার উন্মুখই হয়ে থাকে।
সবুজের আভরণে পরিবেষ্টিত শস্য-শ্যামল বঙ্গভূমি আজ কোনো দৈন্যদশায়। ঋতু বৈচিত্র্যের হরেক মাত্রার সম্পদকে কোলের সন্তানদের বিপরীতে নিয়ে যাচ্ছে। তা ভেবে দেখার অবকাশ নিয়তই কমে যাচ্ছে। আর দেরি করা নয়। কার্বন নিঃসরণের লাগাম টেনে ধরাই শুধু নয় প্রকৃতি সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবনও সময়ের দাবি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews