দেশের ব্যাংকগুলোর সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ বাড়ছে। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে (সিআইপিসি) ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৭০০ অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা। অভিযোগের প্রায় ৯০ শতাংশই নিষ্পত্তি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। তাই অভিযোগের সংখ্যাও বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রাহকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহের অভাব—প্রধানত এ দুটি কারণে অভিযোগ বাড়ছে। তারা মনে করেন, ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত বাজারে নতুন নতুন পণ্য বা সেবা নিয়ে আসছে; কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালায় না। ফলে ক্ষুদ্র সমস্যায়ও মানুষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করে। অথচ চাইলে ব্যাংকগুলোই এসব অভিযোগ সমাধান করতে পারে। আবার গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায়ও অভিযোগ আসছে বেশি।
জানা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালে গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র (সিআইপিসি) গঠন করে। পরিধি বাড়তে থাকায় পরে একে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস (এফআইসিএসডি) নামে পূর্ণাঙ্গ বিভাগে রূপ দেওয়া হয়। এই বিভাগেই ব্যাংকিং সেবা সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ করা যায়। ই-মেইলের মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে নির্ধারিত ফরমে অনলাইনে, মোবাইল অ্যাপ, টেলিফোন এবং ডাকযোগে—এই পাঁচ উপায়ে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। সেবা-সংক্রান্ত তাত্ক্ষণিক সমাধানের জন্য ১৬২৩৬ এই নম্বরে ফোন করে যে কেউ সমস্যা জানাতে পারেন। জানা যায়, জানুয়ারি মাসে গ্রাহকরা স্বীকৃত বিলের বিপরীতে অর্থ না পাওয়া, ঋণ ও অগ্রিম এবং সাধারণ ব্যাংকিং সংক্রান্ত সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করেন। এছাড়া রেমিট্যান্স, কার্ড সেবা, ব্যাংক গ্যারান্টি, কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া, অতিরিক্ত ফি ও চার্জ, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রটিপূর্ণ নোট বিনিময় এবং চেক সংক্রান্ত অভিযোগ করেন।
ব্যাংককাররা বলছেন, দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। তাদের গ্রাহকসংখ্যাও বেশি। তাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি হবে এটা স্বাভাবিক। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকের পণ্য বেশি। বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেম সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে জানুয়ারিতে গ্রাহকরা মোট অভিযোগ করেছেন ১ হাজার ৬৮৭টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫২৪টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে, যা মোট অভিযোগের ৯০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ মাসে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহক টেলিফোনে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩৫৩টি অভিযোগ করেন, যার সবকটিই বাংলাদেশ ব্যাংক নিষ্পত্তি বা সমাধান করেছে। এছাড়া ই-মেইল, ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ এবং ডাকযোগে ১ হাজার ৩৩৪টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৭১টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে, বাকি ১৬৩টি অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তি করা হয়নি। অন্যদিকে গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল ১০ হাজার ৫৪২টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছিল ৮ হাজার ৬৮২টি। নিষ্পত্তির হার ছিল ৮২ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকরা মোট ৭৩ হাজার ২৪৮টি অভিযোগ করেন। এর মধ্যে টেলিফোনের মাধ্যমে ২৬ হাজার ২১১টি, যার সব কয়টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া ৪৭ হাজার ৩৭টি অভিযোগ করা হয় ই-মেইল, ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ এবং ডাকযোগে, যার মধ্যে ৪৬ হাজার ৭৯৩টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ২৪৪টি অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত মোট ৭৩ হাজার চারটি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা মোট অভিযোগের ৯৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ নিষ্পত্তি এলে অপরাধ বা বিষয়ের ধরনের ওপর নির্ভর করে। যেগুলো তৎক্ষণাৎ নিষ্পত্তি করা যায়, সেগুলো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়। আর যেগুলোতে আইনি জটিলতা থাকে সেগুলোতে সময় লাগে। অনেক সময় অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আসল কারণ বের করে তারপর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কাজ।
এদিকে গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ১৭৬টি পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চালানো হয়েছে আটটি পরিদর্শন।