বছর ঘুরে শীত আসে। আর এই শীতের সবজি হিসেবে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে নাপা শাকের বিকল্প নেই। এই নাপা বা লাফা শাকের পেল্কা এই এলাকার মানুষের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। সেইসাথে সিঁদল ভর্তা খুবই জনপ্রিয়। যা দেখলে জিভে (জিহ্বা) অনেকের মুখে পানি আসে।
সীমান্তবর্তী উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মানুষের সবচেয়ে মুখরোচক ও জনপ্রিয় তরকারি এক ধরনের গাছ নাপা বা লাপাশাক নামে পরিচিত। এটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যালোভা পারভিফ্লোরা। উদ্ভিদটির উৎপত্তি চীন দেশে হলেও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার মহাদেশের অধিকাংশ দেশে এই উদ্ভিদটির চাষ করা হয়। তবে স্থানীয়ভাবে নাপা, লাপা, লাফা ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
বালিয়াডাঙ্গীর কৃতি সন্তান ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মো: তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই শাকের ইংরেজি নাম হলো ম্যালো পাতা। এই এলাকার মানুষের প্রিয় ও সুস্বাদু একটি খাবার। এটা সহজেই আবাদ হয়। নাপা শাকের অনেক ভেজষ গুণও রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়াও বাড়ির পাশে অল্প জমিতে শাকের বীজ ফেলে জৈব সার দিয়ে এই শাক ফলানো যায়। এতে কৃষকের তেমন বড় ধরনের খরচ হয় না। সেচ, নিড়ানী দিলেই ভাল ফলন পাওয়া যায়। উত্তরাঞ্চলের বাজরে চাহিদাও যতেষ্ট। এটি একটি শীতকালীন সবজি। নাপা নামক উদ্ভিদটি বাংলাদেশ এবং ভারতে এটি শীতকালীন সবজি হিসেবে কৃষকেরা আবাদ করে থাকে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়। বর্ষাকাল ব্যতিত প্রায় সারা বছর এটির চাষ করা যায়। বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম প্রভূতি জেলার কৃষক এ ফসলের আবাদ করে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি আবাদ করা হয় ঠাকুরগাঁও জেলাসহ রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে। কারণ এ উদ্ভিদটি আবাদ করার জন্য শীতকালীন আবহাওয়া, কম পরিমাণ সেচ, অম্লীয়, ক্ষারীয় এমনকি নিরপেক্ষ জমিতে এর ফলন খুব ভালো হয়। এছাড়া বেলে এবং বেলে দোঁ-আশ মাটিতেও এ উদ্ভিদের চাষ করা যায়।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, লেবাননের মানুষ এই শাকের পাতা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। নাপা শাকের পাতা ও ডাটি দিয়ে চা তৈরী করে পান করেন তারা। এই শাক আঠালো এক ধরনের পদার্থ বহন করে। এজন্য বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে চর্মরোগ, হাঁপানী ও ডায়াবেটিস রোগের কার্যকরী ঔষুধ। নাপা শাক মালভা গণের মালভেসি পরিবারের একটি সপুস্পক উদ্ভিদ যার পাতা ও গাছের কচি ডগা বা পাতা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এই শাক লাফা শাক নামে অনেকের কাছে পরিচিত। লাফা শাক এশিয়াসহ পৃথিবীর সর্বত্রই জন্মে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতে এটি প্রধানত শীতকালীন সবজি হিসেবে চাষ করেন কৃষকরা। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার ও আসামের গোয়াল পাড়া এলাকায় চাষ করা হয়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মানুষের মুখে মুখে এখন লাফা শাকের গল্প শোনা যায়।
তিনি বলেন, নাপা শাক এক বর্ষজীবী দ্বিবীজপত্রীক ও সপুষ্পুক উদ্ভিদ। এর গাছ ৩০-৩২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা বা উঁচু হয়। পাতা গোলাকার ও সবুজ, হালকা লালচে রঙের হয়ে থাকে। এই শাক ভাজি, ঝোল ও পেল্কা বা খাটার জন্য বিখ্যাত।
আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, এ উদ্ভিদের বীজে বিদ্যমান পলিস্যাকারাইড রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে। শুধু তাই নয় ক্যান্সার কোষ গঠন প্রতিহত করতে এ উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার প্রয়োগ করে আবাদ করা নাপা শাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই জৈব সার প্রয়োগ করে এ উদ্ভিদ আবাদ করা হলে এ ধরনের সমস্যা দূরীভূত করা যেতে পারে। বর্তমানে এ শাক বাজারে প্রায় ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আবার একর প্রতি স্বল্প খরচে, অল্প সময়ে এ উদ্ভিদের চাষ করা সম্ভব হওয়ায় কৃষকেরা এ উদ্ভিদ আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
পাশাপাশি, উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় বতুয়া শাকও খুবই একটি জনপ্রিয় শাক। পেলকার সহযোগী উপকরণ হলো বতুয়া শাক। বতুয়া ছাড়া পেল্কা মজাদার হয় না। এছাড়াও, এই অঞ্চলে পাট শাকের ভাজি, ঝোল ও খাটা খেতে খুবই মজা।
অন্যদিকে, পুঁইশাক, কচুর পাতা ও সজনি শাকের পাতার পেল্কা একটি ঐতিহ্যবাহী ও মজাদার খাবার হিসেবে এই জনপদের মানুষের কাছে অতি প্রিয়। কচু পাতার ভর্তা আরো মজাদার একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের নাগেস্বরবাড়ী গ্রামের কৃষক তরুণী শীল (৫৫) বলেন, ‘হামরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখিছি বাবার ঘরে বাসি পেল্কা আর বাসি ভাত পেট ভরে খ্যায়া হাল ধরি যায়। পাকা এক দুপর হাল বয়া আইসে খিদায় নাগে না। এটা হামার (আমাদের) কৃষক মানুষের জন্য মজার খাবার।’
তিনি আরো বলেন, ‘নাপা শাকের সাথে সিঁদলের ভর্তা হলেতো কথাই নাই। এক থালি (থালা) ভাত আর পেল্কা হলে কিছুই নাগে না।’
দুওসুও জিয়াখোর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম (৫৮) বলেন, ‘এলাতো মাইনষের নানান অসুখ হয়। ডায়াবেটিস কি মুই এখনো জানি না। হামরা পেল্কা খাওয়া মানুষ হামারতো পেশার হয় না। মাইনশের বেলে চুলকানী হয়, কই হামারতো হয় না। গোটাল শীতখান নাপা শাকের ঝোল, কাঁচা মরিচ, বাসি ভাত আর পেল্কা খাই। হামার হাঁপানী ডাইবেটিস কোনই হয় না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন সোহেল বলেন, ‘চলতি মৌসুমে শাক-সবজির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক হাজার ৩২০ হেক্টর। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে এক হাজার হেক্টর। উপজেলায় নাপা শাকের প্রচুর আবাদ হয়। এলাকার মানুষের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করছেন। বাজারে বেচাকেনাও ভাল হয়। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকেরা।