প্রকাশিত: রবিবার ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ:

অপ্রকাশ্য শয়তানের প্রকাশ্য দুশমনী সেই আদীকাল থেকেই শুরু। শেষ হবে না কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত। চারদিকে দেশে দেশে সেকেন্ডে সেকেন্ডে একসাথে চলমান সব হত্যা, জি¦না, ব্যাভিচার, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা,  নেশাখোরী সহ নানাবিধ অভিনব পাপাচারের যেসব অঘটন সারাক্ষণ চলছে। এ সবের মূল নায়ক এই অপ্রকাশ্য শয়তান। তার অপতৎপরতায় প্রতি মূহুর্তে জান্নাতী আদম সন্তানদের জাহান্নামী বানাতে ব্যাপক আয়োজন চলছে। ব্যক্তি, সমাজ আর রাষ্ট্র শক্তির মাধ্যমে পাপ বাড়ছে শয়তানের শিষ্য সাগরেদদের মাধ্যমেও। সেই শয়তানের সব চক্রান্ত থেকে সতর্ক থাকতেই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে যুগে যুগে নবী রাসূলের আগমন। পাঠানো হয়েছে কুরআন হাদীসের জান্নাতী হেদায়াতী বানী মালা। প্রধান শত্রু এই শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ হুশিয়ারী দিয়েছেন বারবার। 

মহান আল্লাহ পাক তার কালামে পাকে ঘোষণা করেন-“এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করিওনা। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (বাকারা-২০৮) প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় মানুষের বিরোধী সেরা দুশমন এই শয়তান। আল্লাহর সাথে সর্বপ্রথম সে শত্রুতায় লেগে যায়। প্রথম নবী আমাদের আদি পিতা আদম (আ:) এর সাথে দুশমনীতে লিপ্ত হয় আল্লাহর সেই সেরা জান্নাতে। শয়তান আদম (আ:) ও মা হাওয়া (আ:) কে শয়তান তার কূটচাল করে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত জান্নাত থেকে নাপাক দুনিয়ায় ফেলে দেয়ার আয়োজন করলো। শুধু তাই নয়, কিয়ামত পর্যন্ত সে আদম সন্তানদের পদস্খলিত করার পাকা উদ্যোগে নিয়ে তার মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। আমাদের সেই প্রকাশ্য শত্রু সম্পর্কে তাই সবার আগে জানা দরকার। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রধান শত্রু এই শয়তানের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতেই আমাদেরকে সর্বাধিক ভূমিকা নিতে হবে। তাঁর যাবতীয় কূটচাল থেকে আমাদেরকে আত্ম রক্ষা করতে হবে।  তাই শয়তানের বিপরীত পথে চলাই আমাদের জন্য সর্বাধিক জরুরী। দৃপ্ত শপথে প্রতিদিন হুশিয়ার হয়ে শয়তানের বিপক্ষে পা বাড়াতে হবে। 

বিশ^ নবী আমাদেরকে সর্ব প্রথম পদক্ষেপ নিতে বলেছেন বিশেষ দোয়া পড়ে। রাসূল (সা:) বলেছেন: “আউযু বিল্লাহিস সামিউল আলিমি মিনাশ শাইত্বানির রাজীম, মিন হামযিহী ওয়া নাফখিহী ওয়া নাফসিহ। অর্থ-মহাজ্ঞানী শ্রবনশীল আল্লাহ তায়ালার নিকট আমি বিতাড়িত শয়তানের প্রবঞ্চনা, কুমন্ত্রনা ও প্ররোচনা হতে আশ্রয় চাচ্ছি।  (আবু দাউদ ৭৭৫, তিরমিযী-২৪২)

শাতানুন ধাতু থেকে শয়তানের উৎপত্তি। শয়তান অর্থ হল সত্য ও উত্তম পথ থেকে দূরে সরে থাকা। তাই শয়তান বিতাড়িত, বিদূরিত, বঞ্চিত।

শয়তানের ইতিহাস

আদম সন্তানের প্রধান শত্রু এই শয়তান এককালে সেরা আবেদ ছিল। জমিনের একবিন্দু জায়গা খালি ছিল না। যেখানে সে আল্লাহর সিজদাহ করেনি। সে ছিল ফেরেস্তাকুলের নেতা। আগুনের তৈরী এই ফেরেস্তার নাম হল ইবলিশ। আদম (আ:) এর সৃষ্টির পূর্বে ফেরেস্তা জগতে সে ছিল সেরা আবেদ, যাহেদ, আরেফ, অলি, তক্বী, খাজেন, আযাযিল ইত্যাদি পদবীতে সম্মানিত। 

প্রথম আকাশে সেরা আবেদ হিসেবে তার সুপরিচিতি ছিল। এবাদতকারী হিসেবে তার চেয়ে বেশী আবেদ আর কেউ ছিল না। দ্বিতীয় আকাশে সে ছিল যাহেদ হিসেবে পরিচিত। যাহেদ মানে তাপস। সে একজন সেরা তাপসের মর্যাদায় পরিচিত ছিল। তৃতীয় আকাশে তার সুখ্যাতি ছিল আরেফ হিসেবে। আরেফ হল জ্ঞাত। সে ছিল সেরা জ্ঞানী। কোন কিছু তার অজ্ঞাত ছিল না। চতুর্থ আকাশে তার পরিচয় ছিল অলি হিসেবে। অলি মানে আল্লাহর প্রতিনিধি। সে ছিল আল্লাহর বন্ধু ও প্রতিনিধি। পঞ্চম আকাশে তার পরিচয় ছিল তক্কী হিসেবে। তক্কী হল মোত্তাকী বা খোদাভীরু। সে ছিল সেখানে সেরা খোদাভীরু হিসেবে বিখ্যাত। ষষ্ঠ আকাশে তার পরিচয় ছিল খাজেন হিসেবে। খাযেন মানে প্রহরী। বিচক্ষণ যোগ্যতার কারণে তাকে প্রহরীর দায়িত্ব দেয়া হয়। সপ্তম আকাশে তার পরিচয় ছিল আযাযিল হিসেবে।  ফেরেস্তারা ছিল নূরের তৈরী। আর সে হল আগুনের তৈরী। আগুনের তৈরী হয়েও সে আকাশের সব ফেরেস্তাদের নেতা ছিল। তার খাদ্য হল হাড়, গোবর ইত্যাদির ঘ্রাণ আর বিসমিল্লাহ বর্জিত খাদ্য। সে ৮০ হাজার বছর আল্লাহর এবাদত করে জান্নাতের দ্বার রক্ষকের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। 

আদি পিতা আদম (আ:) কে আল্লাহ পাক খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করলেন। তাকে আল্লাহ পরম শান্তির স্থান জান্নাতে বাসস্থান করে দিলেন। পরে হাওয়া (আ:) কেও তাঁর সাথী বানিয়ে দিলেন যাতে সুখ শান্তির কমতি না হয়। আল্লাহ দিলেন আংগুর, বেদানা, কমলা, নাসপতি, কলা, আম, জাম, কাঠালসহ অগনিত ফুল ফলে ভরপুর জান্নাত। সেখানে আদম হাওয়া (আ:) প্রাণ ভরে সুখে শান্তি ভোগ করছিলেন। যখন যা মনে চাইতো অমনি তা আপনা আপনি সুখের কাছে চলে আসতো। সুখের উপরে সুখ। ভোগের পরে ভোগ। মহান আল্লাহ পাক্ সবই তাদের জন্য হালাল করে দিলেন। কিন্তু একটি মাত্র গাছ দেখিয়ে আল্লাহ পাক উহার কাছে যেতে নিষেধ করলেন। মুখের জান্নাতে আদম হাওয়া (আ:) মনের আনন্দে থাকতে থাকলেন। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। ফেরেস্তা সর্দার ইবলিশ অহংকারী হয়ে উঠলো।  সে আদম হাওয়ার পিছনে লেগে গেল। আদম হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের করার কূটচাল আটতে লাগলো। সেই নিষিদ্ধ গাছের প্রতিই তাদেরকে আকৃষ্ট করতে নানান ধরনের প্রলোভন দেখাতে ব্যস্ত। 

কুরআন পাকে সূরা বাকারায় আদম (আ:) এর সৃষ্টি রহস্যসহ শয়তানের ঘটনা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-“তিনি নির্দেশ দিলেন, হে আদাম এ জিনিস গুলির নাম তাদের জানিয়ে দাও। যখন সে এ সকল নাম তাদের বলে দিল, তখন তিনি বললেন আমি কি তোমাদের বলিনি যে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা প্রকাশ করো ও গোপন করো আমি তাও অবগত। যখন আমি ফেরেস্তাগণকে বললাম আদমকে সিজদাহ করো, তখন ইবলিস ছাড়া সকলেই সিজদাহ করলো। সে অমান্য করলো। কাজেই সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। আমি বললাম, হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো যেখানে যা ইচ্ছা খাও। কিন্তু ঐ গাছের নিকটে যেয়ো না। গেলে তোমরা সীমালংঘনকারীদের মধ্যে শামিল হবে। কিন্তু শয়তান তা থেকে তাদের পদস্খলন ঘটালো। এবং তারা দুজন যেখানে ছিল তাদের সেখান থেকে বের করে দিল। আমি বললাম নেমে যাও। তোমরা পরস্পরের শত্রু, দুনিয়াতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা আছে। (বাকারা-৩৩-৩৬)

শয়তানের অবকাশ

জান্নাতে আদম হাওয়া (আ:) আর থাকতে পারলো না। শয়তান তাদের পদস্খলিত করলো। তার অহংকারের কাছে আদমের সরলতা হেরে গেল। আল্লাহর ইচ্ছায় সে দুনিয়ায় আগমন করলো। সূরা আরাফের ১৩-১৮ আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তা হল “তিনি বললেন, (শয়তান) নেমে যাও এখান থেকে, এর ভিতরে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। অতএব বেরিয়ে যাও, অধমদের মাঝে তোমার স্থান, সে বললো তাহলে যে দিন সবাই দুনিয়া ছেড়ে উঠবে সেদিন পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বললেন, যাদের অবকাশ দেওয়া হয়েছে তুমি তাদের মধ্যে। সে বলল, যেহেতু পথ থেকে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছো, কাজেই আমি অবশ্যই তোমার সরল পথে মানুষদের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকবো। তারপর আমি তাদের সামনে দিয়ে তাদের পেছনে দিয়ে, তাদের ডান দিয়ে, তাদের বাম দিয়ে, তাদের কাছে অবশ্যই আসবো, তুমি তাদের অধিকাংশকেই শোকর আদায়কারী পাবে না। তিনি বললেন, ধিকৃত আর বিতাড়িত হয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাও, তাদের মধ্যে যারা তোমাকে মান্য করবে তোমাদের সবাইকে দিয়ে আমি অবশ্যই জাহান্নাম ভর্তি করবো।

 সেই থেকে আদম সন্তানদের পদস্খলিত করার জন্য নানা ভাবে শয়তান তার টার্গেট পূরণে ব্যস্ত সারাক্ষণ। চলবে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত। আল্লাহর দেয়া সব সুযোগ সুবিধাই সে কাজে লাগাছে বুদ্ধিমত্তার সাথে। শয়তান যে সব অবকাশ পেলো: 

১। সে কিয়ামত পর্যন্ত হায়াত পেলো। 

২। তার রিজিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

৩। তাকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছে। 

৪। মানব দেহের শিরায় শিরায় রক্তের চলাচলের সাথে সে চলতে পারে যে কোন সময়। 

মহান আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা

কালামে পাকে সূরা হাজ¦  এর ৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন-“শয়তানের সম্পর্কে বিধান করা হয়েছে যে, যে কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব গড়বে, সে তাকেই বিপথগামী করবে। আর তাকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শাস্তির দিকে পরিচালিত করবে। সূরা বাকারার ২০৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন, এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করিও না”। নিশ্চিয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। কুরআন পাকে বিভিন্ন সূরায় আরো অনেক নিষেধাজ্ঞা করে আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জ¦ীন জাতিকে শুধু আল্লাহর গোলামী করার হুকুম দিয়েছেন। 

শুধু আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও

সূরা মুমিনুন এর ৯৭-৯৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন-“আর বল: হে আমার প্রতিপালক। আমি শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি হে আমার প্রতিপালক যাতে তারা অর্থাৎ শয়তান আমার কাছে আসতে না পারে। 

শয়তানের অনিষ্ঠ থেকে বাঁচার উপায়

আল্লাহ পাক বলেন, “যখন কুরআন পাঠ কর, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। (আন-নহল-৯৮)

শয়তানের অনিষ্ঠ থেকে বাঁচার জন্য সর্বদা পড়তে হবে: 

১। সুবহানাল্লাহ

২। আস্তাগফিরুল্লাহ

৩। লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ 

৪। আল্লাহু আকবার

৫। আয়াতুল কুরসি।

রাসূলুল্লাহ (সা;) বলেন-সূর্যাস্তের পর আধাঘন্টা পর্যন্ত ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখবে এবং বাচ্ছাদেরকে ঘরের বাহিরে যেতে দিবে না। কারণ এ সময় শয়তান চলাচল করে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখলে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews