নতুন আতঙ্ক হয়ে এসেছে জিকা ভাইরাস। মূলত দুই ধরনের এডিস মশা এই ভাইরাস ছড়ায়। এ ভাইরাস যে রোগ সৃষ্টি করে তার সাথে ডেঙ্গু জ্বরের মিল রয়েছে। জিকা ভাইরাস ডেঙ্গু ভাইরাস, পীতজ্বর ভাইরাস, জাপানিজ এনসেফালাইটিস এবং ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত। যে সকল নারী জিকা জ্বরে আক্রান্ত তাদের গর্ভের সন্তান মাইক্রোসেফালি বা ছোট আকৃতির মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এছাড়া বড়দের ক্ষেত্রে এটি গিলেন বারে সিনড্রোম করতে পারে। উগান্ডার জিকা নামের একটি গ্রামের নাম অনুসারে রাখা হয় জিকা ভাইরাস। স্থানীয় ভাষায় জিকা মানে বাড়ন্ত। সেখানেই বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। এরা শীতপ্রধান অঞ্চলে টিকে থাকতে পারে। শুধু স্ত্রী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। একবার রক্ত খাওয়া শেষে ডিম পাড়ার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এদের ডিমগুলো পানিতে এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম পরিস্ফুটনের জন্য যথেষ্ট। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ালে উক্ত মশাও ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। জিকা ভাইরাস শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমেও ছড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি আমেরিকাতে এরকম ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। জিকা ভাইরাস পলিমারেজ চেইন রিয়াকশন (পিসিআর)’র মাধ্যমে শনাক্ত করা হয় এবং রক্তের নমুনা থেকে ভাইরাস পৃথক করা যায়।
উপসর্গগুলো হালকা হয়, এই ভাইরাস মানব শরীরে প্রাথমিকভাবে জিকা জ্বর অথবা জিকা রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্র হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগে মৃত্যুর ঘটনা খুবই দুর্লভ। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম এক সপ্তাহ রোগীর রক্তে ভাইরাস থাকতে পারে, তাই এই সময় রোগীকে যেন মশা না কামড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, কারণ ঐ ব্যক্তিকে কামড়ালে ভাইরাস মশার শরীরে প্রবেশ করবে এবং ঐ মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সে ব্যক্তিও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। এখনও জিকা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।
চিকুনগুনিয়া হচ্ছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সাথে অস্থিসন্ধিতে ব্যাথা থাকে, যা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে এক জন বা এর চেয়েও কম। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক বেশি হয়। এ ভাইরাসটি এডিস মশার দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস বাহক হিসেবে পরিচিত। তারা মূলত দিনের আলোতে কাঁমড় দিয়ে থাকে। মানুষ ছাড়াও কয়েকটি প্রাণী বানর, পাখি, তীক্ষè দন্ত প্রাণী যেমন ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান। রোগ সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করে ভাইরাসের আরএনএ বা ভাইরাসের এন্টিবডির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। এই রোগের উপসর্গকে অনেক সময় ডেঙ্গু জ্বর এবং জিকা জ্বরের সাথে ভুল করে তুলনা করা হয়। একক সংক্রমণের পর এটি বিশ্বাস করা হয় যে, বেশিরভাগ মানুষই অনাক্রম্য হয়ে পড়ে। এখানেই ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে এর পার্থক্য, কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ীদের আক্রান্ত করে। এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ করা। আরটি-পিসিআর, সেরোলজির মাধ্যমে পরীক্ষাগারে ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর অনুমোদিত কোনো টিকা নেই।
ডেঙ্গুও একটি মশাবাহিত রোগ। বর্তমানে সবচাইতে বেশি যে রোগটি আমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ডেঙ্গু, যার বাহক এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মম-লীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গুকে চিহ্নিত করেছে। ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মম-লীয় রোগ। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। এর একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গুকে বলা হতো শহুরে রোগ। এখন ভয় জাগাচ্ছে গ্রামের ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, আগস্টে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ১৯ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং মারা গেছে ২০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৩ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪ হাজার ৯৯৯ জন। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, যাদের মধ্যে ৫৮.৩% পুরুষ এবং ৪১.৭% নারী।
এক বরগুনাতেই রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০ জন, আর বরিশাল বিভাগে সব বিভাগের চেয়ে বেশি আক্রান্ত। তবে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৮৭টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জরিপ, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, সক্ষমতা কিংবা জনবল নেই। জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালের সামান্য শয্যা আর স্বল্প বাজেটের সীমিত জনবলেই চলছে ডেঙ্গুর মোকাবিলা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যদি গ্রামীণ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চঝুঁকির জেলাগুলোকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও রোগী ব্যবস্থাপনার বড় পরিকল্পনা ছিল রাজধানী ঘিরে। তবু রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। ঠেকানো যায়নি রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এই ডেঙ্গু এখন শহরের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামে-গঞ্জে। জুনের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে শনাক্তের হার। ঢাকার চেয়ে বাইরের জেলাগুলোতেই এ বছর সংক্রমণ বেশি। এরই মধ্যে অন্তত ১০ জেলায় ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ বছর শনাক্ত রোগীর অন্তত প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা।
মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতিতে জমে থাকা পানিতে জন্মায়, তাই সেগুলোতে যেন পানি না জমে থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। মশারির নিচে ঘুমাতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।