গতকালের পর
নবাব হুমায়ুন জাহ ছিলেন সুবে বাংলার শেষ নবাব। ১৮২৪ থেকে ৩৮ সাল পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে বাংলার সিংহাসনে ছিলেন হুমায়ুন জাহ। এরপর কোম্পানী আর সমগ্র সুবে বাংলা নয়, শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের নবাব নিয়োগ দিত। মুর্শিদাবাদের প্রথম নবাব ছিলেন ফারেদুন জাহ (১৮৩৮-৮১) এবং শেষ নবাব ছিলেন ওয়ারেস আলী মির্জা (১৯৫৯-৬৯)। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে বৃটিশ বিদায়ের মাধ্যমে ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন দেশের জন্মলাভের পর সুবে বাংলা ও নবাবী অস্তিত্বহীন হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভারত সরকার মীর জাফরের বংশধরকে নবাব মনোনয়ন ও ভাতা প্রদান করে। পাকিস্তান আমলে প্রজাস্বত্ব আইন নামে খ্যাত স্টেইট এ্যকুইজিশন এন্ড টেনেন্সী এক্ট পাসের ফলে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং ভূমিতে রায়ত-প্রজার স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, নবাব ওয়াসিফ আলী থেকে এই বংশ মির্জা পদবী ধারণ করে।
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরাকের নাজাফি সৈয়দ মীর জাফর আলী খানের অধস্তন বংশধর নজমউদ্দৌলা থেকে ওয়ারেশ আলী মির্জা পর্যন্ত কেউ দেশ-জাতি ও মানব কল্যাণে কোন কাজ করেননি। বরং হালি হালি পত্নী, ডজন ডজন উপপত্নী এবং শত শত রক্ষিতা রেখে সুরা আর বাঈজী নিয়ে বুদ থেকেছেন। বৎসরান্তে বেহিসেবি সন্তানের পিতা হয়েছেন, প্রতি বছর ইংরেজদের নিকট থেকে প্রভূত পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করেছেন। এসব অকর্মন্য, অপদার্থ, চরিত্রহীন, মদ্যপ পুতুল নবাবদের কাজ ছিল মীর জাফরের বংশ বৃদ্ধি করা, ইংরেজদের মোসাহেবী করা; বেতন-ভাতা নেয়া। এসব পুতুল নবাবরা কোনভাবেই ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন নি বরং দেশ ও জনগণের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার পুরস্কার হিসেবে ইংরেজরা তাদেরকে অনুগ্রহ করে কিছু ভাতা দিয়েছে। তা দিয়েই তারা শুধু ইন্দ্রিয় বিলাসের মাধ্যমেই জীবন কাটিয়েছেন। মূলত এসব নবাবদের জীবন ছিল অভিশপ্ত।
জানা যায়, মীর জাফরের বাঈজীপুত্র মুবারকউদ্দৌলার দশ জন স্ত্রীর গর্ভে বারো পুত্র, তেরো কন্যা সন্তান ছিলেন। নবাব ফারেদুন জাহর বহু বিবাহের ফল ও ফসল ষোল পুত্র, চৌত্রিশ কন্যা সন্তান। অর্ধশত সন্তানের পিতা হওয়া উপমহাদেশীয় শাসকদের মধ্যে একটি রেকর্ড। সন্তান-সন্ততির সংখ্যায় মনে হয় অপদার্থ এসব কথিত নবাবদের সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। বাঈজী বংশের কথিত নবাবগণ ছিলেন কোম্পানীর বেতনভুক কর্মচারী। নবাব নজমউদ্দৌলার বার্ষিক ভাতা ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ১৬১ টাকা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের প্রভূরা বেতন-ভাতা কমিয়ে দেয়। নবাব হাসান আলীর আমলে তা বার্ষিক মাত্র ২২ হাজার টাকায় নেমে আসে। ফলে বাঈজী বংশধারার পরবর্তী নবাবরা পরবর্তীতে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হন। কিন্তু আত্মসম্মানহীন এইসব কথিত নবাবরা বোধহয় তা উপলব্ধিই করতে পারেন নি।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে বাংলার মানুষের জীবন যাত্রা ছিল খুবই স্বচ্ছল। কিন্তু সিরাজ পরবর্তী সময়ে বাংলার মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও অস্বচ্ছলতা। কারণ, বেপরোয়া লুটপাটের কারণে সোনার বাংলা বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। পলাশীর যুদ্ধের মাত্র ১৩ বছর মাথায় ১৭৭০ সালে বাংলায় যে ভয়াবহ মন্বন্তর দেখা দেয় তাতে বাংলা ও বিহারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মূলত এ দুর্ভিক্ষ ছিল কৃত্রিম। বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাত থেকে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ইংরেজরা কেড়ে নেয়। মসলিন শিল্পিদের হত্যা করে ও তাদের আঙুল কেটে নেয়। তাঁতীদের তাত চালানো বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসে।
মূলত, পলাশীর পরাজয়ের মাধ্যমে ভারত বর্ষে মুসলিম আধিপত্য খর্ব হতে শুরু করে। মুসলিম সমাজ তাদের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্য হারাতে বসে। শিক্ষা-দিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ঐতিহ্য-গবেষণায় মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। এর ষোলকলা পূর্ণ হয় ১৭৯৯ সালে মহীশূরের নবাব টিপু সুলতানের পতনের মাধ্যমে। এতদবিষয়ে আরও স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে ইংরেজ লর্ড ম্যাকলে ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে বক্তৃতা দিয়েছিলো সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
‘I have traveled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such calibre, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation. - Lord Macaulay)
লর্ড ম্যাকলে ভারতীয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির ক্ষমতা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। বৃটিশ সরকার ম্যাকলের প্রস্তাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিলো এবং সেই অনুসারে পলিসিও তৈরি করে। ১৮৩৫ থেকে ১৯৪৭ এই সুদীর্ঘ ১১২ বছর ছিলো মূলত ঐ পলিসিরই বাস্তবায়নের যুগ। যার ফলে বাংলার উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া ইংরেজী ভাষার ব্যাপক প্রভাবে আমরা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, আদর্শ-আধ্যাত্মিকতা, এক কথায় স্বকীয়তা হারিয়েছি। পরাধীনতা বরণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর ছিল না। নৈতিক মূল্যবোধ ও মনোবলের অভাবে আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করতে পারিনি। সে সুযোগে চলেছে আমাদের দেশে প্রচলিত পুরাতন শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, আদর্শ-আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধের ধ্বংসযজ্ঞ।
পলাশী যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নবাব সিরাজকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার কারণে ইতিহাসের পাতায় মীর জাফর খলনায়ক হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। তার বংশধরদেরও সে গ্লানী নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। তবে মুর্শিদাবাদের নবাবী খেতাব ফিরে পাবার জন্য মীর জাফরের বংশধররা আদালতে যে দীর্ঘ আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন সে লড়াইয়ে তারা বিজয়ী হয়েছেন। তারা ফিরে পাচ্ছেন নবাবী খেতাব। আসলে বিশ্বাস ঘাতকতার পুরস্কার হিসেবেই লর্ড ক্লাইভ মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদের নবাবের আসনে বসিয়েছিলেন। সে সময় বৃটিশ পার্লামেন্টে মীর জাফরের পরিবারকেই নবাবের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর ১৯৬৯ সালে কলকাতায় মারা গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদেরর শেষ নবাব ওয়ারিশ আলি মীর্জা। এ সময়ই ভারত সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের উত্তরসূরীকে তা জানতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল।
এর কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার হাজার দুয়ারিসহ মুর্শিদাবাদের নবাবের সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নেয়। নবাবী খেতাবও হারান মীর জাফরের উত্তরসূরীরা। তবে খেতাব ফিরে পাবার জন্য মীর জাফরের উত্তরসুরিরা আদালতে লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। সে লড়াইয়ে ২০১৪ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের পক্ষেই রায় দিয়েছে। মূলত, বিশ্বাসঘাতকতার ইনামটা মীর জাফরের বংশধররা কড়ায়-গণ্ডায় এখনও বুঝিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সীমাহীন উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন শহীদ নবাব সিরাজের বংশধররা। রাষ্ট্র ও সমাজ তাদেরকে যথাযথভবে মূল্যায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে না। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের আত্মপরিচয় তুলে ধরার জন্যই শহীদ নবাব সিরাজের চেতনা ও মূল্যবোধের যেমন ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হওয়া উচিত, ঠিক তেমনিভাবে তার বংশ বর্তমান বংশধরদেরও যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।
পলাশীর ষড়যন্ত্র ও নবাব সিরাজকে নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর মীর জাফর নবাব হয়েছিলেন বটে কিন্তু তা ছিল নামকাওয়াস্তে। মূলত, সিরাজ পরবর্তী নবাবগণ ছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতের পুতুল। ইংরেজদের অধীনস্ত কর্মচারি বলতেও অত্যুক্তি হওয়ার কথা নয়। এসব কথিত নবাবদের বিত্ত-বৈভবের কোন কমতি ছিল না। আর এজন্য তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল। নিজেদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সিরাজ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকদের জিঘাংসা থেকে রেহাই পাননি নবাব পরিবারের পুরোনারীরাও।
মীর জাফর ও তার সহযোগীরা যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের সে উদ্দেশ্যও পুরোপুরি সফল হয়নি বরং তাদেরকে এজন্য করুণ প্রায়াশ্চিত্যও করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মীর জাফরসহ পশালীর ষড়যন্ত্রকারীদের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই করুণ মৃত্যু ঘটেছিল। পুত্র মিরনকেও ইংরেজরা পুড়িয়ে হত্যা করেছিল বলে জানা যায়। মীর জাফর পরবর্তী নবাব নজম উদ দৌলা ও সাইফ উদ দৌলাকে ইংরেজরা বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। মৃত্যুকালে তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৭ ও ২২ বছর। অতি অল্প সময়ের মধ্যে মীর জাফরের ৩ পুত্রের মর্মান্তিক পরিণতি বিবেকবান মানুষের জন্য অবশ্যই শিক্ষণীয়। কিন্তু শিক্ষা নেননি মীর জাফরের উত্তরসূরীরা। তারা এখনও বিশ্বাসঘাতকতার সুবিধাভোগী! (সমাপ্ত)