ইতিহাসের কোনো কোনো অধ্যায় গৌরবমণ্ডিত হয়ে রূপান্তরিত হয় মহান ঐতিহ্যে। তখন তা ইতিহাসের অন্ধগলি অতিক্রম করে হয় গতিশীল আর জাতীয় জীবনের দুই কূল ছাপিয়ে হয়ে ওঠে বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সংকটকালে জাতি সেদিকে তাকায় সাহসের জন্য, শক্তির জন্য, বিশ্বাসের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে কৃতজ্ঞতার ডালা সাজিয়ে নিজেদের সে মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পৃক্ত করে নতুনভাবে আত্মপ্রত্যয় লাভ করে। ভাষা আন্দোলন এ জাতির তেমনি এক ঐতিহ্য আর একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনিভাবে এ জাতির শক্তি, সাহস ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে শহীদ মিনার এ জাতির এক তীর্থক্ষেত্র।
জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মূলে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি মনের বিদ্রোহ প্রকাশিত হলো। এ আন্দোলনে জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা সূচিত হলো। কালক্রমে এ চেতনার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের জনসমষ্টি এক অপ্রতিরোধ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উজ্জীবিত হলো। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মনের ইস্পাতকঠিন শপথ চতুর্দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। এ আন্দোলনেই সর্বপ্রথম বাঙালি যুবকরা রক্তদানের তাৎপর্য অনুধাবন করে। আর দাবি আদায়ের যে পরম আনন্দ তা প্রাণভরে উপভোগ করে। এ আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্ব।
অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমান উপভোগ বা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা। জাতীয়তাবাদের মূলে ধর্ম-ভূখণ্ড, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য বা অতীত স্মৃতি কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। তাই নিয়ে বিভিন্ন লেখক ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করলেও এর মৌল সূত্র যে সমষ্টিগত চেতনা, এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। ভাষা আন্দোলন এ ভূখণ্ডের জনসমষ্টির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করে, আপামর জনসাধারণের মধ্যে সামগ্রিক এক সত্তার প্রত্যয়, সমষ্টিগত এক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদের সুপ্ত সূত্রগুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলে। ফলে পূর্ব বাংলার জনসমষ্টির মধ্যে সৃষ্টি হলো নতুন জীবনবোধ, নতুন আত্মসচেতনতা, বাঙালি পরিচয়ে নতুন গর্ববোধ। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আদর্শিক এক দৃঢ় প্রত্যয়।
কোনো জনসমষ্টির মহত্তর সৃষ্টি তার ভাষা। ভাষা একদিকে যেমন কোনো জাতির প্রতিভা বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম, অন্যদিকে তেমনি সে জাতির প্রতিভারও শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। ভাষা কিন্তু সংগোপনে তৈরি হয় না। তা নির্দিষ্ট কোনো জাতি বা ভূখণ্ডে সীমিতও থাকে না। একটি ভাষা বহু জাতি ব্যবহার করতে পারে। আমাদের ভাষা, ভারতের একাংশে প্রচলিত। বাংলাদেশে যা জাতীয় ভাষা ভারতে তা আঞ্চলিক ভাষা। আমাদের কাছে যা মায়ের ভাষা, আমাদের প্রতিবেশীর কাছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও একটি আঞ্চলিক ভাষা। অনেক কটির একটি। ফলে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় যে সাহিত্য রচিত হলো, তার প্রকৃতি হলো ভিন্ন। একটিতে অনুরণিত হলো জাতীয় সত্তার অন্তরঙ্গ সুর, অন্যটিতে প্রতিফলিত শুধু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য।
সাহিত্য হিসেবে শ্রেষ্ঠতর হয়েও পশ্চিম বাংলায় সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের বীজ উপ্ত হলো না। উভয় বাংলায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সৃষ্টিধর্মী নির্মাণপ্রক্রিয়ায় চুন-সুরকির পরিমাণ সম্ভবত একই ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের মনমানসিকতায় যে ঐক্যানুভূতি ছিল, তাই জন্ম দেয় এক অনন্য স্থাপত্যের, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মহান সৌধের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা ডিজাইনবিহীন অতি সুন্দর দেয়ালের বেশি কিছু সৃষ্টি করেনি। দুই বাংলার ভাষা ও সাহিত্যে যে পার্থক্য তার সুস্পষ্ট প্রকাশ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে। তাই কালে বেগবতী স্রোতস্বিনীরূপে সর্বস্তর ছাপিয়ে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ও আরো পরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতিসত্তার ভিত্তিতে রূপান্তরিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য সৌকর্যে তেমন কোনো সম্ভাবনার সৃষ্টি করেনি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ তার উন্নত সাহিত্যসম্ভার নিয়েও ভারতীয় সভ্যতার স্রোতধারায় বিলীন হলো। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েও বেছে নিল আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ। হাজারো ধারায় রক্ত ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদের সিঁড়ি বেয়ে ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতার লাল গোলাপ। এদিক থেকে বলা যায়, ভাষা আন্দোলন একদিকে এ জাতির মহত্তর স্থাপত্য, অন্যদিকে তেমনি এ জাতিসত্তার প্রধানতম স্থপতিও।
২.
গণতন্ত্র এক ধরনের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে গণতন্ত্র। সমাজের সবার জীবন স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। সমস্বার্থের মোহনায় তা সবাইকে করে সম্মিলিত। সমস্বার্থের সুষম বন্ধনে সবাইকে করে সংগ্রথিত। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের উপত্যকায় সবাইকে করে সংগঠিত। এ জন্য গণতন্ত্রকে বলা হয় সমাজব্যবস্থা (A social system)। দীর্ঘকালীন পরিসরে সমাজে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্জিত কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা।
অন্যদিকে গণতন্ত্র এক প্রক্রিয়াও (A process) বটে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজে ব্যক্তি স্বীকৃত হয় স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ, অনন্য একক রূপে। কারো ওপর সে নির্ভরশীল নয়। নয় কারো মুখাপেক্ষী। আপন মহিমায় সবাই ভাস্বর। আপন দ্যুতিতে উজ্জ্বল। তার সম্মতি ব্যতীত তাকে শাসন করার অধিকার কারো নেই। তার সম্মতি ব্যতীত তার ওপর কর ধার্যের ক্ষমতা নেই কারো। যেকোনো নীতি নির্ধারণে এ প্রক্রিয়ায় সর্বাধিকসংখ্যক ব্যক্তির ইচ্ছা হয় প্রতিফলিত। সবার সম্মতি নিয়েই সমাজ হয় পরিচালিত। তাই বলা হয়, গণতন্ত্রে নেই কোনো শাসক অথবা শাসিত। সবাই মিলে সবার কাজ পরিচালনা করে।
আরেকদিক থেকে বলা হয়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। পরিশীলিত এক যৌথ কর্মপ্রবাহ। রুচিকর এক যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন এক সামাজিক পদক্ষেপ। গোপনীয়তার জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের সূচনা হয় সর্বসাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। বেরিয়ে আসে প্রকাশ্য দিবালোকে। সবাইকে নিয়ে চলতে হয় বলে সবার মানসিকতা প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে। অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই নির্ধারণ করে নিজের পদক্ষেপ। সংযত করে নিজের রসনা, নিজেদের আচার-আচরণ। আমার জন্য যা পীড়াদায়ক, অন্যের কাছে তা সুখকর হতে পারে না। আমি যা পেয়ে খুশি হই, অন্যেরও তা প্রাপ্য। যে কথা শুনে আমি কষ্ট পাই, অন্যের কাছেও তা কষ্টকর হবে। গণতন্ত্রের কৌশল রুচিসম্মত। তার চর্চা হয় অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে। নীরবে নয়, তারস্বরে। নির্জনে নয়, জনারণ্যে, মিটিংয়ে, মিছিলে, জনসমাবেশে।
ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি। সুরুচির প্রতীক। স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতিচ্ছবি। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের নিশ্চিত নীড়। প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র সহযোগিতার সূত্র। আস্থা ও বিশ্বাসের অন্তরঙ্গ সুর। সমঝোতার ক্ষেত্র। মুক্তবুদ্ধির বিস্তীর্ণ অঙ্গন। এদিক থেকে গণতন্ত্র যেমন উপায়, তেমনি উপেয়। সমাজ জীবনের যেমন চূড়ান্ত লক্ষ্য, তেমনি মাধ্যমও। গন্তব্য ও পথ দুই-ই।
গণতন্ত্রের জন্য যেমন প্রয়োজন কাঠামো, তেমনি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মন ও কাঠামোর সর্বস্তরে স্পন্দিত অন্তঃকরণ, কাঠামোকে সিক্ত করার গণতান্ত্রিক চেতনার ঘন আস্তরণ। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে দুই-ই প্রয়োজন। কাঠামো সৃষ্টি করে নৈতিক পরিমণ্ডল। কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মনের প্রসার ঘটানো, কাঠামোকে প্রাণোচ্ছল করাই চূড়ান্ত পর্ব। চূড়ান্ত পর্বেই গণতান্ত্রিক সমাজের সূচনা হয়। সমাজজীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয় না এক বছরে, হয় না এক যুগেও। যুগ যুগ ধরে জলধারায় সঞ্চিত পলি যেমন গড়ে তোলে এক স্বর্ণদ্বীপ, গণতান্ত্রিক সমাজও তেমনি গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে অর্জিত সাফল্যে। গণতন্ত্রচর্চার উজ্জ্বল ঐতিহ্যে, সহযোগিতায় ও মিলনের গৌরবময় ফসলে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চারাটি এখনো তেমন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনি। এখনো বিশীর্ণ, কৃশ, ক্ষীণকায়। গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেই কাঠামোয় প্রাণের সঞ্চার এখনো হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামন্ত যুগের কর্তৃত্ববাদী মনের উত্তাপে গণতন্ত্রের কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে শুষ্ক-বিবর্ণ কাষ্ঠখণ্ডের মতো। ল্যারি ডায়মন্ডের (Larry Diamond) মতে, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ‘প্রশাসনের তিনটি সংকটে’র (triple crisis of governance) কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত। এক. দেশে আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তিশাসনের প্রাধান্য এবং জবাবদিহির অনুপস্থিতিতে সৃষ্টি হয় ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যক্তিকরণ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন; দুই. রাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তা ও বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈষম্যের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সমাধানের অনুপস্থিতি এবং তিন. প্রশাসনের সততা, দক্ষতা ও পেশাদারির অভাবে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট।
তা ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মতো অন্যান্য নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধানত দুটি কারণে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। এক. রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি রাজনীতিকদের সীমাহীন দুর্বলতা, বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও দলীয় পর্যায়ে যা কিছু কাঙ্ক্ষিত, তা অর্জন করার উদগ্র কামনা এবং তা লাভের জন্য যে মূল্যবোধ সমাজকে স্থিতিশীল রাখে তাকে দলিত-মথিত করে যেকোনো পন্থায় তা লাভ করা। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজে সৃষ্ট মরুভূমিতে তখন আর অবশিষ্ট থাকে না সুনীতি অথবা সুরুচির কোনো শ্যামলিমা। কণ্টকময় ক্যাকটাসে তখন চারদিক ভরে ওঠে। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের চারা বিবর্ণ ও শ্রীহীন হতে বাধ্য। হচ্ছেও তাই। দুই. সমাজে আইনের প্রাধান্যের পরিবর্তে ব্যক্তিপ্রাধান্য (Personalization of power) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে আইনসংগতভাবে যার যা প্রাপ্য, সে পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং যার যা প্রাপ্য নয়, তা তার নিয়ন্ত্রণে আসে। এসব কারণে সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও ঔদাসীন্যের ঘন আস্তরণে ঢাকা পড়ে। যুক্তির স্থান গ্রহণ করে পেশিশক্তি। ন্যায়নীতি ও বৈধতার প্রশ্ন গৌণ হয়ে ওঠে। বিবেক-বিবেচনার স্থান সংকীর্ণ হয়ে আসে। তাই বলি, দেশে গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত করার জন্য নাগরিকদের যতটুকু দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দৃঢ়সংকল্প ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন রাজনীতিকদের। মূলত রাজনীতিকদের অঙ্গীকারই (Commitment) এ ক্ষেত্রে শেষ কথা।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়