ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে টানা ২৪ মিনিটের অভিবাদন (স্ট্যান্ডিং ওভেশন) পেলো ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার একটি সত্যি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’। এতে পাঁচ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশু হিন্দ রাজাবের হৃদয়বিদারক আর্তি ও জীবনের শেষ মুহূর্তের গল্প দেখে আবেগাপ্লুত দর্শকরা। ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি গাজায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হামলা চলাকালে একটি গাড়ির ভেতর আটকা পড়ে মেয়েটি। সেদিন গাজা থেকে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মুখে পড়ে তার সঙ্গে প্রাণ হারায় খালা, খালু, তিন কাজিন ও দুই জন চিকিৎসাকর্মী।

ইতালির লিদো দ্বীপে পালাৎসো দেল সিনেমা ভবনে গত ৩ সেপ্টেম্বর ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শেষে দর্শকরা টানা ২৪ মিনিট দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। উৎসবের পরবর্তী প্রদর্শনীর সময় হয়ে যাওয়ায় আয়োজকরা দর্শকদের মিলনায়তন ছাড়ার অনুরোধ করার পরই করতালি থামে। ধারণা করা হচ্ছে, এটাই যেকোনও চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের দাঁড়িয়ে সবচেয়ে দীর্ঘক্ষণ করতালি দেওয়ার রেকর্ড। ২০০৬ সালে কান উৎসবে মেক্সিকান নির্মাতা গিয়ের্মো দেল তোরোর “প্যান’স ল্যাবিরিন্থ” ২২ মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশন পায়। সেই রেকর্ডকে ভেনিসে টপকে গেলো ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’। দর্শকরা অভিবাদন জানানোর সময় দুই হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা নাড়তে থাকেন দেশটির অভিনেতা মোতাজ মালহিজ। এরপর হিন্দ রাজাবের স্থিরচিত্র দুই হাতে তুলে ধরেন তিনি।

‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’ পরিচালনা করেছেন তিউনিসিয়ার কাওতার বেন হানিয়া। লালগালিচায় তার ও মোতাজ মালহিজের হাতে ছিল নিহত হিন্দ রাজাবের একটি হাসিখুশি স্থিরচিত্র। তাদের সঙ্গে ভেনিসে আরও ছিলেন ফিলিস্তিনি অভিনেতা আমের হালেহেল, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান অভিনেত্রী ক্লারা কৌরি ও জর্ডানিয়ান অভিনেত্রী সাজা কিলানি।

ছবিটিতে ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির টেলিফোন অপারেটরদের আলোকপাত করা হয়েছে, যারা গাড়ির ভেতরে আটকে থাকা ছোট্ট হিন্দ রাজাবকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। তখন মেয়েটি তাকে বাঁচাতে করুণভাবে মিনতি করছিল। গাড়িতে ততক্ষণে তার খালা, খালু ও তিন কাজিনের মৃতদেহ পড়ে ছিল। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির টেলিফোন অপারেটরদের হিন্দ রাজাব বলছিল, ‘আমি খুব ভয় পাচ্ছি, দয়া করে আসুন। কাউকে এসে আমাকে নিয়ে যেতে বলুন।’ ছোট্ট মেয়েটির সেসব কণ্ঠের মূল অডিও রেকর্ডিং শোনা গেছে ছবিতে। দর্শকদের অনেকে প্রদর্শনী শেষে স্লোগান দেন, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’।

তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে হিন্দ রাজাবকে বাঁচানোর জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে ইসরায়েলের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পায় রেড ক্রিসেন্ট। কিন্তু ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর পরপরই মেয়েটি ও উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েকদিন বাদে গাড়ি থেকে হিন্দ রাজাব ও তার আত্মীয়দের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এছাড়া বোমাবিধ্বস্ত অ্যাম্বুলেন্স থেকে মিলেছে নিহত দুই চিকিৎসাকর্মীর মরদেহ।

ভেনিস উৎসবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কাওতার বেন হানিয়া ও হিন্দ রাজাব হত্যাকাণ্ড নিয়ে নির্মিত ছবিটির অভিনয়শিল্পীরা আলাদাভাবে স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছেন। অভিনেত্রী সাজা কিলানি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই চলচ্চিত্র কোনও কলাম কিংবা কল্পনা নয়। এটি সত্যের ওপর দাঁড়ানো। হিন্দ রাজাবের গল্প পুরো ফিলিস্তিনি জাতির ভার বহন করে। তার কণ্ঠ লাখো শিশুর সঙ্গে একাত্ম, যাদের গত দুই বছর ধরে গাজায় হত্যা করা হয়েছে। ছবিটি প্রতিটি কন্যা ও প্রতিটি সন্তানের কণ্ঠস্বর; যাদের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা ও মর্যাদার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার অধিকার আছে। তবুও আমাদের চোখের সামনেই তাদের কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

সাজা কিলানি যোগ করেন, ‘কীভাবে আমরা একটি শিশুকে তার জীবন ভিক্ষা চাইতে দিলাম? যতক্ষণ একটি শিশুরও বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানাতে হয়, ততক্ষণ কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না। হিন্দ রাজাবের কণ্ঠস্বর বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হোক।’

ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কাওতার বেন হানিয়া। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “হিন্দ রাজাবের কণ্ঠ প্রথমবার শুনেই বুঝেছিলাম– এটি শুধু তার একার নয়, এটি ছিল গোটা গাজার পক্ষ থেকে সাহায্যের আকুতি। ক্ষোভ আর অসহায়ত্ব থেকে এই ছবির জন্ম। বিশ্বজুড়ে আখ্যান ছড়ানো হয়েছে যে, গাজাবাসীর মৃত্যু কেবলই ‘অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি’। আমি মনে করি, এটি ভয়াবহ অমানবিকতা। আমরা সম্মিলিতভাবে বলছি, যথেষ্ট হয়েছে। এই গণহত্যা থামাতে হবে।”

কাওতার বেন হানিয়া সংবাদমাধ্যমকে জানান, এতটা অভূতপূর্ব সাড়া তিনি একেবারেই আশা করেননি। ছবিটিকে নির্বাচিত করায় ভেনিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই নারী নির্মাতা। তার আশা, ভেনিস উৎসবে পাওয়া রেকর্ড অভিবাদন হিন্দ রাজাবের হৃদয়বিদারক গল্পকে বৈশ্বিক দর্শকের কাছে পৌঁছাতে সহায়ক হবে। ছবিটির কলাকুশলীরা মনে করেন, হিন্দ রাজাবের গল্পকে সারাবিশ্বে পৌঁছে দিতে তারা একধরনের ‘মিশনে’ আছেন।

‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’ যেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেই প্রত্যাশা কাওতার বেন হানিয়ার। ছবিটির বিতর্কিত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি শিশুকে হত্যা কোনও বিভাজনমূলক বিষয় নয়। এটি স্রেফ একটি অপরাধ।’

গল্পে রেড ক্রিসেন্ট কর্মীদের ভূমিকায় থাকা অভিনয়শিল্পীরা জানান, শুটিং সেটেই তারা প্রথমবার হিন্দ রাজাবের রেকর্ডিং শোনেন। তাদের কাছে সেজন্য শুটিং ছিল অত্যন্ত আবেগঘন। অভিনেতা মোতাজ মালহিজ বলেন, ‘দুইবার আমি শুটিংয়ে থমকে গিয়েছিলাম। আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল।’

অভিনেতা আমের হালেহেল সাংবাদিকদের জানান, রেকর্ড অভিবাদন পাওয়ার ঘটনা তার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে এটা ভেবে যে, আমরা উদযাপন করছি অথচ মানুষ এখনও অনাহার আর গণহত্যায় মরছে।’

৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় মর্যাদাপূর্ণ স্বর্ণসিংহ পুরস্কারের জন্য লড়ছে ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’। ছবিটি রেকর্ড ২৪ মিনিটের অভিবাদন পাওয়ায় সেই দৌড়ে স্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকছে বলা যায়। ২০২৬ সালের অস্কারে সেরা আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র বিভাগে তিউনিসিয়ার ছবিটি বড়সড় সাফল্য পাবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। ২০২৪ সালে অস্কারে সেরা প্রামাণ্যচিত্র বিভাগে মনোনীত হয় কাওতার বেন হানিয়ার ‘ফোর ডটার্স’। ২০২১ সালের অস্কারে আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র বিভাগে মনোনীত হয় তার পরিচালিত ‘দ্য ম্যান হু সোল্ড হিজ স্কিন’।

এদিকে ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’ ছবির স্বত্ব নিয়ে এখনও আমেরিকান কোনো পরিবেশনা সংস্থা আগ্রহ দেখায়নি। ইসরায়েলের সমালোচনামূলক চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তৃত পরিসরে মুক্তি পেতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখল নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘নো আদার ল্যান্ড’ গত মার্চে সেরা প্রামাণ্যচিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছে। সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা সত্ত্বেও আমেরিকার নামজাদা কোনও পরিবেশনা সংস্থা এর বিপণনে এগিয়ে আসেনি।

তবে উত্তর আমেরিকায় ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’ ছবির মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী কাওতার বেন হানিয়া। কারণ গত সপ্তাহে ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব’-এর সঙ্গে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হন আমেরিকার তারকা দম্পতি ওয়াকিন ফিনিক্স ও রুনি মারা, অস্কারজয়ী অভিনেতা ব্র্যাড পিট, মেক্সিকান পরিচালক আলফনসো কোয়ারন, ব্রিটিশ পরিচালক জনাথন গ্লেজার। তাদের মধ্যে ভেনিসে ফটোকল, লালগালিচা ও ছবিটির প্রদর্শনীতে অংশ নেন ওয়াকিন ফিনিক্স ও রুনি মারা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews