দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ১১ মাস ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই ওঠানামা করছে। অথচ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স ও রফতানি—এই দুই প্রধান উৎসে এসেছে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি। এর মধ্যে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ এবং রফতানি আয় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। কিন্তু তারপরও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ছে না। উল্টো এই ১১ মাসে রিজার্ভ কমেছে ০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ অনুযায়ী ২০২৫ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও অর্থবছরের শুরুতে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

রেমিট্যান্স ও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি, তবু রিজার্ভ বাড়ছে ধীরে

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রেমিট্যান্স ও রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২৪.৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১৪ জুন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছেন মোট ২৮ হাজার ৬৫৬ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ হাজার ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থাৎ গত ১১ মাসে রেমিট্যান্স ও রফতানি খাত থেকে বাড়তি  ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে, কিন্তু সেটি রিজার্ভে প্রতিফলিত হয়নি।

রিজার্ভ কমার পেছনে কারণ কী?

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে— রেমিট্যান্স ও রফতানির বাড়তি আয়ের সুবিধা ম্লান করে দিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ, অনুদান ও ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৩৭ কোটি ডলার, বিদেশি অনুদান কমেছে ১৮৬ কোটি ডলার, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমেছে ১৩৬ কোটি ডলার।

সব মিলিয়ে মাত্র তিনটি খাতে গত বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার কম বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে। একই সময়ে আমদানি খরচ বেড়েছে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হারে পরিশোধ করা হয়েছে আগের বিদেশি ঋণ, সেবা খাতে ব্যয় এবং বকেয়া ঋণপত্রের দায় (এলসি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজারমুখী মুদ্রানীতির কারণে ডলার সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। তবে বিগত বছরের জমে থাকা দেনা পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে।

ঋণ সহায়তায় বাড়তে পারে রিজার্ভ

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, চলতি জুন মাসেই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এই অর্থ সংযোজিত হলে রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। গত তিন বছরে যতটুকু ক্ষয় হয়েছে, এখন অন্তত সেটি থেমেছে।’

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন, গত ১১ মাসে বাংলাদেশ অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ ও দায় পরিশোধ করেছে। এগুলো না হলে রিজার্ভ অন্তত ৩-৪ বিলিয়ন ডলার বেশি হতে পারতো।

রিজার্ভের ওপর কমেছে চাপ

বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে (বিওপি) স্থিতিশীলতা ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিলের শেষে এই ঘাটতি নেমে এসেছে মাত্র ৬৬ কোটি ডলারে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৬৫৭ কোটি ডলার, আর ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ছিল ৮২২ কোটি ডলার। ঘাটতি কমায় এখন আর রিজার্ভ থেকে বিপুল পরিমাণে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে না, ফলে রিজার্ভে চাপ কমেছে।

জুনে রেমিট্যান্সে হঠাৎ ভাটা

বছরজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক থাকলেও চলতি জুন মাসের প্রথম ১৪ দিনে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যাচ্ছে—১ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত এসেছে ১১৪৯ মিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল ১৬৪৪ মিলিয়ন ডলার। ফলে অর্ধেক মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৩০ দশমিক ১ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পতন ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। তবে জুনের শেষভাগে পরিস্থিতি নজরে রাখতে হবে।

আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল হলেও তা এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট নয়। তারা বলছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানির বড় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না, বরং নানা ব্যয় ও ঋণ পরিশোধে তা ক্ষয়প্রাপ্ত। যদিও ভবিষ্যতে ঋণ সহায়তা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরী মনে করেন, শুধু রেমিট্যান্স বা রফতানির প্রবৃদ্ধি দিয়ে রিজার্ভ বাড়বে না। বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহ না বাড়ালে মজুতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে না। তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ ক্ষয় এখন বন্ধ হলেও সেটি পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।’

মজুত ওঠানামা: ১১ মাসের চিত্র

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ২১.৬৮ বিলিয়ন ডলার। আকুর (এসিইউ) দায় পরিশোধের পর তা নেমে আসে ২০ বিলিয়ন ডলারে। জুলাইয়ের শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০.৪৯ বিলিয়ন ডলার। এরপর আট মাসজুড়ে মজুত ওঠানামা করে ১৮ থেকে ২১ বিলিয়নের মধ্যে। এপ্রিলে রিজার্ভ আবারও পৌঁছায় ২২ বিলিয়ন ডলারে। মে মাসে আকুর দায় পরিশোধের পর ফের নেমে আসে ২০ বিলিয়নের ঘরে। ৪ জুন ঈদের আগে তা ছিল ২০.৭৬ বিলিয়ন ডলার। কোরবানির ঈদের পর ১৫ জুন এটি দাঁড়ায় ২০.৮৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে এই মজুত ছিল ২৬.১৪ বিলিয়ন ডলার, যদিও এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews