অনেক হট্টগোলর পর ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন সম্ভবত আরও দুই বছর পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ী মহল একরকম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের উত্তপ্ত বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে। কিন্তু এত ডামাডোলের মধ্যে যে ব্যাপারটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেল, তা হলো সরকার প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানোর চেয়ে পরোক্ষ কর আদায়েই বেশি তৎপর। অর্থাৎ রাজস্বের ভারটা নির্বিশেষে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকার কোত্থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। ভ্যাটের হার আগেরটা থাকলে সেটা আরও কঠিন হয়ে যাবে।

দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২০১৬ সালে ৭ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমাদের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বাড়ছে না, বরং তিন অর্থবছরে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৭৪ থেকে কমে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে নেমেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই হার ২০ থেকে ৩২ শতাংশ। বিনিয়োগ কম থাকা সত্ত্বেও পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ায় প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। কিন্তু রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত না বাড়ায় এটা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। এতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না।

অন্যদিকে আবার রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসছে পরোক্ষ কর, অর্থাৎ ভ্যাট থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ মাত্র ৫৪ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যদিও কিছুদিন আগে এটা ৩০ শতাংশের মতো ছিল। অথচ এনবিআরই বলছে, অনুক্রমিক করব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ অন্তত ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। এতে বোঝা যায়, আয়কর দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনো জোরালো নয়। গত বছরের বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর পাশাপাশি ২০২০-২১ সালের মধ্যে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের উদ্যোগ না থাকলেও পরোক্ষ কর ঠিকই বাড়ানো হলো। অর্থাৎ সামর্থ্যবান মানুষদের ছাড় দেওয়া হলো। আবার এই ভ্যাট বাড়ার কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, যেটা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাইকে দিতে হবে। ভ্যাটের বাছবিচার নেই, যেটা আয়করের ক্ষেত্রে আছে। আর জিনিসপত্রের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে গরিব মানুষকেই ভুগতে হবে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রিটার্নে ১১ হাজার ৬৭০ জন করদাতা সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন। রাজস্ব আইন অনুসারে, দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে আয়করের ওপর মূল্যভেদে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। হিসাব অনুসারে, সরকার এ বাবদ তাঁদের কাছ থেকে ৩৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। তবে এই হিসাবেও শুভংকরের ফাঁকি আছে। কারণ, সম্পদের ক্রয়মূল্যের ওপর সারা জীবন এই রাজস্ব দিতে হয়। এর মধ্যে সম্পদের দাম বাড়লেও তা হিসাবে নেওয়া হয় না।

দেশে এই পরিমাণ সম্পদের মালিক যে এর কয়েক শ গুণ বেশি, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে যে পরিমাণ বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে, তাতে ব্যাপারটা স্পষ্ট। ঢাকা নগরে বাড়ির মূল্য এক থেকে দেড় কোটি টাকার কম নয়। বহু মানুষের একাধিক বাড়ি বা প্লট আছে। তার সঙ্গে গাড়ির দাম যুক্ত করলে সম্পদের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়। আবার এই খবরও আমরা জানি, ঢাকা নগরের বহু বাড়ির মালিকই আয়কর দেন না। কর আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মধ্যবিত্ত পেশাজীবী ও সচেতন ব্যক্তিরা কর দিতে বেশি আগ্রহী। আয়কর মেলার সময় এটি দেখা যায়। যে দেশের শীর্ষ করদাতা একজন জর্দা ব্যবসায়ী, সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিরা যে কর ফাঁকি দেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। আবার দেশে কোম্পানি করের হার অনেক বেশি হলেও মোট রাজস্বে তার অনুপাত খুব বেশি নয়।

এনবিআরের কর্মকর্তাদের অসততার কারণেও রাজস্ব আদায় ব্যাহত হচ্ছে। এখানে আইন মেনে কাজ করতে গেলে উল্টো বিপদে পড়তে হয় ৷ একবার লেখকের এক বাল্যবন্ধু আয়ের ওপর যথাযথ হারে কর দিতে গিয়ে বিপত্তির মুখে পড়েন৷ রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীরা তাঁকে বলেন, ‘এত টাকা কেন কর দেবেন৷ আমাদের কিছু দেন, আমরা আপনার করের পরিমাণ অর্ধেক করে দেব৷’ কিন্তু প্রকৃত কর দিতে নাছোড়বান্দা হওয়ায় নানা ঘাট ঘুরে তাঁকে জুতার তলা ক্ষয় করতে হয়। অন্যদিকে, এমন অভিযোগও আছে, শহরের বড় রেস্তোরাঁ ও কাপড়ের দোকান ক্রেতাদের কাছ থেকে মূসক আদায় করলেও সরকারের কোষাগারে তা জমা দিচ্ছে না।

সরকার কয়েক বছর ধরে রুগ্ণ সরকারি ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে মূলধন জুগিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই টাকা রাজস্ব থেকেই দেওয়া হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ এই খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার বা খেলাপকারীদের শাস্তির আওতায় না এনে সরকার জনগণের করের টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখছে। জনগণের করের টাকা যে এভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে জনমত সৃষ্টিরও তোয়াক্কা করেনি সরকার। জনগণের করের টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হবে, তা নির্ধারণে তাদের মত নেওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস বলেছেন, এবার সরকারি ব্যাংককে যে দুই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে পাঁচ লাখ হতদরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসা সম্ভব। তাহলে আমরা কি ধরে নেব, সরকারি ব্যাংকগুলো রাখাই হয়েছে লুটপাটের জন্য?

যা হোক, এখন ভ্যাটের হার একই থাকলে সরকারের পক্ষে বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়ন করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। টাকা তো লাগবেই, সে যেখান থেকেই আসুক। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এ অবস্থায় সরকারকে হয়তো আবারও কঠিন শর্তে বিভিন্ন দেশ কিংবা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। এতে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে সরকারকে আয়করের পরিসর বাড়াতে হবে। যাঁরা সামর্থ্যবান হয়েও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের আইনের আওতায় এনে বকেয়াসহ সব আয়কর আদায় করতে হবে। তবে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন স্থগিত হলে সরকারের হাতে সুযোগ আসবে, তারা রাজস্ব নীতি পুনর্বিবেচনার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ পরোক্ষ কর বাড়াতে গিয়ে সরকার মহা ঝামেলায় পড়েছে, তো এবার তারা পরোক্ষ কর আদায় বাড়ানোর চেষ্টা করে দেখতে পারে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews