গত ৬ মে রাত ১টা ৪০ মিনিটে ভারত কর্তৃক পাকিস্তানের ভূখণ্ড এবং আজাদ কাশ্মীরের মোট ৯টি স্থানে হামলার পর পাকিস্তান রাত ৩টায় পালটা হামলা চালায়। এ পালটা হামলায় ভারতের পাঁচটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত হয়। এরপর ৭ মে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ভাষণ দানকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঘোষণা করেন, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত স্থানে ভারতকে আঘাত করার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে অপারেশনাল ফ্রিডম বা আক্রমণ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের টেলিভিশন জিও টিভিতে যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে, তার শিরোনাম হলো, ‘Pakistan Army on high alert as fears of nuclear war rise’. অর্থাৎ ‘পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা বৃদ্ধির ফলে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে’। এর পালটা ভারত তার ১৫টি প্রদেশে (রাজ্যে) গত ৭ মে নিষ্প্রদীপ মহড়াসহ সিভিল ডিফেন্স বা মক ড্রিল করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার এ আণবিক ক্ষমতাধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে টান টান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এবং আশঙ্কা, দেশ দুটি কি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হবে? নাকি লিমিটেড ওয়্যার বা সীমাবদ্ধ যুদ্ধের মধ্যেই সীমিত থাকবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের পক্ষে এটি আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের জন্য এটি হলো অস্তিত্বের লড়াই। কারণ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কনভেনশনাল ওয়েপন বা প্রচলিত অস্ত্রের দিক দিয়ে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পক্ষান্তরে পারমাণবিক শক্তির দিক দিয়ে পাকিস্তান ১০টি পারমাণবিক বোমায় এগিয়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি কংগ্রেস, বিশেষ করে তার নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল মোটেই মেনে নিতে পারেননি। ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন দেশের জন্মের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন পণ্ডিত নেহেরু। নেহেরু তার গ্রন্থ ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়াতে’ লিখেছেন, পরাশক্তি হওয়ার মতো যেসব উপাদান, তার সবই ভারতে আছে। পরাশক্তি হওয়ার জন্য ভারতের প্রয়োজন কিছু সময়।
উল্লেখ করা যেতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে ছিল দুটি পরাশক্তি। এ দুটি হলো আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালে কমরেড মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত এবং চীন উভয় দেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত। পরাশক্তি হতে গেলে বড় বিস্তৃত ভূখণ্ড এবং বিপুল জনসংখ্যা ছাড়াও প্রয়োজন হয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। এ দুটিতেই তখন ভারত পিছিয়ে ছিল। পণ্ডিত নেহেরু মনে করতেন, ভারত যদি অখণ্ড থাকত, অর্থাৎ পাকিস্তান যদি আলাদা না হতো (তখন পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশও ছিল) তাহলে আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে তারা চীনের সমকক্ষ হতো।
১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব ভারত ও পাকিস্তানকে সমকক্ষ মনে করত। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ নামে আলাদা হয়ে গেলে আঞ্চলিক ভারসাম্য দারুণভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশিদের প্রতি ভারতের যত না দরদ, তার চেয়ে বেশি তার প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানকে দুই টুকরা করা। বিগত ৫৪ বছরে ভারত এ এলাকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি এবং বিশ্বে ৪র্থ বৃহত্তম শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ওইদিকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হলেও অবশিষ্ট পাকিস্তান জনসংখ্যায় এবং সামরিক শক্তিতে বিগত ৫৪ বছরে আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।
২.
১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমরা ঢাকার আকাশে দেখেছি ওই সময় (৫৪ বছর আগে) সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন রুশ মিগ-২১কে (রাশিয়া থেকে কেনা) তাড়া করছে পাকিস্তানের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরিত্যক্ত লক্কড়-ঝক্কড় মার্কিন স্যাবর এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান। একজন ভারতীয় সাংবাদিক কৌতুক করে বলেছিলেন, একটি বেবিট্যাক্সি (এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান) তাড়া করছে একটি মোটর গাড়িকে (রুশ মিগ-২১)।
৫৪ বছর পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হলেও যে গতিতে পাকিস্তান শক্তি সঞ্চয় করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে শক্তি সঞ্চয় করেছে ভারত। আজ ভারতের কাছে রয়েছে বিমানবাহী জাহাজ (Aircraft carrier) দুটি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের একটিও নেই। ভারতের রয়েছে ৩৬টি সর্বাধুনিক জঙ্গিবিমান ফরাসি রাফাল। আরও রয়েছে রাশিয়ার এসইউ-৩০ জঙ্গিবিমান। পাকিস্তানের রয়েছে মার্কিন এফ-১৬ জঙ্গিবিমান। এই এফ-১৬ও সেকেলে হয়ে গেছে। তবে পাকিস্তান পেয়েছে চীনের জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গিবিমান। জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গিবিমান এবং রাফাল মোটামুটি বলতে গেলে সমানে সমান। তবে সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের অস্ত্র ভান্ডারে রয়েছে এ দুটি ছাড়াও ফরাসি মিরাজ-২০০০। সংখ্যাগতভাবে পাকিস্তান প্রচলিত অস্ত্র অর্থাৎ ট্যাংক, জঙ্গিবিমান, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, সবক্ষেত্রেই ভারতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আগেই বলেছি, ভারত কখনো পাকিস্তান সৃষ্টিকে মেনে নেয়নি। বিগত ৫৪ বছরে পাকিস্তানকে গিলে খেত ভারত। কিন্তু ’৭১-এর যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে যদি পাকিস্তানকে টিকতে হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবশিষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো অ্যাটম বোমা বানানোর জন্য হল্যান্ড থেকে পাকিস্তানে ডেকে আনেন পারমাণবিক পদার্থবিদ ড. আবদুল কাদেরকে। জনাব ভুট্টো ঘোষণা করেন, ঘাস খেয়ে হলেও পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা নির্মাণ করবে। উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। ১৯৭৪ সালে ভারত পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। পাকিস্তান ১৯৯০ সালে পারমাণবিক বোমা নির্মাণ করলেও সেটির প্রকাশ্য ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ১৯৮৯ সালে।
৩.
