ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ভারতীয় আধিপত্যবাদী এজেন্ডার প্রবল চক্রব্যুহ ভেঙ্গে দিলেও চব্বিশ পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে হেজিমনিক ষড়যন্ত্র এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। অব্যাহত হুমকি ও প্রলোভন উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৬ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক গাঁটছড়া অটুট রাখতে সক্ষম হলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর একই সমান্তরালে থাকা দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে যেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ ভর করেছে। বাংলাদেশের গত তিনশ’ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নে একটি কমন প্রতিপক্ষ হচ্ছে, অহেতুক বিভাজন-বিভক্তি থেকে সৃষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। সেই পলাশির প্রান্তরে জোড়াতালি দেয়া ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষুদ্র বাহিনীর কাছে নবাবের বিশাল বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দুইশ’ বছরের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার বদলে বিভাজন ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ক্রমেই ঘণীভূত বহুমাত্রিক বিস্তার লাভ করেছে। সুলতান-মোঘলরা স্পর্শকাতর, বহুধাবিভক্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ঐকবদ্ধ করে শত শত বছর ধরে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্রমেই বিশ্বের সামনে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও ভারতে ইংরেজের রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ এবং ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখার মূল কৌশল ছিল, ডিভাইড অ্যান্ড কনকোয়ার থেকে ডিভাইড রুল পলিসি। নবাবের ঘরে গৃহবিবাদ সৃষ্টি, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শত শত বছরে গড়ে ওঠা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির সম্পর্ককে অবিশ্বাস, অনাস্থা ও বিভেদ সৃষ্টির পর তা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংঘাতে রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে দুই জাতিকে পদানত রেখে শাসন-শোষণ চালিয়ে যাওয়ার বৃটিশ নীতিকে ঔপনিবেশোত্তর ভারতের চানক্যবাদী বিদেশ নীতির অর্ন্তভুক্ত করে নিয়েছে। এ যেন সাবেক ইমপেরিয়াল রাষ্ট্রশক্তির নিওকলোনিয়ালিজমের অন্যতম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণœ রাখতে পরনির্ভরশীলতা, উন্নয়নের নামে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিতে বিভাজনের রাজনীতিই হচ্ছে মোক্ষম অস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরম বাস্তবতায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতীয় উপমহাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ নিরুপায় হয়েই ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময়ে নতুন সৃষ্ট দেশগুলোর মানচিত্রের সীমান্তের বিভাজন রেখায় অত্যন্ত সুকৌশলে পুঁতে রেখেছিল অন্তহীন বিরোধ ও যুদ্ধের বীজ। ভারত-পাকিস্তানের কাশ্মির সীমান্ত ১৯৪৮ সাল যেমন উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত ছিল, সাড়ে ৭ দশক পেরিয়ে এসে দেশ দুটি বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পারমানবিক প্রতিবেশি এবং ২০২৫ সালেও একই রকম সংঘাত-সহিংসতার শিকার। যদিও এসব যুদ্ধে কোনো পক্ষের বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র দরিদ্র মানুষের ভাগ্য বদলের পরিবর্তে জনগণের সম্পদকে মারণাস্ত্রের পেছনে ব্যয় করাই যেন এসব বৈরিতার মূল ফলাফল। ভারতের বিজেপি শাসকদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুরো উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আকাশকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ও অগ্নিকুন্ডুলিময় কুরে তুলেছে। ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে প্রতিবেশি দেশগুলোর উপর সরাসরি এর বিরূপ প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আঞ্চলিক হেজিমনিক রাজনৈতিক এজেন্ডার আলাপ খুবই প্রাসঙ্গিক। গত এক দশকে ভারত একাধিকবার চীনের সাথে সীমান্তবিরোধে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। ডোকলাম সীমান্তবিরোধের সময় নেপাল, ভূটানের মত ক্ষুদ্র ল্যান্ডলক্ড প্রতিবেশিরাও ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গেছে। এ বছর মে মাসে কাশ্মিরের পেহেলগাঁওয়ে কথিত জঙ্গি হামলার অুজহাত তুলে সামরিক হেডম দেখাতে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে গিয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কাছে চরম মার খেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধরে যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ভারতের শাসকদের অবস্থান বরাবরই বিপরীতমুখী। জনসংখ্যার মানদ-ে ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করলেও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতীয় শাসকরা বরাবরই মূল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আওয়ামী লীগের মত প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির জনসমর্থন ও গণভিত্তিকে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী চরিত্রে রূপান্তরিত করে জনবিচ্ছিন্ন ও গণশত্রুতে পরিনত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতির জন্ম দেয়া এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আয়োজনকে কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থের সফ্ট পাওয়ার আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ অবস্থান ও ভঙ্গুরতা সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অজ্ঞাত ছিল, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। গত ১৬ বছর ধারাবাহিকভাবে বিরোধীদলের আন্দোলন দমনেই শুধু নয়, শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিবৃত্ত করতেও রাষ্ট্রশক্তির মাত্রাহীন ব্যবহার জনগণের প্রতিক্রিয়াকে ক্রমেই উত্তপ্ত করে তোলা হয়েছিল। ওরা হয়তো মনে করেছিল, রাষ্ট্রশক্তি আর সিসার বুলেট দিয়েই তারা আরো অনেকদিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। জনগণের শক্তি ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে হিসাবের গড়মিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও পরবর্তি রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইন্ডিয়ান হেজিমনিক এজেন্ডার আওতায় বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ নিয়ে ভারতীয় ডিপস্টেট নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। শেখ হাসিনা তার পরিবারসহ একাই দিল্লিতে পালিয়ে যায়নি, উপায়ান্তর না দেখে লক্ষাধিক নেতাকর্মীও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতারা দেশে তাদের কয়েক কোটি কর্মী-সমর্থকের দাবি করতো। সে সব কর্মী সমর্থক এবং দিল্লিতে থাকা শেখ হাসিনাকে নিয়েই বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে এখন ভারতীয় আধিপত্যবাদের নতুন গেমপ্ল্যান সাজানো হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বছর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর একবারের জন্যও শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের কারো মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি, দু:শাসন ও অসংখ্য মানুষের গুম-খুন, হত্যাকান্ড নিয়ে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। উপরন্তু বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক কিংবা বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে যে ধরণের ভূমিকা রাখার কথা, তা না রেখে শেখ হাসিনাকে দিয়ে একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য-বিবৃতি, সন্ত্রাসি কর্মকান্ডের নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপপ্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এটা অসম্ভব।

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থের প্রশ্নে একটি সাধারণ প্রস্তাবনায় সম্মতি হিসেবে জুলাই সনদ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় জরুরি রাষ্ট্রসংস্কার, গুম-খুন গণহত্যাসহ পতিত স্বৈরাচারের গুরুতর অপরাধের বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে অংশীজনদের টালবাহানা, সময় ক্ষেপণ এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক ধরণের অনিশ্চয়তা ও ব্লেইম গেমকে বিভাজন-বিভক্তির নতুন রেডলাইন হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেড় দশক ধরে সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বকে ছাপিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র সমন্বয়কদের আহ্বানে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) অনেকে তাচ্ছিল্য অর্থে কিংস পার্টি বলে অভিহিত করছেন। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার অভিপ্রায়ে অনির্বাচিত প্রক্রিয়ায় দেশে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সরকারে অভ্যুত্থানের নায়কদের প্রতিনিধিত্বসহ বাড়তি পক্ষপাত থাকা অস্বাভাবিক নয়, সে অর্থেই এনসিপিকে কিংস পার্টি অভিহিত করে কিছুটা শ্লেষ ঝাড়ছেন অনেকে। দলটি এখনো নিবন্ধন পায়নি, বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবকে ছাপিয়ে গণভিত্তি ও জনসমর্থন পাওয়া অত সহজ ব্যাপার নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এনসিপির দেশব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচি গোপালগঞ্জে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে এনসিপির কোনো বাড়তি আড়ম্বর বা প্রস্তুতি ছিল না। তবে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নির্দেশে গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতার হত্যার যে ব্লু প্রিন্ট করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে গোপালগঞ্জসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত ও ঐকবদ্ধ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ মুজিবের মাজার ভাঙ্গার ভীতি ছড়ানো হয়। শেখ হাসিনার নির্দেশে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন এবং আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা সারাদেশ থেকে সশস্ত্র আওয়ামী ক্যাডারদের গোপালগঞ্জে জড়ো করে এনসিপির সমাবেশে তা-ব সৃষ্টি করা। নির্দেশ ছিল, নাহিদ, হাসনাত, সার্জিসসহ এনসিপি নেতাদের হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিত্রনাট্য মঞ্চস্থ করার। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগেই এ সম্পর্কিত তথ্য জানতে পারেনি, এমন ধারণা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রকারিদের কোনো যোগসাজশ ছিল? অথবা সরকারের অভ্যন্তরে থাকা কোনো স্বার্থান্বেষী মহল কি এমন একটি অঘটন ঘটিয়ে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল? পথে পথে আক্রমণের শিকার হওয়ার পরও কেন এনসিপি নেতাদের হেলিকপ্টারে উদ্ধার না করে সেনাবাহিনীর এপিসিতে করে পার করা হলো, এসব প্রশ্ন আরো অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পর গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে সারাদেশ থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের জড়ো করে বল্গাহীন মেহেম পরিস্থিতি সৃষ্টির নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে। ওরা তাদের কৃতকর্মের জন্য মোটেও অনুতপ্ত নয়, তারা ক্ষমা চাওয়ার বদলে আরো হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার পরিকল্পনা সাজিয়ে আরো ভয়ঙ্কররূপে ফিরে আসার হুমকি দিচ্ছে। যদিও দেশের পারিপার্শ্বিক সামিাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর ন্যুনতম সম্ভাবনা নেই। তথাপি দেশি-বিদেশি একটি চক্র অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন ও সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে পুরনো বিভাজনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জারি রাখতে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা পক্ষ নয়, বাংলাদেশের প্রধান শত্রু বিভাজনের রাজনীতি ও অস্থিতিশীলতা। দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ একই ধর্মে বিশ্বাস করে এবং তারা প্রায় সকলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। অভিন্ন জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, অর্থনৈতিক সংস্কৃতি ও জীবনাচারে বিশ্বাসী মানুষের এই দেশে কোনো বিভাজনের রাজনীতি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কোটি কোটি মানুষের একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠিকে মিথ্যা বয়ানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে দেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং জাতীয় ইতিহাসকেও বিকৃত করা হয়েছে। সে সব মিথ্যা বয়ান ব্যবহার করে ১৮ কোটি মানুষের উপর ফ্যাসিবাদের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে, গুম,-খুন, গণহত্যাসহ জনগণের সম্পদ লুটপাট করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সেই দুঃসহ সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে চরম প্রত্যাঘাত। জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে, ভিন্ন ছদ্মাবরণে নতুন রূপে বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে আসার পথ চিরতরে বন্ধ করা। এর প্রধান পন্থা হচ্ছে, পুরনো ন্যারেটিভ ব্যবহার করে বিভাজনের রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে বিরত রাখা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনকে অস্বীকার করে কেউ এদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। যারা আমাদের সেই গৌরবজনক অর্জনকে ছিনতাই করে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাস লিখেছে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভে বাংলাদেশে অনন্ত বিভাজনের রাজনীতি জারি রাখতে সাংস্কৃতিক হেজিমনি ব্যবহার করেছে। চুয়াত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐকবদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নিতে মুুক্তিযুদ্ধের অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। জাতিসংঘের ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। এমনকি পাকিস্তানের সাথে বৈরিতা ভুলে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টুকে ঢাকায় দাওয়াত দিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। এটি ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী স্বার্থের জন্য চরম হানিকর। বিভাজন ও শত্রুতা টিকিয়ে রেখে আধিপত্যবাদী স্বার্থ হাসিল করাই ভারতের নীতি। বিভাজনের পুরনো ন্যারেটিভ ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বিরুদ্ধে তারা সদা সক্রিয়। প্রতিটি জাতিগত সংঘাত, যুদ্ধ এবং গণবিপ্লবের পর সমাজে ও রাজনীতিতে এর প্রবল প্রতিক্রিয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর একটি জাতীয় ঐক্য তথা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসহ বিভাজনের রাজনীতি চিরতরে শেষ করার উদ্যোগ জরুরি ছিল। স্বাধীনতার চারদশক পেরিয়ে এসে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে, জাতির কলঙ্ক মোচনের নামে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার পথ বেছে নিলেও এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতির কাঁেধ জুডিসিয়াল কিলিংয়ের মত অবিচারের কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অর্ন্তবর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একটি সনদ বা ন্যাশনাল চার্টার গ্রহণের উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছাড়াও আরো কয়েকটি সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে চুয়ান্ন বছরের অনিষ্পন্ন অনেক ইস্যুর আইনগত সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এই ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের অমিমাংসিত ইস্যুসহ দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, শ্রীলঙ্কাসহ গৃহযুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতায় জাতীয় ঐক্যের ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশনের পূর্ণাঙ্গ উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। শেখ হাসিনা ও তার দোসর-অলিগার্কদের বিচার হতেই হবে। সেই সাথে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী ও সমর্থক ফ্যাসিস্ট রিজিমের সুবিধাভোগী নয়, যারা হাসিনার কর্মকা-ের দায় নিতে চান না, তাদেরকে রাজনীতির মূল ধারায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে বৃহত্তর পরিসরে ন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তা নাহলে, ভারতীয় নীলনকশায় পঞ্চম বাহিনী রূপে দেশে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা কখনো বন্ধ হবে না।

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews