এটাই একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়াসা-ফু’য়াসা জাতীয় সেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মতৎপরতা। এসব কারণে মিরপুর সড়কে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, যাকে বলে একেবারে নৈরাকার অবস্থা! বাসে এ সড়ক অতিক্রমকালে ধুলার ঘূর্ণিপাক নাকে মুহুর্মুহু ঢুস মারে। বারকয়েক হেঁইচ্চো-হেঁইচ্চো শেষে নাকের সুড়সুড়ানি ভাব কমে গেলেও আমার ভয় অন্য জায়গায়। ফুসফুসে বিরামহীনভাবে নিকোটিনের পলি জমছে। নিকোটিন ও ধুলাবালি মিলে চুন-সুরকির মিশ্রণের মতো জমাট আস্তরণ তৈরি করলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর আশংকা প্রবল। এত তাড়াতাড়ি মরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
বাসযাত্রীদের মধ্যে যেসব নারী বোরকা পরেছেন, তারা ধুলাবালি থেকে সুরক্ষিত। বোরকা সুবিধার আওতায় না থাকায় বাসের জানালা বন্ধ করে ধুলার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছি। খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য বাসের কন্ডাক্টর দরজা খোলা রেখেছে। খোলা দরজা দিয়ে বাসের ভেতর হু-হু করে শুধু বাতাস ঢুকছে না, ঢুকছে ধুলাবালিও।
আগে এ সড়কে প্রায় প্রতিদিনই নাক-মুখ আবৃত করার সাজ-সরঞ্জাম বিক্রেতাদের দেখা মিলত। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরুর পর হারিকেন জ্বালিয়ে তাদের খুঁজছি, পাচ্ছি না। যখন দরকার ছিল না, তখন তারা ‘মাস্ক-মাস্ক’ সুর তুলে মাছির মতো নাকের সামনে ভনভন করেছে। এখন দরকার, আর তারা লাপাত্তা। এর কোনো মানে হয়?
ফুটপাতে এক লোক গামছা বিক্রি করছে। গামছা মাস্কের বিকল্প হতে পারে না? মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির কামড় এড়াতে গামছা দিয়ে মাথা ও নাক-মুখ ঢেকে রাখে। মৌমাছির কামড়ের দৌড় চামড়া পর্যন্ত। ধুলাবালি সরাসরি ফুসফুসে কামড় বসাবে। এ যুক্তি বিবেচনায় আনলে মিরপুর সড়কে চলাচলকারীদের এখন ত্রিপল দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা উচিত।
প্রতিদিনের বাসযাত্রা অস্বাস্থ্যকর, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ও নিরানন্দময়। হঠাৎ একটা বিষয় পেলাম। দেখি, এটাকে অবলম্বন করে আজকের বাসযাত্রা কিছুটা আনন্দময় করে তোলা যায় কিনা! কন্ডাক্টর ভাড়া চাইল। কিছুক্ষণ আগে আবিষ্কৃত বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। বকের বাচ্চার মতো নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম,
: স্টুডেন্ট।
বর্ষাকালের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙরত ব্যাঙের মতো চোয়াল ফুলিয়ে কন্ডাক্টর বলল,
: এই গাড়িতে হাফপাস নাই। ওই যে দেখেন, লেখা আছে।
কন্ডাক্টর নির্দেশিত স্থানের দিকে তাকালাম। সেখানে একটা স্টিকার শোভা পাচ্ছে। তাতে লেখা হাফপাস নাই।
কন্ডাক্টর টাকার জন্য হাত পেতে আছে, অনেকটা ট্রেন আসার আগে রেলবাহিনীর সিগন্যাল তোলার মতো। কন্ডাক্টরের আপ সিগন্যাল ডাউন করে দিয়ে বললাম,
: তুমি আছো হাফপাস লইয়া? আরে মিয়া, আমি তো ফুলপাস স্টুডেন্ট।
কন্ডাক্টরের চেহারা দেখে মনে হল, এমন কথা সে বাপের জন্মে শুনেনি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করে সে বলল,
: ভাই, পুরা গাড়ির ভাড়া কাটন লাগব। বিটলামি রাইখ্যা ভাড়া দেন।
রূপ পাল্টালাম। নিরীহ বকের বাচ্চা থেকে কাঁটাসজ্জিত সজারু হলাম। বললাম,
: তুমি কিন্তু আমারে ডাইক্যা আইন্যা অপমান করতেছ!
বাসচালক একটু পরপর চোখ তুলে লুকিং গ্লাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এবার সে মুখ খুলল। কন্ডাক্টরের নাম উচ্চারণ করে জিজ্ঞেস করল,
: ওই জইল্যা, কী হইছে?
জইল্যা মানে জলিল। জলিল মুখ খোলার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারের উদ্দেশে বললাম,
: ভাই, এই বাসের গায়ে লেখা আছে- কাম টু লার্ন, গো টু হেল্প। লেখাটা পইড়া আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হইছি। কিছু শেখার আশায় আপনাদের দ্বারস্থ হইছি। এখন আপনেই বলেন, যে মানুষ কোনো কিছু শিখতে চায়, তারে স্টুডেন্ট বলা যায় কিনা?
লুকিং গ্লাসে ড্রাইভার আমার চেহারা মাপল। মাপামাপি শেষ করে বলল,
: কী শিখবার চান?
- প্রথমেই ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স সম্পন্ন করতে চাই। আপনারা যে ভাষা ব্যবহার করেন, বর্তমান যুগে তা আয়ত্ত করা অতি জরুরি। আমার আব্বা বলেন, সত্যযুগ গেছে, কলিযুগ গেছে; এখন হইল দাপটের যুগ। এই যুগে ‘অই পুঙ্গির পুত, কী কস’ বইলা আওয়াজ তুললে সব ঠাণ্ডা। আপনেরা হইলেন, দাপইট্যা যুগের হেডমাস্টর; গরু ও ছাগল ছাড়া আর কোনোকিছুরে গুনতির মধ্যে আনেন না। কাজেই ভাষাশিক্ষাসহ অন্যান্য শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে আপনেরাই হইলেন উপযুক্ত গুরু। আমার এর পরের শিখন তালিকায় আছে ঘষা মারার কলাকৌশল। আপনেরা যেভাবে ঘষা মাইরা অন্য যানবাহনের বডির ছাল তুইল্যা ফেলেন, সেই ছাল তোলা বিদ্যা আমারও শেখা দরকার। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর কেউ আমার সঙ্গে তেড়িবেড়ি করতে আসলে আমিও ঘষা মাইরা তার ছাল তুইল্যায়ালবাম। ঘষা বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার পর চাপ মারার কায়দা-কানুন শিখব। আপনেরা যেভাবে চাপ দিয়া অন্য গাড়ির চালকদের টাইট দেন, আমিও আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপ মাইরা হাড্ডি-গুড্ডি ছাতু বানায়ালবাম। ছাতু বিদ্যায় কামিয়াব হওয়ার পর আমি ওভারটেকিংয়ের সাহস ও দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেব। ওভারটেকিং বিদ্যা জানা না থাকার কারণে আমারে সাইডে রাইখ্যা সবাই আগাইয়া যাইতেছে। আমি ক্রমাগতভাবে পিছনে পইড়া যাইতেছি। আমারও আগাইয়া যাওয়া দরকার...
ড্রাইভার বাদে বাসের অন্য সবার মুখে হাসি ফুটল। কন্ডাক্টরের মুখেও গুয়ামুড়ি টাইপের হাসি ঝিলিক দিল। যাক, প্রায় সবাই আমার কথা শুনে খুশি হয়েছে- এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়েছি, ড্রাইভার তার সহকর্মীর উদ্দেশে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল,
: অই জইল্যা, পাগল-ছাগল বাদ দিয়া অন্য প্যাসেঞ্জারের ভাড়া কাট।
আচমকা ব্রেক কষে বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার আমাকে ঘাড় ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেবে নাকি? দেখলাম, আমার অনুমান সত্য নয়। বাসে দু’জন যাত্রী উঠলেন। বয়স্ক এক পুরুষ, সঙ্গে মধ্যবয়সী নারী। নারী আমার পাশের খালি সিটটায় বসলেন। কন্ডাক্টর পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
: চাচা, পিছনে সিট খালি আছে; সিটে আইসা বসেন।
ভদ্রলোক অগ্রসর হলেন না, দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি পাশের ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিলেন। আজকাল যাত্রীবাহী যানবাহনে হকাররা বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে। এছাড়া নানা কিসিমের সাহায্যপ্রার্থীরও দেখা মিলে। কারও জটিল রোগ, কারও চোখে আলো নেই, কারও শরীরের অঙ্গহানি ঘটেছে, আবার কেউ আসেন মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাতের আবেদন নিয়ে। ভদ্রলোকের বেশভুষা দেখে সাহায্যপ্রার্থী বলে মনে হচ্ছে না। সত্য প্রকাশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি, ভদ্রলোক যাত্রীদের সালাম নিবেদন করে বললেন,
: আমার নাম মো. মাহবুব-উল-আলম। ঠিকানা- সাভার, নবীনগর। দয়া করে আমাকে কেউ মিসকিন ভাববেন না। আমি বেশিক্ষণ আপনাদের বিরক্ত করব না।
স্পষ্ট উচ্চারণ। চমৎকার বাচনভঙ্গি। ভদ্রলোককে রহস্যমানব বলে মনে হচ্ছে। রহস্যের শেষ ভাঁজটি না খোলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। রহস্যমানব স্মৃতি হাতড়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলেন। মনে হল, খুঁজে পেয়েছেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, রহস্যমানব উচ্চারণ করলেন,
: আমরা আইনের কথা বলি। আইনের শাসনের কথা বলি। কিন্তু কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন? এই দেশে সড়কপথে যাতায়াতের সময় প্রতিদিন ২শ’র বেশি মানুষ আহত ও নিহত হয়। আজ পর্যন্ত তাদের কতজন ন্যায়বিচার পেয়েছে, এ তথ্য কি আপনাদের কারও জানা আছে? মহামান্য আদালত সম্প্রতি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের হত্যাকারী বাসচালকের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পর খুলনা বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। খুলনা দিয়ে শুরু হলেও এরা এক সময় সারা দেশ অচল করে দিতে পারে। তাদের সেই ক্ষমতা আছে। আইন-বিচার ও শাসনের বদলে যেহেতু সর্বত্র ক্ষমতা প্রদর্শনের চর্চা হচ্ছে, আমিও আপনাদের কাছে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা কর্মসূচি নিয়ে এসেছি।
মনে হচ্ছে, রহস্যমানবের সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। আমি সম্মোহিতের ন্যায় বললাম,
: কী কর্মসূচি!
- এটি হল একটি জনহিতকর কর্মসূচি। এ কর্মসূচি কথিত সিটিং সার্ভিস নামধারী বাসে যাতায়াতকারী মানুষ ও বাসমালিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। আপনারা জানেন, বাসমালিকরা এ খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তবে অতি দুঃখজনক বিষয় হল, এত পয়সাকড়ি বিনিয়োগ করেও বাসমালিকরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিন্তা করে দেখুন, বাসমালিক ও যাত্রীসাধারণরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শুধুমাত্র বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার ও ড্রাইভারের অবৈধ কর্মকাণ্ড তথা অর্থলোভের কারণে। যেসব যাত্রী মুখ বুজে এসব অনিয়ম সহ্য করতে পারেন না, অনেক সময় তারা মারমুখী হয়ে ওঠেন। এর ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ালে চলে ভাংচুর। এর ফলে যাত্রীদের অন্য বাসে ওঠার ভোগান্তি পোহানো ছাড়াও অর্থদণ্ডের শিকার হতে হয়। দেখুন, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল ওই বাসটির মালিক ও যাত্রীরা। অথচ এর জন্য দায়ী ড্রাইভার ও তার সহযোগীরা। এদের অর্থলোভের কারণে দিনের পর দিন গাড়ির মালিক ও যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে- এটা কেমন কথা? এজন্য আমি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি।
অসীম কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম,
: কী পদ্ধতি?
- উম পদ্ধতি।
উম দেয়ার প্রতিশব্দ হচ্ছে উষ্ণ বা গরম করা। এ শব্দটি মুরগির ডিমে তা দেয়ার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বললাম,
: উম দেয়া তো মুরগির কাজ!
- হতে পারে মুগরির কাজ। তবে ভয় নেই, এজন্য মুরগির মতো ঠ্যাং ভাঁজ করে আপনাদের কুট-কুট করতে হবে না।
: তাহলে কী করতে হবে?
- যখন দেখবেন, নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বাসের মধ্যে ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠানো হচ্ছে এবং যাত্রী উঠানোর জন্য স্টপেজ ছাড়াও যেখানে খুশি বাস থামানো হচ্ছে, তখন আপনারা দাঁড়িয়ে যাবেন। যাত্রীদের উদ্দেশে সালাম দিয়ে বলবেন, সম্মানিত যাত্রী ভাইয়েরা, একটু খেয়াল করেন। দ্রুত ও আরামে যাওয়ার জন্য আমরা অধিক ভাড়া প্রদান করে এই বাসে উঠেছি। অথচ দেখুন, কিভাবে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। না আছে আমাদের বাড়তি টাকা ও সময়ের মূল্যায়ন, না আছে একটু আরাম। বাসমালিকরা ড্রাইভারি করে না, তাই বাসমালিকরা এজন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। এ বাক্য দুটি দু’বার উচ্চারণ করতে হবে।
সবকিছু নাটকীয় মনে হচ্ছে। আমার কি উচিত হবে এর সঙ্গে যোগ দেয়া? মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে সময় লাগল না। যন্ত্রচালিতের ন্যায় পরপর দু’বার উচ্চারণ করলাম,
: বাসমালিকরা ড্রাইভারি করে না, তাই বাসমালিকরা এজন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়।
কর্মসূচির প্রতি আগ্রহী অন্তত একজন মানুষের দেখা পেয়ে রহস্যমানবের মুখে হাসি ফুটল। তিনি পুনরায় বললেন,
: এরপর দু’বার বলতে হবে- বাস একটা যন্ত্র, এটা নিজে চলতে পারে না; তাই কোনো ঘটনার জন্য বাসও কোনোভাবেই দায়ী নয়।
মন্ত্রমুগ্ধের আমি উচ্চারণ করলাম,
: বাস একটা যন্ত্র, এটা নিজে চলতে পারে না; তাই কোনো ঘটনার জন্য বাসও কোনোভাবেই দায়ী নয়...
রহস্যমানব এবার বললেন,
: এরপর বলতে হবে, এজন্য দায়ী হল বাসের অসৎ ও অর্থলোভী ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপার। অতএব আসুন, আমরা সবাই মিলে এদের উম দিই। উম সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে তাকে বুঝিয়ে বলবেন, উম মানে ডিমে তা দেয়া নয়। উম শব্দের মানে হচ্ছে- উ-তে ‘উত্তম’ এবং ম-তে ‘মধ্যম’ অর্থাৎ উত্তম-মধ্যম। তবে ভাইয়েরা, মেহেরবানি করে গাড়ির গ্লাসে একটা ফুলের টোকাও দিবেন না। কারণ গাড়ি এবং গাড়ির মালিক নির্দোষ। উম সম্পর্কে যাত্রীদের পরিষ্কার ধারণা দেয়ার পর সবাই মিলে বাসটিকে রাস্তার একপার্শ্বে থামাবেন। কারণ চলন্ত গাড়িতে ‘উম’ দিতে গেলে দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। সাবধান! ড্রাইভার জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে। অতএব সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া পালানোর কৌশল হিসেবে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও্র হেলপার কান্নাকাটি করে মাফ চাইতে পারে। তাদের মায়াকান্নায় প্রভাবিত হওয়া যাবে না। মন শক্ত রাখতে হবে। মন শক্ত করে অর্থলোভী কন্ডাক্টর, হেলপার ও ড্রাইভারকে এমন কড়া ডোজের উম দিতে হবে, যাতে তাদের থুতনির রেলিং, যেটাকে দাঁতের পাটি বলি, তা ভেঙে যায়। এর ফলে অন্যায়ভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের পোলাও-বিরিয়ানিসহ মজাদার খাবার আয়েশ করে চিবিয়ে খেতে খুব অসুবিধা হবে এবং উম কী জিনিস, তা তারা বাকি জিন্দেগি মনে রাখবে। আরেকটা প্রয়োজনীয় বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। উম দেয়ার সময় যদি পুলিশ উপস্থিত হয়, তাহলে তাদেরও উম কাজে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। যদি তারা বাধা দেয়, তাহলে জোরে জোরে বলতে হবে- পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা জনগণের বন্ধু। উম কাজে বাধা দিলে প্রমাণ হয়ে যাবে, আপনারা জনগণের বন্ধু নন, বরং চোর-বাটপারদের বন্ধু এবং সাহায্য ও সহযোগিতাকারী...
পাশের ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম,
: ওনি কী আপনার...
- আমার শ্বশুর।
: ওনার বিষয়টা একটু খুলে বলেন তো!
ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
: মানুষের সেবা করার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন হবে, এ ভাবনা থেকে আমার শ্বশুর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটা বাস কিনেছিলেন। কিছুদিন চলার পর চালকের খামখেয়ালিতে সেই বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়, অনেকেই আহত হয়। এ ঘটনার পর আমার শ্বশুর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। এখন দিনে অন্তত একবার তাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। তিনি বাসে উঠে যাত্রীদের সচেতন করতে যেসব কথা বলেন, তা তো আপনি এতক্ষণ শুনলেন।
বাসের ড্রাইভার মহাবিরক্ত। পরের স্টপেজে ভদ্রমহিলা ও তার শ্বশুর নেমে যেতেই সে বলল,
: ইঃ। কী আমার জ্ঞানী রে! আর কোনো কাম নাই, পাবলিকরে জ্ঞান দিতে আইছে।
ড্রাইভারের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম, মধ্যবয়স্ক এক রমণী ফুটপাত অতিক্রম করছেন। তার পাশে একজন বৃদ্ধ। রমণী পরম মমতায় বৃদ্ধের একটা হাত ধরে রেখেছেন...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
[email protected]




মেট্রোরেল আসছে...এটাই একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়াসা-ফু’য়াসা জাতীয় সেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মতৎপরতা। এসব কারণে মিরপুর সড়কে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, যাকে বলে একেবারে নৈরাকার অবস্থা! বাসে এ সড়ক অতিক্রমকালে ধুলার ঘূর্ণিপাক নাকে মুহুর্মুহু ঢুস মারে। বারকয়েক হেঁইচ্চো-হেঁইচ্চো শেষে নাকের সুড়সুড়ানি ভাব কমে গেলেও আমার ভয় অন্য জায়গায়। ফুসফুসে বিরামহীনভাবে নিকোটিনের পলি জমছে। নিকোটিন ও ধুলাবালি মিলে চুন-সুরকির মিশ্রণের মতো জমাট আস্তরণ তৈরি করলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর আশংকা প্রবল। এত তাড়াতাড়ি মরে যাওয়া কি ঠিক হবে?বাসযাত্রীদের মধ্যে যেসব নারী বোরকা পরেছেন, তারা ধুলাবালি থেকে সুরক্ষিত। বোরকা সুবিধার আওতায় না থাকায় বাসের জানালা বন্ধ করে ধুলার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছি। খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য বাসের কন্ডাক্টর দরজা খোলা রেখেছে। খোলা দরজা দিয়ে বাসের ভেতর হু-হু করে শুধু বাতাস ঢুকছে না, ঢুকছে ধুলাবালিও।আগে এ সড়কে প্রায় প্রতিদিনই নাক-মুখ আবৃত করার সাজ-সরঞ্জাম বিক্রেতাদের দেখা মিলত। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরুর পর হারিকেন জ্বালিয়ে তাদের খুঁজছি, পাচ্ছি না। যখন দরকার ছিল না, তখন তারা ‘মাস্ক-মাস্ক’ সুর তুলে মাছির মতো নাকের সামনে ভনভন করেছে। এখন দরকার, আর তারা লাপাত্তা। এর কোনো মানে হয়?ফুটপাতে এক লোক গামছা বিক্রি করছে। গামছা মাস্কের বিকল্প হতে পারে না? মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির কামড় এড়াতে গামছা দিয়ে মাথা ও নাক-মুখ ঢেকে রাখে। মৌমাছির কামড়ের দৌড় চামড়া পর্যন্ত। ধুলাবালি সরাসরি ফুসফুসে কামড় বসাবে। এ যুক্তি বিবেচনায় আনলে মিরপুর সড়কে চলাচলকারীদের এখন ত্রিপল দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা উচিত।প্রতিদিনের বাসযাত্রা অস্বাস্থ্যকর, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ও নিরানন্দময়। হঠাৎ একটা বিষয় পেলাম। দেখি, এটাকে অবলম্বন করে আজকের বাসযাত্রা কিছুটা আনন্দময় করে তোলা যায় কিনা! কন্ডাক্টর ভাড়া চাইল। কিছুক্ষণ আগে আবিষ্কৃত বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। বকের বাচ্চার মতো নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম,: স্টুডেন্ট।বর্ষাকালের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙরত ব্যাঙের মতো চোয়াল ফুলিয়ে কন্ডাক্টর বলল,: এই গাড়িতে হাফপাস নাই। ওই যে দেখেন, লেখা আছে।কন্ডাক্টর নির্দেশিত স্থানের দিকে তাকালাম। সেখানে একটা স্টিকার শোভা পাচ্ছে। তাতে লেখা হাফপাস নাই।কন্ডাক্টর টাকার জন্য হাত পেতে আছে, অনেকটা ট্রেন আসার আগে রেলবাহিনীর সিগন্যাল তোলার মতো। কন্ডাক্টরের আপ সিগন্যাল ডাউন করে দিয়ে বললাম,: তুমি আছো হাফপাস লইয়া? আরে মিয়া, আমি তো ফুলপাস স্টুডেন্ট।কন্ডাক্টরের চেহারা দেখে মনে হল, এমন কথা সে বাপের জন্মে শুনেনি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করে সে বলল,: ভাই, পুরা গাড়ির ভাড়া কাটন লাগব। বিটলামি রাইখ্যা ভাড়া দেন।রূপ পাল্টালাম। নিরীহ বকের বাচ্চা থেকে কাঁটাসজ্জিত সজারু হলাম। বললাম,: তুমি কিন্তু আমারে ডাইক্যা আইন্যা অপমান করতেছ!বাসচালক একটু পরপর চোখ তুলে লুকিং গ্লাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এবার সে মুখ খুলল। কন্ডাক্টরের নাম উচ্চারণ করে জিজ্ঞেস করল,: ওই জইল্যা, কী হইছে?জইল্যা মানে জলিল। জলিল মুখ খোলার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারের উদ্দেশে বললাম,: ভাই, এই বাসের গায়ে লেখা আছে- কাম টু লার্ন, গো টু হেল্প। লেখাটা পইড়া আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হইছি। কিছু শেখার আশায় আপনাদের দ্বারস্থ হইছি। এখন আপনেই বলেন, যে মানুষ কোনো কিছু শিখতে চায়, তারে স্টুডেন্ট বলা যায় কিনা?লুকিং গ্লাসে ড্রাইভার আমার চেহারা মাপল। মাপামাপি শেষ করে বলল,: কী শিখবার চান?- প্রথমেই ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স সম্পন্ন করতে চাই। আপনারা যে ভাষা ব্যবহার করেন, বর্তমান যুগে তা আয়ত্ত করা অতি জরুরি। আমার আব্বা বলেন, সত্যযুগ গেছে, কলিযুগ গেছে; এখন হইল দাপটের যুগ। এই যুগে ‘অই পুঙ্গির পুত, কী কস’ বইলা আওয়াজ তুললে সব ঠাণ্ডা। আপনেরা হইলেন, দাপইট্যা যুগের হেডমাস্টর; গরু ও ছাগল ছাড়া আর কোনোকিছুরে গুনতির মধ্যে আনেন না। কাজেই ভাষাশিক্ষাসহ অন্যান্য শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে আপনেরাই হইলেন উপযুক্ত গুরু। আমার এর পরের শিখন তালিকায় আছে ঘষা মারার কলাকৌশল। আপনেরা যেভাবে ঘষা মাইরা অন্য যানবাহনের বডির ছাল তুইল্যা ফেলেন, সেই ছাল তোলা বিদ্যা আমারও শেখা দরকার। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর কেউ আমার সঙ্গে তেড়িবেড়ি করতে আসলে আমিও ঘষা মাইরা তার ছাল তুইল্যায়ালবাম। ঘষা বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার পর চাপ মারার কায়দা-কানুন শিখব। আপনেরা যেভাবে চাপ দিয়া অন্য গাড়ির চালকদের টাইট দেন, আমিও আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপ মাইরা হাড্ডি-গুড্ডি ছাতু বানায়ালবাম। ছাতু বিদ্যায় কামিয়াব হওয়ার পর আমি ওভারটেকিংয়ের সাহস ও দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেব। ওভারটেকিং বিদ্যা জানা না থাকার কারণে আমারে সাইডে রাইখ্যা সবাই আগাইয়া যাইতেছে। আমি ক্রমাগতভাবে পিছনে পইড়া যাইতেছি। আমারও আগাইয়া যাওয়া দরকার...ড্রাইভার বাদে বাসের অন্য সবার মুখে হাসি ফুটল। কন্ডাক্টরের মুখেও গুয়ামুড়ি টাইপের হাসি ঝিলিক দিল। যাক, প্রায় সবাই আমার কথা শুনে খুশি হয়েছে- এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়েছি, ড্রাইভার তার সহকর্মীর উদ্দেশে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল,: অই জইল্যা, পাগল-ছাগল বাদ দিয়া অন্য প্যাসেঞ্জারের ভাড়া কাট।আচমকা ব্রেক কষে বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার আমাকে ঘাড় ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেবে নাকি? দেখলাম, আমার অনুমান সত্য নয়। বাসে দু’জন যাত্রী উঠলেন। বয়স্ক এক পুরুষ, সঙ্গে মধ্যবয়সী নারী। নারী আমার পাশের খালি সিটটায় বসলেন। কন্ডাক্টর পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,: চাচা, পিছনে সিট খালি আছে; সিটে আইসা বসেন।ভদ্রলোক অগ্রসর হলেন না, দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি পাশের ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিলেন। আজকাল যাত্রীবাহী যানবাহনে হকাররা বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে। এছাড়া নানা কিসিমের সাহায্যপ্রার্থীরও দেখা মিলে। কারও জটিল রোগ, কারও চোখে আলো নেই, কারও শরীরের অঙ্গহানি ঘটেছে, আবার কেউ আসেন মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাতের আবেদন নিয়ে। ভদ্রলোকের বেশভুষা দেখে সাহায্যপ্রার্থী বলে মনে হচ্ছে না। সত্য প্রকাশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি, ভদ্রলোক যাত্রীদের সালাম নিবেদন করে বললেন,: আমার নাম মো. মাহবুব-উল-আলম। ঠিকানা- সাভার, নবীনগর। দয়া করে আমাকে কেউ মিসকিন ভাববেন না। আমি বেশিক্ষণ আপনাদের বিরক্ত করব না।স্পষ্ট উচ্চারণ। চমৎকার বাচনভঙ্গি। ভদ্রলোককে রহস্যমানব বলে মনে হচ্ছে। রহস্যের শেষ ভাঁজটি না খোলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। রহস্যমানব স্মৃতি হাতড়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলেন। মনে হল, খুঁজে পেয়েছেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, রহস্যমানব উচ্চারণ করলেন,: আমরা আইনের কথা বলি। আইনের শাসনের কথা বলি। কিন্তু কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন? এই দেশে সড়কপথে যাতায়াতের সময় প্রতিদিন ২শ’র বেশি মানুষ আহত ও নিহত হয়। আজ পর্যন্ত তাদের কতজন ন্যায়বিচার পেয়েছে, এ তথ্য কি আপনাদের কারও জানা আছে? মহামান্য আদালত সম্প্রতি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের হত্যাকারী বাসচালকের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পর খুলনা বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। খুলনা দিয়ে শুরু হলেও এরা এক সময় সারা দেশ অচল করে দিতে পারে। তাদের সেই ক্ষমতা আছে। আইন-বিচার ও শাসনের বদলে যেহেতু সর্বত্র ক্ষমতা প্রদর্শনের চর্চা হচ্ছে, আমিও আপনাদের কাছে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা কর্মসূচি নিয়ে এসেছি।মনে হচ্ছে, রহস্যমানবের সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। আমি সম্মোহিতের ন্যায় বললাম,: কী কর্মসূচি!- এটি হল একটি জনহিতকর কর্মসূচি। এ কর্মসূচি কথিত সিটিং সার্ভিস নামধারী বাসে যাতায়াতকারী মানুষ ও বাসমালিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। আপনারা জানেন, বাসমালিকরা এ খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তবে অতি দুঃখজনক বিষয় হল, এত পয়সাকড়ি বিনিয়োগ করেও বাসমালিকরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিন্তা করে দেখুন, বাসমালিক ও যাত্রীসাধারণরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শুধুমাত্র বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার ও ড্রাইভারের অবৈধ কর্মকাণ্ড তথা অর্থলোভের কারণে। যেসব যাত্রী মুখ বুজে এসব অনিয়ম সহ্য করতে পারেন না, অনেক সময় তারা মারমুখী হয়ে ওঠেন। এর ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ালে চলে ভাংচুর। এর ফলে যাত্রীদের অন্য বাসে ওঠার ভোগান্তি পোহানো ছাড়াও অর্থদণ্ডের শিকার হতে হয়। দেখুন, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল ওই বাসটির মালিক ও যাত্রীরা। অথচ এর জন্য দায়ী ড্রাইভার ও তার সহযোগীরা। এদের অর্থলোভের কারণে দিনের পর দিন গাড়ির মালিক ও যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে- এটা কেমন কথা? এজন্য আমি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি।অসীম কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম,: কী পদ্ধতি?- উম পদ্ধতি।উম দেয়ার প্রতিশব্দ হচ্ছে উষ্ণ বা গরম করা। এ শব্দটি মুরগির ডিমে তা দেয়ার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বললাম,: উম দেয়া তো মুরগির কাজ!- হতে পারে মুগরির কাজ। তবে ভয় নেই, এজন্য মুরগির মতো ঠ্যাং ভাঁজ করে আপনাদের কুট-কুট করতে হবে না।: তাহলে কী করতে হবে?- যখন দেখবেন, নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বাসের মধ্যে ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠানো হচ্ছে এবং যাত্রী উঠানোর জন্য স্টপেজ ছাড়াও যেখানে খুশি বাস থামানো হচ্ছে, তখন আপনারা দাঁড়িয়ে যাবেন। যাত্রীদের উদ্দেশে সালাম দিয়ে বলবেন, সম্মানিত যাত্রী ভাইয়েরা, একটু খেয়াল করেন। দ্রুত ও আরামে যাওয়ার জন্য আমরা অধিক ভাড়া প্রদান করে এই বাসে উঠেছি। অথচ দেখুন, কিভাবে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। না আছে আমাদের বাড়তি টাকা ও সময়ের মূল্যায়ন, না আছে একটু আরাম। বাসমালিকরা ড্রাইভারি করে না, তাই বাসমালিকরা এজন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। এ বাক্য দুটি দু’বার উচ্চারণ করতে হবে।সবকিছু নাটকীয় মনে হচ্ছে। আমার কি উচিত হবে এর সঙ্গে যোগ দেয়া? মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে সময় লাগল না। যন্ত্রচালিতের ন্যায় পরপর দু’বার উচ্চারণ করলাম,: বাসমালিকরা ড্রাইভারি করে না, তাই বাসমালিকরা এজন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়।কর্মসূচির প্রতি আগ্রহী অন্তত একজন মানুষের দেখা পেয়ে রহস্যমানবের মুখে হাসি ফুটল। তিনি পুনরায় বললেন,: এরপর দু’বার বলতে হবে- বাস একটা যন্ত্র, এটা নিজে চলতে পারে না; তাই কোনো ঘটনার জন্য বাসও কোনোভাবেই দায়ী নয়।মন্ত্রমুগ্ধের আমি উচ্চারণ করলাম,: বাস একটা যন্ত্র, এটা নিজে চলতে পারে না; তাই কোনো ঘটনার জন্য বাসও কোনোভাবেই দায়ী নয়...রহস্যমানব এবার বললেন,: এরপর বলতে হবে, এজন্য দায়ী হল বাসের অসৎ ও অর্থলোভী ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপার। অতএব আসুন, আমরা সবাই মিলে এদের উম দিই। উম সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে তাকে বুঝিয়ে বলবেন, উম মানে ডিমে তা দেয়া নয়। উম শব্দের মানে হচ্ছে- উ-তে ‘উত্তম’ এবং ম-তে ‘মধ্যম’ অর্থাৎ উত্তম-মধ্যম। তবে ভাইয়েরা, মেহেরবানি করে গাড়ির গ্লাসে একটা ফুলের টোকাও দিবেন না। কারণ গাড়ি এবং গাড়ির মালিক নির্দোষ। উম সম্পর্কে যাত্রীদের পরিষ্কার ধারণা দেয়ার পর সবাই মিলে বাসটিকে রাস্তার একপার্শ্বে থামাবেন। কারণ চলন্ত গাড়িতে ‘উম’ দিতে গেলে দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। সাবধান! ড্রাইভার জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে। অতএব সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া পালানোর কৌশল হিসেবে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও্র হেলপার কান্নাকাটি করে মাফ চাইতে পারে। তাদের মায়াকান্নায় প্রভাবিত হওয়া যাবে না। মন শক্ত রাখতে হবে। মন শক্ত করে অর্থলোভী কন্ডাক্টর, হেলপার ও ড্রাইভারকে এমন কড়া ডোজের উম দিতে হবে, যাতে তাদের থুতনির রেলিং, যেটাকে দাঁতের পাটি বলি, তা ভেঙে যায়। এর ফলে অন্যায়ভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের পোলাও-বিরিয়ানিসহ মজাদার খাবার আয়েশ করে চিবিয়ে খেতে খুব অসুবিধা হবে এবং উম কী জিনিস, তা তারা বাকি জিন্দেগি মনে রাখবে। আরেকটা প্রয়োজনীয় বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। উম দেয়ার সময় যদি পুলিশ উপস্থিত হয়, তাহলে তাদেরও উম কাজে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। যদি তারা বাধা দেয়, তাহলে জোরে জোরে বলতে হবে- পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা জনগণের বন্ধু। উম কাজে বাধা দিলে প্রমাণ হয়ে যাবে, আপনারা জনগণের বন্ধু নন, বরং চোর-বাটপারদের বন্ধু এবং সাহায্য ও সহযোগিতাকারী...পাশের ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম,: ওনি কী আপনার...- আমার শ্বশুর।: ওনার বিষয়টা একটু খুলে বলেন তো!ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,: মানুষের সেবা করার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন হবে, এ ভাবনা থেকে আমার শ্বশুর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটা বাস কিনেছিলেন। কিছুদিন চলার পর চালকের খামখেয়ালিতে সেই বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়, অনেকেই আহত হয়। এ ঘটনার পর আমার শ্বশুর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। এখন দিনে অন্তত একবার তাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। তিনি বাসে উঠে যাত্রীদের সচেতন করতে যেসব কথা বলেন, তা তো আপনি এতক্ষণ শুনলেন।বাসের ড্রাইভার মহাবিরক্ত। পরের স্টপেজে ভদ্রমহিলা ও তার শ্বশুর নেমে যেতেই সে বলল,: ইঃ। কী আমার জ্ঞানী রে! আর কোনো কাম নাই, পাবলিকরে জ্ঞান দিতে আইছে।ড্রাইভারের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম, মধ্যবয়স্ক এক রমণী ফুটপাত অতিক্রম করছেন। তার পাশে একজন বৃদ্ধ। রমণী পরম মমতায় বৃদ্ধের একটা হাত ধরে রেখেছেন...মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews