মাতৃভাষার মতো মধুর ভাষা আর কিছুই হয় না। ইহা কেবল বাংলা ভাষার জন্য নহে, সকল ভাষার জন্য প্রযোজ্য। ভাষাবিদদের মতে, পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় সাত সহস্রাধিক। কিন্তু আশঙ্কা করা হইতেছে যে, আগামী শত বত্সরের মধ্যে পৃথিবী হইতে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে প্রায় তিন হাজারের মতো ভাষা। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে রুদ্ধ করিয়া দিতে চাহিয়াছিল। তাহারা চাহিয়াছিল বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান বা আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তন করিতে। কিন্তু বাংলাকে আমাদের দামাল ছেলেরা রক্ষা করিয়াছিল জীবন দিয়া। বাংলা এখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। পৃথিবীর প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন। ইহার মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে ১২ কোটি এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে আরো প্রায় ২ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলিয়া থাকেন। সবচাইতে আনন্দের কথা হইল, ২০১০ সালে ইউনেস্কোর একদল ভাষাবিজ্ঞানীর দীর্ঘ গবেষণার পর পৃথিবীর সবচাইতে শ্রুতিমধুর ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পাইয়াছে বাংলা ভাষা। সেই তালিকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে রহিয়াছে যথাক্রমে স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষা। অথচ এই ভাষাকেই কিনা গলা টিপিয়া ধরিতে চাহিয়াছিল পাকিস্তানি দুঃশাসকেরা। সত্যিকার অর্থে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রক্ষার আন্দোলনই শেষাবধি বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, যাহার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলা কেবল বিশ্বের শ্রুতিমধুর ভাষাই নহে, ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। ইংরেজি, জার্মান বা ফরাসি, রুশ ভাষার সহিত যুক্ত রাষ্ট্রসমূহ এই ভাষাগুলির বিশ্বব্যাপী বিস্তার ও প্রয়োগ করিবার যেই সকল নীতি ও কৌশল গ্রহণ করিয়াছে, তাহার সামান্যতম উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করিতে পারি নাই। এমনকী দেশ স্বাধীন হইবার পর ৪৮ বত্সর কাটিয়া গেলেও আজও অফিস-আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয় নাই। এই একই কথা প্রতি বত্সর ফেব্রুয়ারি মাসে ভাঙা রেকর্ডের উচ্চারণ করিতে আমাদেরও খারাপ লাগে। ভবিষ্যতে আরো কতবার ইহা উচ্চারণ করিতে হইবে, আমরা জানি না। তবে ইহা জানি যে, কম্পিউটার প্রযুক্তি আসিয়া বাংলাকে সর্বস্তরে প্রবেশের পথ প্রসার করিতেছে। উহাকে যেকোনোভাবে আমাদের কাজে লাগাইতে হইবে। আর ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, সর্বস্তরে বাংলা চালুর অর্থ কোনোভাবেই ইংরেজি বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করা নয়। প্রতিযোগিতাময় এই বিশ্বে আমাদের অবশ্যই বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করিতে হইবে। কিন্তু নিজেকে, নিজের শিকড়কে অস্বীকার বা উপেক্ষা করিয়া তাহা কখনোই সম্ভবপর নহে।
কোনো ভাষাকে রক্ষার জন্য বাংলা এখন একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত, একুশে ফেব্রুয়ারি হইয়াছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশ আমাদের ঐক্যবদ্ধই শুধু করে নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হইতেও শিখাইয়াছে। আবুল ফজলের ভাষায় আমরাও বলিতে চাহি—একুশ মানে মাথা নত না করা। আমাদের এই গৌরব যাহারা দান করিয়াছেন, যাহারা অন্তরে লালন করিয়াছেন, নেপথ্যে ভূমিকা রাখিয়াছেন, তাহাদের জন্য রহিল অশেষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।