আমার ছোটবেলার হিরো কিংবা আইকন বলতে যাকে বুঝায় তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানার স্রষ্টা কুয়াশা সিরিজের লেখক, সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কিংবা বাংলা পেপারব্যাক প্রকাশনার পথিকৃৎ তিনি। তিনি একটি রহস্য পত্রিকা বের করতেন। আমরা ছোটবেলায় সেই পত্রিকার ভক্ত ছিলাম। কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন খুব নিভৃতচারী। তার দেখা পাওয়া ছিল খুব মুশকিল। তাকে কোথাও দেখা যেত না। তিনি রেডিও টিভি পত্র পত্রিকায় সাক্ষাৎকারও দিতেন না। অকারণে কোথাও বক্তৃতা দিতেন না। যতক্ষণ সচেতন থাকতেন ততক্ষণ কাজ করতেন। লিখতেন, সেই লেখা সম্পাদনা করতেন। তিনি নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছিলেন। লেখকের সঙ্গে পাঠকের মেলবন্ধন কীভাবে করা যায় সেই ভাষা তিনি তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশকে তুলে ধরতেন তার এডভেঞ্চার থ্রিলার কাহিনি লেখার ভেতর দিয়ে। এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম কাজী আনোয়ার হোসেন। অনেক উন্মাষিক লেখক আছেন যারা তাকে লেখক হিসেবে মানতে রাজি নন। কাজী আনোয়ার হোসেনকে তারা একজন বাণিজ্যিক লেখক মনে করেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন কমিটেড লেখক। তিনিও একটা আদর্শকে সামনে রেখে মাসুদ রানা লিখতেন।

বইগুলো যেন বিক্রি হয় সেই চেষ্টা করতেন। তিনি বইয়ের মার্কেটিং বুঝতেন। কারো সঙ্গে তার মিল নেই। তিনি সেগুনবাগিচায় তার পৈতৃক বাড়ির অফিসে বসে লেখালেখি করতেন। কাজ করতেন। অদ্ভুত অদ্ভুত শখ ছিল তার। গানও গাইতেন। তার কিছু গান জনপ্রিয় হয়েছিল ষাটের দশকে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে খুব ভালোবাসতেন। বেহালা বাজাতেন। গিটার বাজাতেন আর প্রচুর পরিমাণে ইংরেজি থ্রিলার পড়তেন। বিচিত্র এক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। নিজেও ছিলেন রহস্যে ঘেরা চরিত্রের ব্যক্তি। মাসুদ রানা রহস্য কাহিনি যেমন লিখতেন তেমনি তার নিজের জীবনও ছিল রহস্যে ঘেরা। সেবা প্রকাশনী এর অর্থ হচ্ছে সেগুনবাগিচা প্রকাশনী। আমরা সেগুনবাগিচার এই বাড়িটির সামনে দিয়ে যতবার গিয়েছি মনে মনে ভেবেছি এই বাড়িতে গিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন-এর সাথে সাক্ষাৎ করে আসি। আমরা জানতাম তিনি নিয়ম নিষ্ঠ মানুষ। কোনো অনুমতি ছাড়া হুট করে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। তিনি সময় দিলে সেটা আবার মেইনটেইনও করতেন। একসময় তার সেবা প্রকাশনী একটা ইন্ডাস্ট্রিজের মতো হয়ে গেল। এখান থেকে ছোটদের জন্য মাসুদ রানা, কুয়াশা ছাড়াও বড়দের জন্য রহস্য পত্রিকা, ছোটদের জন্য কিশোর পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। এসব পত্র পত্রিকা ছোটদের শুধু নয় বড়দেরও ভীষণ প্রিয় ছিল। এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক্স-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ বের করতেন। সংকলন বের করতেন নানা রকমের। এই সমস্ত কাজ নিয়েই তার দিনে কেটে যেত।

আমরা তার কাজের মাধ্যমেই তাকে চিনতাম। কিছু কিছু জায়গায় তার ছবিটা আমাদের এখনও প্রাণিত করে। উজ্জ্বল চেহারা, খাড়া নাক, ছোট ছোট চুল, সরু ফ্রেমের একটা চশমা পরে থাকতেন। দেখেই বোঝা যেত জাগ্রত অবস্থায় তিনি নানা ধরনের কাজের মধ্যে নিয়োজিত থাকতেন। চ্যানেল আই শুরু করার পরে আমরা কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তিনি কিছু লেখা নাটক করার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন তার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুর-এর সহায়তায়। শেষের দিকে জানতে পেরেছিলেন আমি তার একজন প্রচ- ভক্ত। এরপর থেকে বই প্রকাশিত হলে নিজে ফরিদুর রেজা সাগর-নামে সই করে বইগুলো পাঠাতেন। আমিও খুব যতœ করে সেসব বই সংগ্রহ করে রাখতাম। অনেক সময় বইয়ের মধ্যে কিছু কথাও কাজী আনোয়ার হোসেন লিখে দিতেন। সেগুলো আমি ফ্রেম করে রেখে দিয়েছি কারণ এটা আমার জীবনের বিরাট বড় অর্ঘ্য। অনেক বড় প্রাপ্তি।

১৯ জুলাই কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্মদিন। অনেকটা নিভৃতেই তার জন্মদিন চলে যায়। লেখকরা কিংবা লেখকদের কোনো সংগঠন তাকে ঠিক তেমন স্মরণও করে না। একাই তিনি স্বপ্ন দেখতেন একাই নানা রকম কাজ করতেন। তিনি ভিড় এড়িয়ে চলতেন। নিজেকে তিনি তুলে ধরেননি। নিজের খ্যাতিকে ব্যবহার করতে দেননি কাউকে। সব মিলিয়ে অবাক হয়ে ভাবি এরকম কর্মবীর একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করলেন। তার মাসুদ রানা এক অমর সৃষ্টি। যে কেউ বিশ্বাস করবেন তার এই সৃষ্টি অমর। মাসুদ রানার মৃত্যু নেই। যত রকম রহস্যময় চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে মাসুদ রানা তার মধ্যে প্রধান। সেই মাসুদ রানার ¯্রষ্টা কাজী আনোয়র হোসেন যাকে আমরা প্রচ- শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। কাজী আনোয়ার হোসেনও মাসুদ রানার একটি প্রতিরূপ। কে মাসুদ রানা, কে কাজী আনোয়ার হোসেন সেটা আমরা ভুলে যাই। মিশে যাই দুটো চরিত্রের ভেতর। কাজী আনোয়ার হোসেনকে আমি যতটা না কাজী আনোয়ার হোসেন ভাবি তার চেয়ে তাকে আমার মাসুদ রানা ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। মাসুদ রানা বাঙালির হৃদয়ে ভালোবাসায় বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। মাসুদ রানার মতো রহস্যময় মানুষ কাজী আনোয়ার হোসেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews