Mike Judge পরিচালিত Idiocracy সিনেমাটি ২০০৬ সালে মুক্তি পায়। প্রথম দর্শনে একে একটি হাস্যরসাত্মক কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক চলচ্চিত্র মনে হলেও, বাস্তবে এটি এক তীব্র রাজনৈতিক ব্যঙ্গ এবং সমাজতাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী। সিনেমাটি এক কাল্পনিক ভবিষ্যতের ছবি আঁকে, যেখানে মূর্খতা একটি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, এবং বুদ্ধিমত্তা, যুক্তিবোধ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জায়গা দখল করে নিয়েছে অজ্ঞতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী চিন্তা। পরিচালক অত্যন্ত চতুরভাবে প্রশ্ন তুলেছেন—যদি একটি জাতি নিজেদের শিক্ষা, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে অবহেলা করে, তাহলে এক সময় সেই জাতিই কীভাবে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ঠেলে দেয়। এই সিনেমা যেমন এক জাগতিক বিনোদন, তেমনি এটি এক সামাজিক সতর্কসংকেত—যার প্রতিটি দৃশ্য যেন এক গভীর আত্মবিশ্লেষণের ডাক।

আমাদের দুর্ভাগ্য, সিনেমার সেই ব্যঙ্গচিত্রে আঁকা “ভবিষ্যতের ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজব্যবস্থা” এখন আর কল্পনাবিলাস নয়—তা আজ অনেকখানি বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। এক সময়ের আদর্শ, সংগ্রামী এবং চেতনার ধারক জাতি আজ যেন অন্ধ নেতৃত্ব, সস্তা স্লোগান, জ্ঞানবিমুখ সিদ্ধান্ত ও আত্মতৃপ্তির আচ্ছাদনে ঢেকে গেছে। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে, শিক্ষানীতিতে, ভাষা-সংস্কৃতিতে এমন সব চরিত্রদের আধিপত্য বিস্তার করছে, যাদের নেই ইতিহাসচেতনা, নেই জাতির আত্মার সাথে কোনো সংলাপ। আজ বাংলাদেশে যেন আমরা Idiocracy-এর সেই কল্পিত ভবিষ্যতের এক জীবন্ত সংস্করণে বসবাস করছি—যেখানে নেতৃত্বের মাপকাঠি হয় গলার জোর, জনপ্রিয়তা মাপে গালির ভাইরাল সংখ্যা, আর রাষ্ট্রচিন্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে ‘কে কতটুকু দখলে রাখবে’ সেই প্রশ্নে।

এই বাস্তবতা সিনেমাকে কেবল একটি নিখুঁত ব্যঙ্গাত্মক প্রতীক করে তোলে না—বরং আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চরম উদ্বেগও ছড়িয়ে দেয়। আজকের বাংলাদেশে যখন আমরা চারপাশে দেখি শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ, যুক্তিবোধের জায়গায় আবেগের উত্তেজনা, আর সংস্কৃতির স্থানে বেহায়া রাজনৈতিক নাটক, তখন সিনেমার সেই কল্পিত পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের দেশের সাদৃশ্য ভীতিকরভাবে মিলে যায়। তখন এটি আর নিছক একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং হয়ে ওঠে আমাদের জন্য এক আয়না—যাতে আমরা আমাদের নিজেদের চেহারা দেখতে পাই।

Idiocracy সিনেমার শুরুতেই দেখানো হয়, কীভাবে গড়পড়তা বুদ্ধিসম্পন্ন দুইজন মানুষ, জো বাউয়ার্স, ও রিতা, সরকারি হাইবারনেশন একটি প্রজেক্টে অংশ নিয়ে ৫০০ বছর ঘুমিয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে জেগে উঠে তারা এমন এক সমাজে প্রবেশ করে, যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক যেন অবলুপ্তপ্রায়। শিক্ষা নেই, যুক্তি নেই, শিষ্টাচার নেই, আর রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে টেলিভিশনের এক কুস্তিগির প্রেসিডেন্ট—যার জ্ঞান ও ভাষা শিশুতোষ স্তরেরও নীচে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে Idiocracy সিনেমার ব্যঙ্গচিত্র যেন হঠাৎ করেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আজ এমনসব মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনার আসনে আসীন, যাদের নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ বা জাতির চেতনার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ কিংবা শ্রদ্ধা। আজ তারা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার লালসায় নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয় মুছে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য, ভাষা-আন্দোলন ও বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এমন একটি পরিকল্পিত ধোঁয়াশা তৈরি করছে, যেখানে জাতির চেতনাকে বিলুপ্ত করে এক বিকৃত ইতিহাস ও মূর্খ সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম করা যায়।

সিনেমা Idiocracy-তে যে ভবিষ্যতের নির্বোধ সমাজ চিত্রিত হয়েছে—যেখানে মানুষ শিক্ষার মর্যাদা ভুলে গিয়ে নিজেদের পতন নিজেরাই ডেকে এনেছে—বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা যেন সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ও প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে এমনসব উপদেষ্টাদের আধিপত্য ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে, যাদের মধ্যে শিক্ষা, শালীনতা, কিংবা বিচারবুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই। তারা রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে ফেলেছে—যেখানে এখন আর বোধবুদ্ধি নয়, বরং মিথ্যাচার, চাঁদাবাজি, হুমকি, গালিগালাজ ও জনতাকে উস্কে দিয়ে “মব জাস্টিস”-এর পন্থাকেই তারা দেখছে শ্রেষ্ঠ কৌশল হিসেবে।

এই নেতৃত্বের হাত ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতিচর্চা আজ এক চরম অবহেলার শিকার। এমন অনেক উপদেষ্টা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আছেন, যাদের ভাষা ও শব্দচয়ন বাঙালির চিরায়ত শালীনতা, ভদ্রতা এবং ভাষাগত সৌন্দর্যকে কলুষিত করছে। তারা শিক্ষাকে অবহেলা করে, জ্ঞানকে অপমান করে। ডিগ্রিকে ঠাট্টার বস্তুতে রূপান্তর করে তারা নতুন প্রজন্মকে এমন একটি সংকেত দিচ্ছে—পড়ালেখা করে কিছু হয় না, বরং রাজনীতির চাটুকারিতা, জোরাজুরি আর শ্লোগানই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

ফলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, দেখে রাজনৈতিক কর্মী হয়ে এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার, যাতে অল্প সময়ে গাড়ি, বাড়ি, ক্ষমতা, আর অর্থ সব কিছুই পাওয়া যায়। এটা এখন সফলতার নতুন সংজ্ঞা হিসেবে স্বীকৃত। এই ধারার মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এক ভয়াবহ প্রজন্ম, যাদের চোখে শ্রেষ্ঠত্ব মানেই বাহ্যিক চাকচিক্য আর শক্তি প্রদর্শন।

এই বাস্তবতা Idiocracy-এর আরেকটি দৃশ্যের প্রতিফলন। সিনেমায় দেখানো হয় ভবিষ্যতের পৃথিবী চলে এক কর্পোরেট দানবের ইশারায়—যেখানে এনার্জি ড্রিংক (Brawndo নামক একটি শক্তিবর্ধক পানীয়) -দিয়ে কৃষি জমিতে পানি দেয়া হয়। বাংলাদেশের চিত্রও আজ সেইরকম কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের অধীনে—যেখানে গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সমাজচিন্তা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতার প্রোপাগান্ডায় আচ্ছন্ন। যেখানে সত্যকে পণ্য করে তোলা হয়, আর মিথ্যাকে বিক্রয়যোগ্য ব্র্যান্ডে পরিণত করা হয়।

এই কর্পোরেট অপসংস্কৃতির প্রভাবে যুক্তিবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতা—সবকিছু ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের জায়গায় ঢুকে পড়েছে নিছক ভোগবাদিতা, আর জ্ঞানের জায়গা দখল করেছে সস্তা জনপ্রিয়তা।

যুবসমাজ আজ প্রযুক্তির দাসত্বে বন্দি—সারাদিন মোবাইল স্ক্রিনে মুখ গুঁজে ইউটিউব, টিকটক আর ফেসবুক রিলসে সময় নষ্ট করে তারা। তারা জানে না এই জাতির ইতিহাস কী, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি কী, মুক্তিযুদ্ধ কাদের রক্তে অর্জিত—জানতেও চায় না। সাহিত্য তাদের কাছে ক্লান্তিকর, বিজ্ঞান তাদের কাছে জটিল, আর যুক্তি তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়।

তাদের চোখে সফলতার মানে—ফ্যাশনের ব্র্যান্ড, দামি বাইক, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার আর রাজনৈতিক নেতার পাশে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি। সমাজের মূলধারার আলোচনায় এখন আর স্থান পায় না রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞা, নজরুলের দ্রোহ, জয়নুলের তুলির চিত্র, কিংবা বেগম রোকেয়ার চিন্তার দীপ্তি। বরং এখন আলোচনা ঘুরে বেড়ায়—“কারে ভাইস প্রেসিডেন্ট বানানো হবে?”, “কে কত বড় গালি দিলো লাইভে?”, “কে ভাইরাল হলো গালাগাল করে?”

এই সংস্কৃতি বিকারের চূড়ান্ত উদাহরণ দেখা যায় ভাষার ব্যবহার-এ। Idiocracy-তে প্রধান চরিত্র জো যখন স্বাভাবিক ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, তখন চারপাশের নির্বোধ মানুষ তা “ফ্যান্সি টক” মনে করে। বাংলাদেশেও আজ এই চিত্র বাস্তব—যদি কেউ শুদ্ধ ও মার্জিত বাংলায় কথা বলে, তখন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়। বলা হয়—“তুই কোথায় পেলি রে এমন বইয়ের ভাষা?” আজ গালি ছাড়া কথা যেন অসম্পূর্ণ, আর গলার জোর ছাড়া কেউ যেন মানুষই নয়। চিৎকার, গালিগালাজ, গঠনহীন উগ্রতা—এসবই এখন ক্ষমতার প্রতীক, নেতৃত্বের চিহ্ন।

রাজনৈতিক মঞ্চে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে হীন ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া হয় হাজারো মানুষের সামনে। টেলিভিশনের টক শো-তে “চতুর্ভুজীয় গালি যুদ্ধ” চলে, আর সামাজিক মাধ্যমগুলো তো যেন একেকটি অশ্লীলতার খোলা ময়দান। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো—এই সবকিছু দেখে সবাই চুপ।

কেউ প্রতিবাদ করে না, কেউ প্রশ্ন তোলে না। যেন পুরো সমাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সাহস হারানো, অনুভূতিহীন একদল দর্শক মাত্র। নৈতিকতা যখন হারিয়ে যায়, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না—সে হয়ে ওঠে মূর্খ, বিবেকহীন এক চলমান ছায়া।

আজকের এই জাতীয় অবক্ষয়ের চিত্র হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি কোনো একদিনের দুর্ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিনের অবহেলা, আপস এবং নৈতিক দেউলিয়াপনার ফল। কেবল নীতিহীন রাজনীতিবিদদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়মুক্তি লাভ করা যায় না, বরং এই বিপর্যয়ের জন্য সমানভাবে দায়ী আমাদের সমাজের সেই শ্রেণিটি—যারা নিজেদের পরিচয় দেয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিন্তাবিদ, কলাম লেখক, নাট্যকার, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী—যাদের কাজ ছিল জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া, তরুণদের মধ্যে বিবেক জাগ্রত করা, সমাজের গভীর অসঙ্গতিগুলোকে তুলে ধরা—তাঁরাই এক সময় ক্ষমতার লোভে, স্বার্থের মোহে, কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির আশায় নিজেদের আদর্শ বিকিয়ে দিয়েছেন। কেউ সরাসরি ক্ষমতার পদলেহনে লিপ্ত হয়েছেন, কেউ রাষ্ট্রীয় সম্মান, জাতীয় পুরস্কার কিংবা অনুদানের আশায় নিজেকে নীরবতায় আচ্ছন্ন করেছেন।

ফলে, নতুন প্রজন্মের সামনে তারা যে আদর্শিক অবস্থান তুলে ধরেছেন, তা হয়ে উঠেছে শূন্যতায় ভরা, চিন্তাশূন্য, এবং স্লোগান নির্ভর। জ্ঞানচর্চা এখন আর মননের অনুশীলন নয়, বরং পরীক্ষায় পাশ করার মাধ্যম। রাজনীতি আর জনগণের সেবার নাম নয়, বরং এক উগ্র স্লোগান-নির্ভর দলবাজি। শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে উঠেছে এক দমবন্ধ কূপ—যেখানে প্রশ্ন করা মানা, বিশ্লেষণ বারণ, আর চিন্তা করা বিপজ্জনক।

এইভাবে, যখন একটি জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে চিন্তা করতে না শিখিয়ে কেবল মুখস্থ করে যন্ত্রের মতো বড় করে তোলে, তখন সেই জাতির ভবিষ্যৎ আর গৌরবময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আজকের তরুণ সমাজ—যাদের কাঁধে আগামী রাষ্ট্র পরিচালনার ভার—তাদের অনেকেই জানে না তারা কী ভাবছে, কেন ভাবছে, কিংবা আদৌ নিজস্ব কোনো চিন্তা করার অধিকার তাদের আছে কিনা। তারা যেন পূর্বনির্ধারিত কিছু ক্লিশে চিন্তার ফ্রেমে আটকে আছে—বিনা প্রশ্নে যা বলা হয়, তাই মেনে নেওয়া, যা শেখানো হয়, তাই বিশ্বাস করা।

ফলে সচেতন নাগরিক গড়ে ওঠার পরিবর্তে আমরা পেয়েছি যান্ত্রিক মুখস্থবিদ্যায় শিক্ষিত এক আত্মবিস্মৃত প্রজন্ম, যাদের চিন্তাধারা পরিচালিত হয় বাইরের শব্দে, ভিতরের উপলব্ধিতে নয়। এই প্রজন্ম গণতন্ত্রের নাম শুনলেও তার অন্তর্নিহিত মূল্য বুঝে না। তারা ভোটার হলেও ভোট দিতে পারে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও ভয় পায় কথা বলতে। তারা ধর্মীয় বক্তার অগ্নিবর্ষী বক্তব্য দেখে উচ্ছ্বসিত হয়, কিন্তু মানবতা বা নৈতিকতা অনুধাবন করতে পারে না। তারা ভালোবাসে, কিন্তু সম্মান দিতে জানে না। যার ফলে সম্পর্ক হয় ছিন্নমূল, সমাজ হয় দুর্বল, আর রাষ্ট্র হয় অন্ধ।

এই আত্মশূন্য প্রজন্মই Idiocracy-র বাস্তব রূপ—যেখানে যুক্তি নয়, চলে স্লোগান; শিক্ষা নয়, চলে বিশ্বাস আর ভয়; চিন্তা নয়, চলে নিয়ন্ত্রিত অজ্ঞানতা।

Idiocracy-এর এক অনন্য দৃশ্য মনে পড়ে—যেখানে জো, একজন সাধারণ কিন্তু যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ, গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার কথা বলে। অথচ সেই সাধারণ কথাটিই সমাজে বিদ্রূপের পাত্র হয়। তাকে অবিশ্বাস করা হয়, শত্রু ভাবা হয়, এমনকি জেলে পাঠানো হয়। আজকের বাংলাদেশও যেন সেই পরিণতির পথেই হাঁটছে।

এখানে কেউ যদি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেন, নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, মুক্তচিন্তা ও সমালোচনার অধিকারকে রক্ষা করতে চান—তাকে চিহ্নিত করা হয় ‘দালাল’, ‘দোসর’, ‘নাস্তিক’, অথবা ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে। সত্যভাষী মানুষকে হয় আত্মগোপনে চলে যেতে হয়, নয়তো রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অন্যদিকে যাদের মুখে বিষ, যাদের চিন্তায় হিংসা আর বিভাজন, তারাই আজ মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজনীতির পাঠ দিচ্ছে, জনতার নেতা বনে যাচ্ছে, মিডিয়ায় জায়গা পাচ্ছে। অন্যদিকে বুদ্ধির কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য Idiocracy সিনেমার মতো কোনো “স্মার্ট জো” বা অলৌকিক নায়ক আমাদের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন একটি সমাজগত নবজাগরণ—একটি সম্মিলিত বিবেকের জাগরণ, যা অতীত ভুলে নয়, অতীত স্মরণ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণে আগ্রহী।

প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার—যেখানে মুখস্থ নয়, চিন্তা হবে মুখ্য। যেখানে প্রশ্ন করা হবে উৎসাহিত, মতবিরোধ হবে স্বাভাবিক, এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে মানুষ তৈরি। শুধু দলীয় কর্মী নয়, শুধু ভোটার নয়—একজন চিন্তাশীল মানুষ গড়ার শিক্ষা দরকার।

গণমাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্ববান—যে সত্যকে তুলে ধরবে সাহসের সাথে, মিথ্যা নয়; জনমত গঠনের মাধ্যম হবে, বিভ্রান্তি ছড়ানোর নয়। কর্পোরেট লোভ ও লালসার প্রভাব থেকে গণচিন্তা ও রাষ্ট্রচিন্তাকে আলাদা করতে হবে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রে পুনরায় সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিকে বসাতে হবে—যেখান থেকে জন্ম নেয় মূল্যবোধ, মনন, মানবতা।

জাতিকে বুঝতে হবে—একটি জাতি যখন তার ইতিহাস ভুলে যায়, সে জাতির সামনে কেবলই ধ্বংস অপেক্ষা করে। ইতিহাসের গৌরব শুধু উদযাপন নয়, তা হলো শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যম। আজ গণশিক্ষা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে; মিডিয়া হয়ে উঠেছে মিথ্যার জাদুকর; বিজ্ঞাপন হচ্ছে সত্যের বিকল্প, আর প্রযুক্তি-নির্ভর, তথ্য-ভারাক্রান্ত এক প্রজন্ম বড় হচ্ছে, যারা ঠিক কী বিশ্বাস করবে তা নিজেরাও জানে না।

এই তথ্যবিপ্লবের যুগে জ্ঞানের সংকটই সবচেয়ে বড় বিপদ। যারা জানে না, তারা বিশ্বাস করতে চায় যেকোনো কিছু; আর এই অন্ধবিশ্বাসই সমাজকে ঠেলে দেয় হিংস্র, অমানবিক, অশিক্ষিত শাসনের হাতে। এইভাবেই, নেতৃত্ব চলে যায় মাতাল, মাস্তান, গাঁজাখোর, অশিক্ষিত এবং বিদ্বেষপ্রবণদের হাতে।

“Idiocracy” সিনেমার শেষ বার্তাটি ছিল—”When stupidity becomes epidemic, it does not destroy individuals, it destroys civilizations.” আজ বাংলাদেশও সেই বার্তার সামনে দাঁড়িয়ে।

বি. দ্র: Idiocracy শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়: “মূর্খদের শাসনব্যবস্থা” বা “মূর্খদের দ্বারা পরিচালিত সরকার/সমাজ”



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews