বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর শাহজাদপুরে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. নাঈমুর রহমান। মিরপুরে গুলিতে মারা যান যুবদলকর্মী মহিউদ্দিন ও দিনাজপুরে রবিউল ইসলাম রাহুল। তাদের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুধু নাঈমুর, মহিউদ্দিন ও রবিউলই নয়, আন্দোলনে গুলিতে নিহত বেশির ভাগেরই ময়নাতদন্ত হয়নি। ফলে হত্যা মামলাগুলো তদন্তে দেখা দিয়েছে জটিলতা। আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতেও কালক্ষেপণ হচ্ছে। ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। দেশকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করার আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যায় এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৬০০ মামলা হয়েছে। খুনিদের বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন নিহতের স্বজনরা। ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন হয়েছে এমন ২২টি হত্যা মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মামলার তদন্তে নেমে খেই হারিয়ে ফেলছেন পুলিশের সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত সম্পন্ন করতে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন নিহতের স্বজনরা। অনেক স্বজন বলছেন, লাশ যদি তুলতেই হয় তাহলে মামলা চালাব না। ফলে কবে মামলার তদন্ত শেষ হবে তা জানেন না তদন্তকারীরা। কিছু কিছু মামলার ক্ষেত্রে ‘ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ নাই’ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব মামলা ফাইনাল রিপোর্টের দিকে যাচ্ছে।

পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেগুলার হত্যা মামলার ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হত্যা মামলার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত ছাড়া চার্জশিট দেওয়া যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়া আদালতে চার্জশিট জমা দিলে আসামিপক্ষ সুবিধা পাবে বলেও মনে করছেন অনেক তদন্ত কর্মকর্তা। একাধিক হত্যা মামলার তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, গুলিতে মারা গেছে উল্লেখ করে মামলা হয়েছে কিন্তু ময়নাতদন্ত করা যায়নি এমন মামলার চার্জশিট দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়া আমি কিভাবে নিশ্চিত হবো ভুক্তভোগী গুলিতে মারা গেছেন। সে ক্ষেত্রে ফাইনাল রিপোর্ট দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, এসব মামলার চার্জশিট দিলে পরবর্তীতে তদন্তসংশ্লিষ্ট সবাইকে বিপদে পড়তে হবে, তখন কেউ আমাদের দায়িত্ব নেবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, মামলাগুলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার অবকাশ নেই। তিনি বলেন, তদন্ত কার্যক্রমে যাতে কোনো ধরনের গ্যাপ না থাকে সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত মনিটরিং করছে।

ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের মামলার ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ নিয়ে তাকে (তদন্ত কর্মকর্তা) দেখতে হবে। এখানে তদন্তের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় আছে। একটি হচ্ছে, ঘটনা কী ঘটেছিল সেটা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, কারা ঘটিয়েছে সেটা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, চাক্ষুস সাক্ষী থেকে যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে মামলার তদন্ত সেভাবে আগাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে তদন্তে গ্যাপ থাকলে আসামিরা সুযোগ পাবেন বলেও মনে করেন তিনি। জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর শাহজাদপুরে বুকে গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী মো. নাঈমুর রহমান। তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তড়িঘড়ি করে লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে দাফন সম্পন্ন হয় তার। এ ঘটনায় নাঈমুরের বাবা খলিলুর রহমান বাদী হয়ে গুলশান থানায় ৬৪ জনের নাম উল্লেখসহ ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইনস্পেকটর নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাদীপক্ষ ময়নাতদন্ত করতে চাচ্ছে না। তাছাড়া এতদিন পর এখন ময়নাতদন্ত করে কোনো লাভও হবে না। এই মামলার ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে তিনি জানান, এভাবেই চার্জশিট দিয়ে দেবেন। তবে ময়নাতদন্ত ছাড়া চার্জশিট দিলে মামলা হালকা হবে এবং আসামিপক্ষ সুবিধা পাবে বলেও মনে করেন তিনি।

গত বছরের ৪ আগস্ট দিনাজপুর সদর থানা এলাকায় গুলিতে নিহত হন দিনাজপুর রাণীগঞ্জ কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম রাহুল। এ ঘটনায় দিনাজপুর সদর থানায় সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিমসহ ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর ইনস্পেকটর প্রদীপ কুমার রায় যুগান্তরকে বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়াই রবিউলের লাশ দাফন করা হয়। পরে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি রবিউলের পরিবার। চার্জশিটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত কী হবে এখনো বলা যাচ্ছে না।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের দিনে মিরপুর মডেল থানার বিপরীত পাশে গুলিতে নিহত হন যুবদলকর্মী মহিউদ্দিন (৩৫)। ময়নাতদন্ত ছাড়াই ভোলা সদরে গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে ডিএমপির মিরপুর মডেল থানায় ৩৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৬০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ইনস্পেকটর আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে মহিউদ্দিনের লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করতে চাইলে বাধা দেয় তার পরিবার।

ফলে ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এখন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেটা পাওয়া যাবে সে অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, এভিডেন্সের ওপর ভিত্তি করে ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্ট ছাড়াও হত্যা মামলা চলবে। এটার উদাহরণ হিসাবে বলতে চাই, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার বিষয়টি। ২১ বছর পরে এফআইআর ছাড়া একটি জিডির ওপর ভিত্তি করে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্ট কিন্তু ছিল না। তিনি বলেন, ছেলেরা যে গুলি খেয়ে মারা গেছে তার ফুটেজ আছে, ছবি আছে। বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভিতে সব কিছু ধারণ করা আছে। হত্যা তো হয়েছে-এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews