বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই সে তৎক্ষণাৎ বড় ড্রয়িংরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল, “কাতিয়া ঠিকই বলে, যদি আমার চোখগুলো বাইজেন্টাইনদের মতো না হয়ে থাকে, তাহলে তা পাগলের চোখ। আর আমি দেখতেও কেমন যেন, কেমন শুকনা, লম্বা, চঞ্চল, রোগা-পটকা একটি লোক! “ভ্রুগুলি কেমন কালো কোঁকড়ানো, আর চুলগুলি সোজা কালো! ঠিক সনকা যেমন বলে, ঘোড়ার চুলের মতো!”
তার বড় মুখটা নিয়েই সে হাসতে চাইল, “বালকসুলভ ও মনোগ্রাহী কেবলাভাব” যার জন্য কাতিয়া তাকে ভালোবাসতো। হাসলে তাকে ভালোলাগে বলে জোর করেই সে একটু হাসল। সে অনুভব করল, কীরকম বালকোচিত, নরম ও অবারিত ছিল সে।
তার পিছনে সে নগ্নপায়ে হাঁটার শব্দ শুনতে পেলো। অপ্রস্তুত ভাবে ঘুরে দাঁড়াল সে। “তুমি সবসময় নিজেকে আয়নায় দেখতে থাক, নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছ তুমি” পারাচা তাকে খোঁচা দিয়ে স্নেহের স্বরেই কথাটি বলল; সোপানের দিকে তড়িৎ গতিতে ফুটন্ত সামোভার হাতে নিয়ে যখন সে তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
চায়ের টেবিলে সামোভার পাত্রটি রাখতে রাখতে সে আরও বলছিল, “তোমার মা তোমাকে খুঁজছিল।” মিতিয়ার দিকে ঘুরে মর্মভেদী দৃষ্টি নিয়ে সে মিতিয়াকে দেখছিল।
মিতিয়া ভাবছিল, “সবাই সবকিছু জানে, সবাই সবকিছু বুঝতে পারছে।” তারপর নিজের স্বরের উপর জোর খাটিয়ে সে নিজেকে জিগ্যেস করল—
“কোথায় মা?”
“সে তার কক্ষে। এখন চা খাবে।”
সূর্যটা ঘুরে বাড়ির অন্যদিকে এসে পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। সোপানের ধাপের উপর পড়েছিল ফার ও পাইন গাছের হালকা ছায়া। কাঁটাযুক্ত কাঠের গাছের উপর সূর্যের আলো পড়ে আয়নার মতো জ্বলজ্বল করছিল, মধ্য গ্রীষ্মের কিরণের মতো। আংশিক ছায়াময় টেবিল ক্লথের এখানে ওখানে সূর্যের আলো পড়ে চকচকে ও জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছিল। টেবিলের উপর রাখা সাদা রুটি, কাপগুলি ও জ্যামভর্তি জারের উপর দিয়ে ভিমরুল উড়ে যাচ্ছিল। গ্রামাঞ্চলের এমন একটি গ্রীষ্মকাল যে কতটা সুখী, চমৎকার ও নির্ঝঞ্ঝাট হয়, তারই একটি দৃশ্যায়ন ছিল পুরো পরিবেশটিতে।
সে অবশ্যই তার মার কাছে যাবে, যে স্বাভাবিকভাবেই অন্য অনেকের চেয়ে বেশি বুঝবে তার কী হয়েছে। মিতিয়া তাকে বুঝাবে, তার কোনো গোপনীয় কিছু নেই। বসার ঘর ছেড়ে মিতিয়া পথের দিকে গেল, যে পথটি দিয়ে মায়ের কক্ষে যাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে অ্যানিয়া ও কষ্টিয়া যে কক্ষে থাকে সেদিকেই তার মায়ের কক্ষের দিকে এগোলো। যাবার পথটি ছিল অন্ধকার, আর তার মা ওলগা পেট্রোভানার কক্ষটি নীল রঙের দেখাচ্ছিল। কক্ষটি ছোটো, কিন্তু খুবই গোছানো, সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে সাজানো রয়েছে পুরানো আসবাবপত্র, কাজের টেবিল, দরাজ, বড় বিছানা ও একটি প্রতিমা, যার সামনে সারাক্ষণ একটি বাতি জ্বলছে। যদিও ওলগা পেট্রোভানা ধার্মিক কোনো মানুষ নন।
মূল প্রশস্ত রাস্তার শুরুতে অবহেলায় থাকা গাছের ফুলগুলোকে ঢেকে রেখেছিল বিস্তৃত ছায়া যা খোলা জানালার ওপাশে। ওই ছায়াময় জায়গাটুকু ছাড়া সবুজ ও সাদা বাগানটিকে সূর্যরশ্মি থেকে রক্ষা করার আর কোনো পথ নেই।
প্রাকৃতিক এসব দৃশ্যায়নে তিনি সম্পূর্ণই নির্বিকার, যদিও তিনি সবই জানেন।
ওলগা পেট্রোভানা, যিনি চল্লিশ বছর বয়সি একজন মহিলা, যিনি লম্বা ও পাতলা, কালো ও গম্ভীর ধরনের, যার চোখ চশমার পিছনে অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পায়, তিনি জানালার পাশে আরাম চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি নুয়ে নুয়ে সেলাই করছিলেন, তার সুই-সুতো দ্রুত চলছিল।
“ঘরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে মিতিয়া জিগ্যেস করল, “তুমি কি কিছু চেয়েছিলে মা?”
“না, আমি শুধু তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। তোমাকে শুধু রাতের খাবারের সময়ই দেখতে পাই।”
হাতের কাজটির কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তিনি উত্তরটা দিয়েছিলেন খুবই নির্লিপ্ত শান্ত স্বরে।
মিতিয়ার মনে পড়ল, মার্চের সেই নয় তারিখের কথা, যখন কাতিয়া বলেছিল, কোনো এক অজানিত কারণে সে তার মাকে ভয় করে। সে বুঝতে চাইল এই কথার গভীরে নিঃসন্দেহে লুকানো আছে এক স্নেহশীল আবেদন। সে তার মায়ের হাঁটুর উপরে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে চাইল। সে অপ্রীতিকরভাবে বিড়বিড় করল—
“তুমি বোধহয় কিছু বলতে চাও আমাকে?”
“না, আমার মনে হল তুমি একঘেয়েমিতে ভুগছ—ওলগা পেট্রোভানা উত্তর দিল। আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলিতে তুমি যেতে পার, যেমন: মেচারস্কিতে।” তারপর মুখে মুচকি হাসি টেনে বলল, “একটি বাড়িতে কয়েকটি বিবাহযোগ্য মেয়েও রয়েছে। আমি মনে করি, পরিবারটি খুব ভাল ও অতিথি পরায়ণ।”
নিজের উপর জোর খাটিয়ে সে বলল, আমি ওইদিকে যাব। “চল, আমরা সিঁড়িতে বসে চা খাই, ওই জায়গাটা খুব সুন্দর লাগছে। চা খেতে খেতে আমরা ওই সব বিষয়েও কথা বলতে পারব। যদিও সে ভাল করেই জানে তার মা অত্যন্ত কৌশলী ও বিচক্ষণ, ওইসব লক্ষ্যবিহীন বিষয়ে কথা বলার মানুষ তিনি নন।
ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত তারা সিঁড়ির ধাপেই বসে ছিল। চা পানের পর, মিতিয়ার মা উল বুনতে বুনতে, তাদের প্রতিবেশীদের বিষয়ে কথা বলতে লাগল এবং অ্যানা ও কষ্টিয়ার বিষয়েও কথা বলতে লাগল। অ্যানাকে আগস্টে পরীক্ষা দিতে যেতেই হবে, তাছাড়া বাড়ির বিষয়েও কিছু কথাবার্তা বললেন। মিতিয়া শুনছিল, মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছিল, এবং মস্কো থেকে চলে আসার আগের দিনটিকে অনুভব করছিল। তার মনে হলো সে একটি কঠিন অসুখের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন একটি বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সইতে হবে। নিশ্চয়ই মস্কোতে খুব ভয়ানক একটা কিছু ঘটেছে। এখনকার বিচ্ছেদের সময়টা এত কষ্টের যে একমাস আগের বিচ্ছেদটা মনে হচ্ছিল সুখের আশির্বাদের মতো।
তার মা উপরে চলে যাবার পর সে সামনে-পিছনে, ছোট ও বড় ড্রয়িং রুমের ভিতর দিয়ে, শোবার ঘরে, লাইব্রেরিতে, খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া বাড়ির দক্ষিণ দিকের বাগানে দুই ঘণ্টা ধরে হাঁটল। পাইন ও ফার গাছের ভিতর দিয়ে সূর্যাস্তের রং ড্রয়িং রুমের জানালাগুলিকে রক্তিমাভ করে তুলল। ভৃত্যদের ঘরের কাছে রাতের খাবারের জন্য জড়ো হওয়া শ্রমিকদের কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টা সে শুনতে পাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখছিল লাইব্রেরির জানালার ভিতর দিয়ে বর্ণহীন সন্ধ্যার আকাশি আকাশটাকে, আর একটি স্থির গতিহীন গোলাপি তারা। তার বিপরীত প্রেক্ষাপটে আকাশের আকাশি রঙের ভিতর ছবির মতো আঁকাছিল ম্যাপল গাছের সবুজ চূড়া আর বাগানের ফুলগুলির সাদা শুভ্রতা। কে কী ভাববে না ভাববে এসব না ভেবে সে শুধু হাঁটতেই থাকছিল। সে এমন ভাবে তার দাঁত খিঁচছিল, যেন তার মাথাব্যাথা।
এ পর্বের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ছাপানো শেষ হলো।