কিছু ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ জমা হয়েছে; কিন্তু তাদের ওপর কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় করারোপ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কর ফাঁকি রোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ এসব কথা বলেন। আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট কেমন হওয়া উচিত-জানতে চাইলে যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা কর অফিসকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনলে হবে না, পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যকেই ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় এনে কর ফাঁকি রোধের দিকে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। আর অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাজেটের আকার বৃদ্ধি না করাই যুক্তিসঙ্গত হবে বলেও মনে করছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি মিজান চৌধুরী।

যুগান্তর : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে কোন কোন বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া দরকার?

মাহবুব আহমেদ : আমার বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে মনোযোগ হওয়া উচিত সামষ্টিক অর্থনীতিতে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে আর্থিক স্থিতিশীলতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ অস্থিতিশীল আর্থিক খাত অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করতে পারে। এছাড়া খাতওয়ারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া সঙ্গত হবে। উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) আকার ইতোমধ্যে যেটি নির্ধারণ করেছে তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করতে হবে।

যুগান্তর : প্রতিবছর ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে বাজেটের আকার বড় করা হয়। আমরা দেখছি আগামী বাজেটে আকার চলতি বাজেটের তুলনায় বাড়ছে না-এটি বাস্তবমুখী হবে কি?

মাহবুব আহমেদ : দেশে অতীতে ঘোষিত বাজেটের আকার জিডিপির ১৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকত। যদিও উন্নয়নশীল একটি অর্থনীতিতে এ আকার আরও অনেক বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ১৫ শতাংশ অর্থই আমরা রাজস্বের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারিনি, দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। আবার কোনো বছরই ওই ১৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পারিনি, ব্যয়িত অর্থের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আবার অপচয় হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাজেটের আকার বৃদ্ধি না করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। তবে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের স্বার্থে দীর্ঘদিন সংকোচনমূলক ফিসক্যাল পলিসি অনুসরণ করা যথাযথ হবে না।

যুগান্তর : বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মাহবুব আহমেদ : বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরে আনার ক্ষেত্রে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তা মোকাবিলায় বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সরকার গঠিত যৌথ তদন্ত দলের সমন্বিত প্রতিবেদনে এতদসংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য উঠে এসেছে। যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে মুদ্রা পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে চারটি সংস্থা সরাসরি কাজ করে থাকে। সেগুলো হচ্ছে বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে যা অবিলম্বে দূর করতে হবে। মুদ্রা পাচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও যেসব দেশে মুদ্রা পাচার হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন জেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও এসব উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। এজন্য সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে।

যুগান্তর : ঋণ ছাড় নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্থাটি শর্ত নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে ঋণ নেওয়া হবে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য।

মাহবুব আহমেদ : এখন দূরত্ব কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, সরকার তীক্ষè নজরদারি সাপেক্ষে ডলারের মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ গ্রহণে সম্মত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও দুভাগে (পলিসি ও ইপ্লিমেন্টেশন) ভাগ করা হয়েছে। আইএমএফও ঋণের দুই কিস্তি বাবদ ১৩০ কোটি ডলার ইতোমধ্যে ছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া সংস্থাটির শর্তের অনেকগুলো সংস্কারের জন্য অনেক আগ থেকেই আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদরা তাগাদা দিয়ে আসছিলেন। আশা করছি শিগগিরই এ দূরত্ব সরকার কমিয়ে আনবে।

যুগান্তর : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে সরকারের কী করণীয় আছে?

মাহবুব আহমেদ : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ পণ্যমূল্য বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি চলমান। সরকারও বাজেটের আকার সীমাবদ্ধ রাখতে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে লাগাম টেনেছে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমে এসেছে, ভবিষ্যতে আরও কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

যুগান্তর : বিগত দিনগুলোর তুলনায় নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কম ধরা হচ্ছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী হতে পারে?

মাহবুব আহমেদ : সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি সামষ্টিক অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস করার ক্ষেত্রে ফলদায়ক হলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক হিসাবে কাজ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনেও চলমান বছরে প্রবৃদ্ধি তিন-চার শতাংশের মধ্যে আটকে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সরকারও চলতি বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কম করতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে রাখা যাবে না, তাহলে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়ে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে। ১৭ কোটি জনসংখ্যা সংবলিত একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তবে একই সঙ্গে বিগত দিনে উপেক্ষিত বণ্টন ব্যবস্থার দিকেও সমপরিমাণ গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের সেদিকেই তাকাতে হবে।

যুগান্তর : বিনিয়োগ নেই-কর্মসংস্থানও হচ্ছে না, আসন্ন বাজেটে কী করণীয় আছে বলে করছেন?

মাহবুব আহমেদ : কিছুদিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বর্তমান সরকার আর্থিক শৃঙ্খলা ও বিভিন্ন কারণে সরকারি বিনিয়োগে নানা ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করছেন। বেসরকারি বিনিয়োগ একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ বিষয় জড়িত রয়েছে। নতুন বিনিয়োগ হতে বিলম্ব হলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। বিদ্যমান কলকারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে মোট উৎপাদন বাড়ানোর দিকে এই মুহূর্তে নজর দেওয়া যেতে পারে।

যুগান্তর : ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ঠিক করে শক্তিশালী করতে কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা আছে কী এবং এ খাত ঠিক করতে কী করা যেতে পারে?

মাহবুব আহমেদ : ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। এ রকম কমিশন গঠনের কার্যক্রম অতীতে শুরু করা হলেও তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে ব্যাংক খাতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কার্যক্রম কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে-এটা পলিসি ও গভর্নেন্স- দুটো ক্ষেত্রেই। এতে আর্থিক খাতে কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে (জানুয়ারি ২০২৫-এ দাখিলকৃত) ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর দীর্ঘ চ্যাপ্টার সন্নিবেশ করা হয়েছে। যেখানে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নানা সুপারিশ রয়েছে। সেগুলো পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়ন শুরু হলে পৃথকভাবে ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব এই মুহূর্তে কতটা প্রাসঙ্গিক তা বোঝা যাবে।

যুগান্তর : প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আপনি সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সময় উপযোগী ও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন। এটা দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছেন, একটু ব্যাখ্যা করবেন?

মাহবুব আহমেদ : এতক্ষণ আমরা বাজেটের আকার ও বরাদ্দ নিয়ে কথা বলেছি, আয়ের দিকটি উপেক্ষিত থেকেছে। যদিও সরকারের আয় অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের রাজস্ব বা জিডিপি অনুপাত অত্যন্ত কম, এটা বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ ও সংস্কারের কথা বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে করনীতি তৈরি ও কর আদায় কার্যক্রম দুটোই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পরিচালিত হতো। বর্তমান সরকার কর পলিসি গ্রহণ ও আইন তৈরি এবং কর আদায় কার্যক্রমকে পৃথক করার জন্য এনবিআরে পৃথক দুটি বিভাগ সৃষ্টি করেছে। শুধু পৃথকীকরণ মূল সমস্যা অর্থাৎ নিুকর-জিডিপি অনুপাত দূর করতে পারবে না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে করভিত্তি সম্প্রসারণের কথা বলা হয়ে থাকে। এতে প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তা হবে প্রান্তিক ধরনের। ৫০ বছর ধরে আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। কিছু কিছু ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ জমা হয়েছে যে, তাদের কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় করারোপ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কর ফাঁকি রোধের উদ্যোগ গ্রহণও জরুরি। শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা কর অফিসকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনলে হবে না পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যকেই ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় এনে কর ফাঁকি রোধের দিকে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। আসন্ন বাজেটে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে আশা করি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews