জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসের আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি হলো, তা জানাতে সংবাদ সম্মেলনে আসছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
শুক্রবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এ সংবাদ ডেকেছে কমিশন।
প্রথম ধাপের ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গেল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সভাপতি হিসেবে আছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, আর সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন আলী রীয়াজ।
প্রাথমিক কাজ গুছিয়ে দলগুলোর সঙ্গে মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দুই ধাপের সংলাপ করে কমিশন।
দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে সেদিন আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও দলগুলোর মতামততের ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ‘ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে।
সবশেষ ৩ অগাস্ট সংসদ ভবনের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সভা হয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য হওয়া নানা বিষয় পর্যালোচনা করেন কমিশনের সদস্যরা।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলোর বিষয়ে কমিশন পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বসবে।
তিন অগ্রাধিকার সরকারের
ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। শুরু হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা কর্মকাণ্ডেরও বিচারও।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অধ্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে।
“আজ থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু; এর প্রধান কাজ নির্বাচন সুন্দরভাবে করা।”
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার এ বার্তা তুলে ধরে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনের বাইরে আরও দুটি প্রাথমিক কাজের মধ্যে রয়েছে সংস্কার। সংস্কার ও জুলাই সনদের বিষয়ে, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে শুক্রবার অগ্রগতি তুলে ধরবেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি।
ঐকমত্য কমিশনের সাড়ে পাঁচ মাস
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।
এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়।
এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রথম পর্বে ঐকমত্যে ৬২ বিষয়, দ্বিতীয় পর্বে ১৯
মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়।
মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। কিছু দলের সঙ্গে হয় একাধিক বৈঠক।
প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সংসদ ভবনের এলডি হলে শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা উদ্বোধন করে কমিশন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ১৯-২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়।
আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন চলে এ আলোচনা।
ঐকমত্য যেসব বিষয়ে
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নির্ধারণ
৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান
৫. উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর
৬. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ
৭. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা
৮. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]
১০. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার
১১. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়
১২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
১৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব
১৪. সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন
১৫. নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত;
১৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি;
১৭. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব;
১৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি।
১৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পদ্ধতি
নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে
ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর ’ভিন্ন মতের’ (নোট অব ডিসেন্ট) এর কথা তুলে ধরে শেষ দিনের বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, ”নারীদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট এসেছে৷
”রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ-মার্কসবাদী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি নোট অব ডিসেন্ট প্রদানসহ সভা বর্জন করে। এছাড়া এ বিষয়ে গণফোরামের প্রতিনিধি এই বিষয়ে ভিন্নমত প্রদান করলেও সভা বর্জন করেননি।“
কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টসহ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ সংস্কারগুলো হল-
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
২. নারী প্রতিনিধিত্ব
৩. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রীম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ
৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা
৫. সরকারি কর্মকমিশন, দুদক, সিঅ্যান্ডএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা
৬. উচ্চকক্ষ গঠন
৭. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি
৮. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব
৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বরের প্রস্তাবসমূহ
এবং
১০. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
বাকি ৫ কমিশনেরও আহ্বান
দুই পর্যায়ে ঐকমত্য কশিনের সংলাপে মতৈক্য হওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
গত নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত শ্রম, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, নারী ও স্বাস্থ্য খাতসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে সংলাপে আলোচনা হয়নি।
এসব কমিশনের সুপারিশ জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে মুহাম্মদ ইউনূসকে আহ্বান জানিয়েছেন কমিশনগুলোর প্রধানরা।
গণঅভ্যুত্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক, নারী ও সাংবাদিক প্রাণ দেওয়ার কথা তুলে ধরে পাঁচ কমিশনের প্রধানরা বলেছেন, তাদের আত্মত্যাগ থেকে যে আশা ও স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে, তা উপেক্ষিত হলে, ব্যাপক ‘হতাশা ও ক্ষোভের’ জন্ম দিতে পারে।
তাদের সুপারিশের আলোকে ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কারসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
৫ কমিশন প্রধানরা হলেন- শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান শিরীন পারভিন হক, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ।
তারা বলেছেন, জাতীয় সনদে গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংস্কারসমূহ অন্তর্ভুক্ত না হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতে তা ‘বাতিল বা উপেক্ষা’ করার সুযোগ পাবে।
সংস্কার: ঐকমত্যের বিপুল যজ্ঞ কী প্রসব করল
ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসবে কমিশন
মৌলিক সংস্কারে ১৯টিতে ঐকমত্য, ১০টিতে 'নোট অব ডিসেন্ট': আলী রীয়াজ
জুলাই সনদ: ঐকমত্য তো হচ্ছে, সবাই কি সই করবে?
দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার কমিশনের সুপারিশও জাতীয় সনদে চান ৫ কমিশনের
জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া: ২ বছরে 'পূর্ণ' বাস্তবায়নের 'অঙ্গীকার'