জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন নানান শ্রেণিপেশার শত শত মানুষ। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে কারফিউ, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, গণগ্রেফতার-সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনের নীতিনির্ধারণে যারা সামনে ছিলেন, তাদের একজন আলী আহসান জুনায়েদ। বর্তমানে তিনি ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ)’ আহ্বায়ক।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, নেতৃত্ব, ভবিষ্যৎ ও ব্যক্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হন তিনি।
প্রশ্ন : জুলাইয়ের কোন বিশেষ ঘটনাটি আপনার সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়?
আলী আহসান জুনায়েদ : ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মিছিল। মিছিলটা একটা নতুন টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ১৫ জুলাই আমাদের বোনেদের যে রক্তাক্ত চেহারা। সেটা নিয়ে আমরা সবাই ক্ষুব্ধ হলাম। পরের দিন ১৬ জুলাই ক্ষুব্ধ হয়ে সব শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে জড়ো হলো। সেদিন আবু সাঈদের শাহাদত প্রত্যেককে নাড়া দিয়েছিল। ১৯ জুলাই আমি চিটাগাং রোডে ছিলাম। যাত্রাবাড়ীর স্পটে। ১৯ তারিখ কারফিউ জারি হওয়া সত্ত্বেও ফজরের নামাজের ঘণ্টাখানেক পরে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ। কারফিউ কেউ মানছে না। সারা দিনব্যাপী স্লোগান চলছিল। লোকজনের সাহস ছিল অন্য লেভেলের। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড যখন ছোড়া হচ্ছিল, তখন তারা বলছিল-তারা ক্যাচ ধরবে! আশ্চর্য ব্যাপার। সেদিন বিকেলে হেলিকপ্টার থেকে এবং র্যাব-পুলিশের গাড়ি থেকে সরাসরি গুলি হয়- তিন জায়গা থেকে। আমার চোখের সামনে স্পটেই ৩০ জনের মৃত্যু। উপরে হেলিকপ্টার ঘুরছিল। মা হাসপাতালের ওখানে পুলিশের অফিস ছিল। সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রথমে দু’জন শহীদ হন। তখন লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপরে ওই পুলিশদেরকে উদ্ধার করার জন্য হেলিকপ্টার আসে। এই হেলিকপ্টার ঘুরতে ঘুরতে গুলি করছিল। আর সামনে থেকে পুলিশ, র্যাব গুলি করছিল। জাস্ট জায়গার মধ্যেই ম্যাসাকার। কী করবে, কিছু বুঝতে পারছিল না সবাই। এই গুলির মধ্যেই লোকজন সামনে যাচ্ছিল। সেদিন আমি এক স্কুল শিক্ষকের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটু পরেই ছাত্রলীগ আর পুলিশ এসে বাসায় বাসায় হানা দেয়- কেউ আছে কি না। কোনো বিল্ডিংয়ের দরজা খুলেনি।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিন ঘণ্টা টানা গুলিবর্ষণের পরে লোকজন আবার নামছে। তখন মনে হচ্ছিল-এদেরকে আর কেউ থামাতে পারবে না।
প্রশ্ন : আন্দোলনের জন্য কোন দিনটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে আপনি মনে করেন?
আলী আহসান জুনায়েদ : আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ প্রোগ্রামটা সফল হওয়া। আর সারা বিশ্বে আন্দোলনটা ছড়িয়ে গিয়েছিল ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার মধ্য দিয়ে। কিছু দুর্বৃত্ত বাদে সবাই তাদের ফেসবুক প্রোফাইলে লাল পিকচার দিয়েছিল। এটার মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে সবার মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি হয়ে যায়।
৪ আগস্ট সকালে আমি বের হই। আগের দিন আমার পরিচিত সবার সাথে কথা হয়- সবাই যেন আসে। প্রত্যেকটা রোডে ফেসবুক এবং টেলিগ্রাম গ্রুপ হয়েছে। নিয়মিত আপডেট করা হতো।
সেদিন সকালে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। আমরা ৭-৮ জন ছিলাম। বের হয়ে হাঁটছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে দেখি কোনো লোকজন নেই। চিটাগং রোড থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে আসছিলাম। ঘুরে ঘুরে আসতে হয়েছে। মেইন রোড দিয়ে আসতে পারছিলাম না। যেখানে লোক পাবো, সেখানে তাদের নিয়ে মেইন রোডে উঠতে হবে। সবাইকে ফোন দিচ্ছিলাম।
১১টার দিকে সাদ্দাম মার্কেটের দিকে এসে দেখি প্রায় ৪০০ মেয়ে এবং হাজারখানেক ছেলে। এরা শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী।
আগের রাতে যাদের সাথে বেসিক্যালি যোগাযোগ হয়েছিল, তারাই আসছে। সাড়ে ১১টার দিকে রায়েরবাগ, শনির আখড়া- লাখ লাখ মানুষ। আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই নেমে পড়ছে।
সে সময় যেটা দেখলাম-বিস্ময়কর। এক সারি লোকজন সামনে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারের কাছে গুলি চলছে। গুলিবিদ্ধ লোকেরা পেছনে আসছে, আরেক সারি যাচ্ছে, গুলি খেয়ে পেছনে আসছে, আবার আরেক সারি সামনে যাচ্ছে। কেউ সরে যাচ্ছে না। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
অনেকগুলো মানুষ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজলা ফুটওভার ব্রিজের ওখানে অনাবিল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সবগুলো স্নাইপার শট। কারণ আমরা দেখেছি মাঝখানে একজন এসে গুলি খাচ্ছে। বিল্ডিং থেকে স্নাইপার শট হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মেয়ে মাথায় গুলি খেয়েছে। সবাই কান্নাকাটি করছে, কিন্তু লোকজন কেউ সরছে না। বারবার সামনে যায়। এক অদ্ভুত দৃশ্য। এটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
৫ আগস্ট যখন আমরা শুনছিলাম আর্মি চিফ ভাষণ দেবেন, তখন আমি হ্যান্ডমাইকে বলছিলাম, ‘কেউ যাবেন না। এখনো কিছু হয়নি। আর সামরিক শাসন মেনে নেওয়া যাবে না।’ সবাই সিজদা দেয়া শুরু করে তখন। পরে ৩টায় যখন ঘোষণা আসে শেখ হাসিনা পালিয়েছে। সবাই খুশি। অনেক জায়গায় এ রকম হয়েছে।
প্রশ্ন : আন্দোলনের কোন সময়টাতে আপনি বুঝেছিলেন শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত?
আলী আহসান জুনায়েদ : ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরে শিক্ষার্থীরা যখন স্লোগান দেয়, ‘আমি কে, তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার’-যখন এই টার্মিনোলজি ভেঙে ফেললো, তখন বুঝেছি আর দমিয়ে রাখা যাবে না। এই স্লোগান রাস্তায় রাস্তায় দিয়েছে।
পরের দিন যুক্ত হলো, ‘কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ আর ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে যখন ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়, সেদিন আমি কনফার্ম হই।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না, সকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। প্রত্যেকটা হলে প্রভোস্টের কাছ থেকে সাইন নেয়া হয় যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা- এটা অনেক বড় একটা ঘটনা। তখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে এই আন্দোলনকে আর থামানো যাবে না।
প্রশ্ন : ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটে কিভাবে আন্দোলনকে মোবিলাইজ করেছেন?
আলী আহসান জুনায়েদ : আমরা একটা মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করেছি- যেটা অফলাইনেও ব্যবহার করা যেত সে সময়। ঢাকার অনেক স্পটের মানুষের সাথে আমি সরাসরি যোগাযোগ করেছি। আপডেট দিচ্ছিলাম- কি হচ্ছে, না হচ্ছে।
সে সময় হেলিকপ্টার থেকে র্যাব গুলি করেছে। তখন কল করে এক স্পটের মানুষ, অন্য স্পটের মানুষজনকে জানাচ্ছিল- ‘হেলিকপ্টার এখন আপনাদের দিকে যাচ্ছে।’
প্রশ্ন : আন্দোলনের একটা কমন ব্যানার ছিল- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কমন ব্যানারের কারণে শিবির সেটাতে দলীয় পরিচয়ে যুক্ত হয়নি নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল?
আলী আহসান জুনায়েদ : ওই ব্যানারটাকে পার্টিশন করে ফেলা খুবই বিপজ্জনক ছিল। তাতে করে আন্দোলনের সার্বজনীন রূপটা নষ্ট হয়ে যেত। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যারা লিডারশিপে ছিল, তারাও নিজেদের দলীয় ব্যানার ব্যবহার করেনি। ছাত্রদলসহ অন্যান্য সকল ছাত্র সংগঠন এই কমন ব্যানারে এসে যুক্ত হয়েছে। হাসিনা ১৭ জুলাইও বলেছে এটা শিবির, বিএনপি, জামায়াতের ষড়যন্ত্র।
প্রশ্ন : ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খালি করার পরে আন্দোলনটা অনেকটাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা নেমেছে। এই আন্দোলন বিমুখ একটা ফোর্স পুরোপুরি আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে যাওয়াটা কিভাবে দেখেন?
আলী আহসান জুনায়েদ : এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে। শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের ওপর এভাবে নির্মম গুলি চালানো তারা মেনে নিতে পারেনি। আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯ তারিখেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ৩১ জন শহীদ হন। কিছু স্পটে যেমন উত্তরা, যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে ছিল। আহত, শহীদ তালিকায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নাম অনেক। ২, ৩, ৫ আগস্ট কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ একটা জাতীয় ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়।
প্রশ্ন : জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকাটা আপনার পরিবার কিভাবে নিয়েছিল?
আলী আহসান জুনায়েদ : আমার একটা সুবিধা ছিল। আমার বাসায় আমার আব্বা এবং তিন ভাই। আমরা চারজনই প্রতিদিন নেমেছিলাম। হয়তো স্পটের ডিফারেন্স ছিল। মাঝেমধ্যে ঢাকা আসছি। শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছি। মা এবং আমার ওয়াইফেরও যথেষ্ট সাপোর্ট ছিল।
প্রশ্ন : জুলাইয়ে সব শ্রেণিপেশা ও দলের মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি হয়। সেটা কি এখনো আছে?
আলী আহসান জুনায়েদ : ঐক্য নেই সেটা মনে করি না। জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ তাড়াতে যে ঐক্য ছিল, সেটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার কাজে তৈরি করতে পারিনি। এখনো ঐক্য আছে, কিন্তু ইমপ্লিমেন্টেশন প্রসেস নিয়ে নানান কথা আছে। শহীদ-আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন সবাই চায়। জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র সবাই চায়। বিচার সবাই চায়। কিন্তু এগুলোর মধ্যে নানান পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন ঢুকে গেছে। জাতীয় স্বার্থ, নাগরিক অধিকার এবং ন্যায্য সংস্কার। এই তিনটি প্রশ্নে অ্যাগ্রিমেন্ট লাগবে।
প্রশ্ন : জুলাই অভ্যুত্থান আপনার রাজনৈতিক অবস্থানে কেমন পরিবর্তন এনেছে?
আলী আহসান জুনায়েদ : এই আন্দোলন আমার রাজনৈতিক অবস্থানে গভীর প্রভাব ফেলেছে। গণ-অভ্যুত্থান এবং মানুষের আত্মত্যাগ আমি নিজের চোখে দেখেছি, বিশেষ করে- আমি অন্তত ৫০ জন শহীদের লাশ সরাসরি দেখেছি মাঠে। এসব দেখে আমার ভেতর পুরোপুরি পরিবর্তন এসেছে।
প্রশ্ন : কেমন বাংলাদেশ চান?
আলী আহসান জুনায়েদ : আমি চাই সব রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। সবার ভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ঐক্য থাকতে হবে। আমরা আর ফ্যাসিবাদ বা একতরফা হেজিমনি দেখতে চাই না। গুম-খুনের মতো অমানবিক ঘটনা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এমন হলে আমরা বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ এবং সত্যিকারের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে পারব। এ ছাড়া আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নীতি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে স্থায়ী হতে হবে।