বিশ্বব্যাপী ভারত ও পাকিস্তানকে বলা হয় চিরবৈরী দুই রাষ্ট্র। তাদের বৈরিতার কেন্দ্রবিন্দু হলো কাশ্মীর। কাশ্মীর নিয়ে কেন বিরোধ, সেটি স্থানাভাবে আজ আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হবে, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান এবং ভারত চিরদিন বৈরী থাকবে। এখন কাশ্মীর আর দুই অঞ্চলে বিভক্ত নয়। এখন বিভক্ত তিন অঞ্চলে। পাকিস্তান অংশে রয়েছে আজাদ, কাশ্মীর, হুনজা এবং গিলগিট। ভারতীয় অংশে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। চীনা অংশে রয়েছে আকছাই চীন। চীন দাবি করে, লাদাখ আকছাই তার অংশ। এ দাবিতে ২০২০ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে।
৬ তারিখ গভীর রাতে যে ভারতীয় হামলা হলো, সেটি কি সেখানেই শেষ হয়ে যাবে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ইউরোপের তিনটি দেশ সফর বাতিল করেছেন। ওইদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার তার বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন।
অন্য সবসময়ের চেয়ে এবার পাকিস্তান ভারতকে মোকাবিলা করার সংকল্পে অটল। তাদের আবারও উদ্বুদ্ধ করেছে পাকিস্তান সৃষ্টির মূল আদর্শ, অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্ব। পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অসীম মুনির দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তানিদের জন্য ঘোষণা করেছেন, ‘You must tell Pakistan's story to your children. Our forefathers believed that we are different from the Hindus in every aspect of life. Our religions, our customs, traditions, thoughts and ambitions are different. That was the foundation of the two-nation theory that was laid.’ অর্থাৎ, ‘আপনারা অবশ্যই আপনাদের সন্তানদের বলবেন, তাদের পিতৃপুরুষদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস হলো, এই যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে আলাদা। আমাদের ধর্ম, আমাদের আচার-আচরণ, ঐতিহ্য, চিন্তাধারা এবং আকাঙ্ক্ষা হিন্দুদের থেকে আলাদা। এটিই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি।’
৪.
আমরা আগেই বলেছি, পাক-ভারত সংঘর্ষ কোথায় গিয়ে থামবে, সেটি এখন কেউ বলতে পারছেন না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান বলেছেন, ‘ভারত যে আক্রমণ করেছে, তার ফলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে এ দুটি দেশ। আমরা এ উসকানিমূলক হামলার নিন্দা করি, যে হামলা বেসরকারি মানুষ হত্যা করে এবং বেসরকারি স্থাপনায় আঘাত করে।’
ঢাকার একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক গত ৭ মে বিকালে তাদের অনলাইন সংস্করণে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফের উদ্ধৃতি দেয়। খাজা মোহাম্মদ আসিফ বলেছেন, চীন কাশ্মীর বিরোধে তৃতীয় পক্ষ হয়ে নয়, সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, চীন কেবল একটি প্রক্সি যুদ্ধ নয়, পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে এবং এমনকি সংকটময় মুহূর্তে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।
ভারত কেন পাকিস্তানের ভূখণ্ডে আঘাত হানল? টাইমস অব ইন্ডিয়া, দি হিন্দু এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক, ভারত ৬ তারিখ মধ্যরাতে আক্রমণ করেছে পাঞ্জাবের বাহওয়ালপুর, মুরিদ, মেহমুনা জোয়া, বরনালা, সরজাল, কোটলির আব্বাস ও গুলপুর এবং মুজাফ্ফরাবাদের সইদনালা বিলাল ও সওয়াই নালায়। যেসব এলাকায় ভারত যুদ্ধের মহড়া করছে, সেগুলো হলো, দিল্লি, কলকাতা, কেরালা, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, আসাম, অন্ধ্রপ্রদেশ, ত্রিপুরা, চন্ডিগড় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে।
ভারত এ হামলার নাম দিয়েছে সিঁদুর। হিন্দু মহিলাদের সিঁথিতে সিঁদুর হলো, সে যে বিবাহিত তার চিহ্ন। মোদি উগ্র হিন্দুত্ববাদ রাষ্ট্রের সমাজ ও পরিবার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এ বছর নভেম্বর মাসে বিহার বিধানসভার নির্বাচন হবে। আর ২০২৬ সালে হবে আসাম, কেরালা, তামিল নাড়ু, পদুচেরি ও পশ্চিমবঙ্গে। যুদ্ধ করে ভারত দেখাতে চায়, তার হ্যাডম আছে। আর সেটি দেখিয়েই তিনি এসব নির্বাচনে বিজয়ী হতে চান। আর সেই বিজয় অর্জনের জন্য নরেন্দ্র মোদি উভয় দেশের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের বলি দেখতে চান।
মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক
journalist15@gmail.com