অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় সপ্তাহ পার হতে চললো। হিসেব অনুযায়ী তিন হাজারের বেশি বই প্রকাশ হয়েছে মেলাকে ঘিরে। এখনও প্রতিদিন বই আসছে। উৎসব পার্বণের মতো প্রতিবছর বইপ্রেমী মানুষ এই একটি মাসের জন্য অপেক্ষা করেন। ছেলেবেলায় পাওয়া নতুন বইয়ের ঘ্রাণের মতো এও এক নতুন সুবাস যেন। বইমেলা এখন আর শুধু বই প্রকাশ, বই কেনাবেচা বা লেখক প্রকাশক বা পাঠকদের দেখা হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বইমেলা এখন পরিণত হয়েছে জাতীয় উৎসবে। প্রতিটি উৎসবে যেমন মানুষ যান কারণে বা অকারণে, অনেকে তেমনি বইমেলায়ও আসেন কারণে বা অকারণে। ঠিক এই জায়গায় যেন কিছুটা আপত্তি ওঠে। কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয়। কিছুটা দ্বিধা এসে ভর করে। আমরা কি পাঠক হারাচ্ছি বা নতুন পাঠক তৈরি হচ্ছে না বা মানুষ বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। গেলো তিন সপ্তাহে বইমেলায় প্রায় প্রতিদিনই বলতে গেলে গিয়েছি। একটা বিষয় বেশ ভালো লেগেছে, সাজানো গোছানো বইমেলায় যারা ঢুকছেন তারাও বেশ পরিপাটি। ওই যে বললাম বইমেলা এখন পরিণত হয়েছে মিলন মেলায়। সেখানে মানুষ বই কিনতে আসেন, বই নাড়াচাড়া করেন। বই নিয়ে কথা বলেন।

খোঁপায় গাঁদা ফুলের মালা আর শাড়ি পরে মেলায় আসেন তরুণীরা। মেলায় তরুণপ্রাণ যেন বেশি। বন্ধু বান্ধবীরা ঘুরছেন। জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছেন। কিন্তু সে তুলনায় বই কিনছেন কম। এটা যে শুধু প্রকাশক বা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তা নয়। যারা নিয়মিত বইমেলায় যান তারা একটু লক্ষ্ করলে দেখা যাবে, বইমেলায় যারা ঘুরছেন, বিশেষ করে ছুটির দিনে তো এত ভিড় হয় যে ভেতরে ঢোকাই দায়। ধুলো ওড়ে রীতিমতো। কিন্তু বেশিরভাগেরই হাতে কোনও বই নেই। এটা অবশ্যই আফসোসের কথা। বিশেষ করে রাত নয়টায় যখন বইমেলা প্রতিদিনকার মতো শেষ হয় বা তারও আগে বের হওয়ার গেটের সামনে দাঁড়ালেই দেখা যায় বেশিরভাগই ফিরছেন খালি হাতে। তার মানে কি এই দাঁড়িয়েছে, তরুণরা বা আমাদের সমাজের একটি অংশ বইবিমুখ হয়ে পড়েছে। নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যুগে তারা ই-বুকে বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। যদিও বই হাতে পড়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা ই-বুকে নেই। তারপরও ই-বুক পড়লেও ধরে নেওয়া যেত কিছু না কিছু পড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, ই-বুকও নয়, তারা পড়ছে ফেসবুক। মেলায় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন ঢোকেন তখন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। সম্ভবত লেখক হুমায়ূন আহমেদের পর জাফর ইকবালের পেছনে এমন দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। তবে ওনার ভালো দিক নির্দিষ্ট কোনও স্টলে উনি বসেন না। গাছের ছায়ায় বসে অটোগ্রাফ দেন। এবার দেখলাম উনিও একটি বিষয় নিয়ে বিরক্ত। আর সেটি হচ্ছে সেলফি তোলা। অনেকে বই কিনছেন না, সেলফি তুলছেন আর ফেসবুকে আপলোড করছেন। এটা যে শুধু ওনার ক্ষেত্রে ঘটছে তা নয়। বেশিরভাগ লেখকের ক্ষেত্রেই ঘটছে। একজন পাঠক বা ভক্তের লেখকের সঙ্গে সেলফি তোলার বাসনা থাকতেই পারে কিন্তু সেটা যখন বইমেলায়, তখনই একটু চিন্তিত হতে হয়। বই না কিনে শুধুমাত্র সেলফি তোলা কিছুটা বেমানান বৈকি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের বই যেদিন প্রকাশ হলো সেদিনও একই ঘটনা। অনেক দূর থেকে কোণায় একটু সাকিবকে দেখা যাচ্ছে, সেটা সেলফিবন্দি করতে পারলেই হলো! হাজার হাজার মানুষ মানে হাজার হাজার মুঠোফোন। হোক না সেটা নতুন বা পুরাতন। লেখক, প্রকাশকের বাইরে নিজেরা নিজেরা সেলফি তুলছে আর ফেসবুকে আপলোড করছেন। বইমেলা বলেই বিষয়টি মন্দ ঠেকছে বৈকি! আগে পাঠকরা স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়াতেন বইয়ের ক্যাটালগ সংগ্রহের জন্য। তারপর শেষের দিকে এসে বই কিনতেন। এখন তেমনটি কমই চোখে পড়ে। কিছুদিন আগে শেষ হলো বাণিজ্যমেলা। সেখানে কিন্তু ছিল বইমেলার বিপরীত চিত্র। সেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকিটের ব্যবস্থা ছিল। আবার ভেতরে গিয়ে কিছু না কিছু কিনছেন। যিনি বেশি কিছু কিনতে পারছেন না তিনি আসার সময় অন্তত প্লাস্টিকের একটা সামগ্রী নিয়ে আসছেন।

বইমেলায় এখন নানা শ্রেণির লেখক-পাঠক আসেন। ভালো মান, নিম্ন-মান, রুচিশীল, রুচিহীন বইয়ের অভাব নেই। অনেকেই বলছেন, এখন পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি। যিনি কথা বলতে পারেন না তিনিও একটি বই প্রকাশ করে ফেলছেন। বলতে পারেন বই তো কথা বলার নয়, লেখার বিষয়। তাও বটে! কিন্তু যেটা মুখে আসবে না সেটা কীভাবে হাতের লেখনীতে প্রকাশ পায়।

প্রতিবার বইমেলার আগে বা বইমেলার মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কোনও বই নিষিদ্ধ হয়, স্টল বন্ধ হয়, লেখক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বা খুন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এবার অবশ্য তেমন কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি বলে আশার কথা। অবশ্য ঘটার কথাও নয়। লেখকদেরও এখন নিজস্ব সেন্সরের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনারই বলেন, অনুভূতিতে আঘাত করে কিছু লেখা বা প্রকাশ করা যাবে না। তার মানে লেখক নিজের মতো করে লিখতে পারবেন না। তবে একটা সময় ছিল মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীল এবং অশালীন ব্যবহার, গায়ে হাত দেওয়া, ধাক্কাধাক্কির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। আশার কথা, এটা এখন অতীতের বিষয়। এই কলঙ্কের ভার এখন আর কাউকে বইতে হয় না।  আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে এসেছে সুব্যবস্থা। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা যে আত্মসচেতন হয়েছেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সাথে সাথে এও বোঝা যাচ্ছে, বই কেনার চেয়ে বেড়েছে সেলফি রোগ।

এই বিষয়েও রাষ্ট্রের সচেতনতা তৈরির দায়িত্ব রয়েছে। কী করলে মানুষ বইমুখো হবে সেটা ভাবতে হবে। শিশুকাল থেকে পড়ার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুকে মুঠোফোনে গেম খেলার দিকে ঝোঁক না বাড়িয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে বইয়ের সঙ্গে। স্কুল-কলেজে পাড়ায় পাড়ায় বই পড়াকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে নিতে হবে। আনন্দের জন্য পড়া বলে যে একটি বিষয় রয়েছে তা যেন শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এখন খোলা আকাশ, খোলা জানালা। এই উন্মুক্ত বাতায়নের যুগে ভালোর পাশাপাশি মন্দ ঢুকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা মানুষের মনন গড়ে দিতে পারে ভালো বই। কবি যে বলেছেন, প্রিয়ার চোখ ঘোলাটে হবে, রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু একটি ভালো বই সে তো অনন্ত যৌবনা। কাজেই একটি মাসের বইমেলা নয়, পুরো এগারো মাস ভাবতে হবে বই নিয়ে। তাহলেই অনেক কিছু করা সম্ভব। শুধু বইমেলায় এলাম, সেলফি তুললাম সেটি নয়। সেলফি তুলুন, সঙ্গে হাতে একটি বই নিন স্টল থেকে। যে কোনও বই, যেটা আপনার ভালো লাগে। তারপর সেটি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরুন। অন্তত একটি বই কিনুন। আনন্দের সাগরে ডুব দেওয়ার শুভ সূচনা করুন। 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews