অসুস্থ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়, চিকিৎসক রোগীকে দেখে শুনে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেন, রোগী দোকান থেকে সে ওষুধ কিনে খায়Ñ এটিই সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ খেয়েও রোগ সারে না। ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ রোগ মুক্তি প্রলম্বিত করে, রোগের তীব্রতা বাড়াতে থাকে, শেষ পরিণতি চিরনিদ্রায় শায়িত করে। ভেজালের সমারোহে নতুন সংযোজন আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ। বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফার্মেসিতে। মাঝে-মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় ওষুধ প্রশাসন। আটক করা হয় সম্পূর্ণ অবৈধ বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল। শুধু ফার্মেসিতেই নয়, বিভিন্ন হোমিওপ্যাথির দোকানে কিংবা হেকিমি দাওয়াখানায় দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বলবর্ধক যৌনবর্ধক বিভিন্ন ওষুধ। ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে এগুলো অবাধে দেশে ঢুকছে। ওষুধ প্রশাসনের একটি ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি রয়েছে, কোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে অবশ্যই এ কমিটির অনুমতি প্রয়োজন।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিক্রির শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, দুর্বল বিচারব্যবস্থা, প্রভাবশালীদের অর্থলিপ্সা, শক্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রভৃতির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অসামর্থ্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং অজ্ঞতা ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধের বাজার বিস্তারের প্রধান কারণ। এর উপর ভর করছে ফার্মেসিতে ভয়ংকর ডাক্তারি। ৬৪ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা রোগের উপসর্গ শুনে নিজেরাই ওষুধ দেন। ৮৭ শতাংশ ওষুধ বেচেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া। যোগ্যতা ছাড়াই অবৈধভাবে ওষুধ বিক্রেতার কাজ করছেন ৫২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ওষুধ দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রুপের। অথচ বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতি অনুযায়ী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রেতা কর্তৃক কোনো রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া নিষেধ।

দেশে ওষুধ বিক্রির নামে অনাচার চললেও দেখার কেউ নেই। কর্মকর্তারা ফার্মেসি খোলার অনুমতি দিয়ে আয়েশে যখন অফিস করেন, তখন বিক্রেতারাই ডাক্তার সেজে বসে। স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ নানা ওষুধ তারা বিনা ব্যবস্থাপত্রে তুলে দেয় ক্রেতাদের হাতে। নি¤œমানের, এমনকি ভেজাল ওষুধ গছিয়ে দিতেও তাদের বাধে না। ফলে রোগমুক্তির বদলে অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা বাড়ছে। ভেজাল ওষুধে, অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটছে হরহামেশাই। বছরের পর বছর ধরে এমন নৈরাজ্য চলছে, গণমাধ্যমে খবর আসছে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা হচ্ছেÑ এটুকুই। সংকটের সমাধান মেলে না, দায়ী ব্যক্তিদের নেয়া হয় না কাঠগড়ায়।

ওষুধ হলো রাসায়নিক পদার্থ, যা সঠিক পরিমাণ, সঠিক মাত্রা, সঠিক রোগের জন্য গ্রহণ-সেবন এবং সঠিক মেয়াদ পর্যন্ত চালালে মানুষের জন্য কার্যকর। অপব্যবহারে জীবাণু ধ্বংস হয় না, বরং তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যদি মানসম্পন্ন না হয়, নি¤œমানের হয়, ভেজাল হয়, যথেচ্ছ ব্যবহার কিংবা নির্বিচারে প্রয়োগ, প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয় কিংবা কম দামী অন্য ওষুধ দিয়ে দেয়া হয়, তবে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। নকল ও নিষিদ্ধ ওষুধ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও মজুদ করার কাজে সমাজ বিরোধী চক্রের সাথে ওষুধের দোকানদারও সহযোগিতা করে থাকে। এর পরিণামে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে মানুষ।
মাদকাসক্তি আমাদের জাতীয় সমস্যা। তা এখন রাজধানী শহর অতিক্রম করে গ্রামের পাড়ায়, মহল্লায় প্রবেশ করেছে। এই দেশের তরুণ সমাজ ড্রাগ আসক্ত হয়ে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, যা পরিবারের কর্তা, সমাজসেবক, জাতীয় কর্ণধারগণকে ভাবিয়ে তুলছে। তরুণরা ড্রাগগুলো গ্রহণ করছে অসাধু ওষুধের দোকানদারদের কাছ থেকে, ওষুধ বিজ্ঞানে তাদের প্রশিক্ষণ না থাকাতে জাতির প্রতি তাদের কোন কমিটমেন্ট নেই। প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপশহরের প্রতিটি গলি উপগলিতে এক বা একাধিক এবং দেশের প্রতিটি গ্রামে বা পাড়ায় এক বা একাধিক ওষুধের দোকানসহ প্রায় ৬ লক্ষের মতো ফার্মেসি বিদ্যমান। একজন ওষুধ বিক্রেতার অবশ্যই ওষুধ সংরক্ষণ, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ ওষুধ বিক্রেতারই এ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান নেই। যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রি করছেন। ফার্মেসি চালানোর জন্য যে আইন রয়েছে তার খুবই কম মানা হচ্ছে।

রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় পৃথিবীর কোনো দেশেই হয় না। ব্যতিক্রম কেবলই আমাদের এ সোনার বাংলায়। ওষুধের সঠিক ব্যবহার এবং চিকিৎসকের নির্দেশমত নিয়ম পালনে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই একজন রোগী পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পেতে পারে। এই নিয়মটুকু বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যিনি ওষুধ বিক্রি করবেন তারই। আমাদের দেশে সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ গুণ ও মানসম্পন্ন কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার বা লোকবল ওষুধ প্রশাসনের নেই; যা আছে তা নিয়ে যদি তৎপর থাকত চাদাবাজি না করত তাহলে পরিস্থিতির এত অবনতি হতনা। এদিকে যে বা যারা ওষুধ বিক্রি করবেন তাদেরও যদি ওষুধ বিজ্ঞানের ন্যূনতম শিক্ষা প্রশিক্ষণ না থাকে পরিণতি তো ভয়াবহ হবেই। বলাবাহুল্য, অন্যান্য দ্রব্যের ত্রুটি ক্ষমা করা গেলেও ওষুধের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই করা যায় না। বিশ্বের সকল সভ্য দেশেই ওষুধ একটি বিশেষায়িত ও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য। ঐসব দেশ কোনো কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ তৈরি করার অনুমোদন দেয়া হয় না।

ওষুধের মতো সংবেদশীল পণ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। হাসপাতাল ক্লিনিক ওষুধের দোকান পরিচালনা ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিগুলোতে ওষুধ প্রস্তুতকরণে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। তাতে দরকার ৭ লাখ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট। ফার্মেসি কাউন্সিল স্বাধীনতার ৫০ বছরে তাদের ভাষায় শর্ট, লং, দীর্ঘ, সুদীর্ঘ মিলিয়ে ৯৫ হাজারের মতো ব্যক্তিকে ওষুধ জ্ঞানের আওতায় এনেছে মাত্র। ব্যর্থ ফার্মেসি কাউন্সিল আবার ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদানের মতো কান্ডজ্ঞানহীন কান্ডও করে যাচ্ছে অবলীলায়। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সার্টিফিকেট প্রদানের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠান বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়। ফার্মেসি কাউন্সিলের নীতিহীন অনৈতিক কাজের খেসারত দিচ্ছে এদেশের চিকিৎসাপ্রার্থী জনগণ। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আলাদা স্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড। যেমনটা আমাদের দেশেও অন্যান্য ডিপ্লোমা শিক্ষার ক্ষেত্রে চলমান। ওষুধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থার মতো সবক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত দক্ষ দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপরই নির্ভর করছে আমাদের নিরোগ স্বাস্থ্য, প্রশান্ত দেহমন আর সুস্থ সবল সৃজনশীল আগামী প্রজন্ম।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews