একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্রমেই এগিয়ে এলেও সবার জন্য সমান সুযোগ এখনও নিশ্চিত হয়নি। এ ব্যাপারে শুধু যে দেশেই কথাবার্তা হচ্ছে তাই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলেও বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিচ্ছে এবং বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন তীব্রই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিস্থিতি এভাবেই চিত্রিত হয়েছে যুক্তরাজ্য সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনে। ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ বিষয়ক এই হালনাগাদ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এই প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কয়েকজন নেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধীপক্ষের যে উদ্বেগ রয়েছে, এ প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে প্রতিবেদনে। আমাদের এবারের জাতীয় নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে কোনো পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথাও উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না এবং সেসব দেশের এ সংক্রান্ত বিধিবিধানও প্রশ্নমুক্ত।তাদের এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখেই প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবের নয়। এমন প্রেক্ষাপট সৃষ্টির দায় সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা এড়াতে পারেন না। কমনওয়েলথ থেকে আমাদের জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে এখনও কিছু বলা হয়নি। এই কলামেই কয়েকদিন আগে লিখেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম শর্ত ভীতিমুক্ত-শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। এমন প্রেক্ষাপটে তফসিল ঘোষণার আগের আর তফসিল ঘোষণার পরের চিত্র যৌক্তিক কারণেই ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হবে। তফসিল ঘোষণার পর অনেক কিছুই চলে এসেছে (বিধিবিধান মোতাবেক) নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগে যেসব বিষয় তাদের এখতিয়ার-বহির্ভূত বলেছে, এখন সেসব ব্যাপারে এমনটি বলার অবকাশ তাদের আর নেই। এখন পর্যন্ত সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়নি, এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিরোধীপক্ষের প্রধান দল বিএনপির নেতাকর্মীরা একদিকে আছেন গায়েবি মামলার চাপে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মহলের নেতাকর্মীরা তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, নানা রকম হুমকি দিচ্ছেন। এ রকম খবরও গণমাধ্যমেই এসেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা কতটা করা যায়? প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতিমধ্যে নানারকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও দৃশ্যত এর বাস্তবায়ন চিত্র সন্তোষজনক নয়। সাধারণ মানুষের মনে নির্বাচন নিয়ে নানারকম শঙ্কা রয়েছে, ভোটদাতারা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কি-না- এমন প্রশ্নও সঙ্গতই ঘুরেফিরে দাঁড়াচ্ছে। যদি বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীরা মামলা-হামলার ভয়ে পালিয়েই থাকেন, তাহলে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা শেষ পর্যন্ত কতটা পূর্ণতা পাবে- এ নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। নির্বাচন কমিশন যদি সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কা আরও প্রকট হবে এবং নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। কিন্তু এর আলামত স্পষ্ট নয়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে আস্থার যে সংকট রয়েছে, তাও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা কাটাতে পারছেন না তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণে নির্বাচন কমিশনকে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের যথাযথ সহযোগিতা করার যে দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্ব পালনে সদিচ্ছার ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের পরিসংখ্যান চিত্র গুরুত্ববহ। মোট ভোটার প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ। এর মধ্যে তরুণ ভোটার (যাদের বয়স ১৮-২৮ বছরের মধ্যে) প্রায় ২২ ভাগ। প্রায় ১২ ভাগ নতুন করে ভোটাধিকার পেয়েছেন। তরুণরা ভোটদানে সঙ্গতই অধিকতর উৎসাহী থাকে। কিন্তু তারা চায় নিরাপদ পরিবেশ। সংঘাত-সহিংসতা, বল প্রয়োগ ইত্যাদি নেতিবাচক চিত্র সিংহভাগ মানুষের অবশ্যই অপছন্দনীয় এবং তাদের কাছে তা ভীতির কারণ। তরুণরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আমাদের তরুণরা ইতিমধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই আশাপ্রদ চিত্র দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের জন্য যদি সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিরাপদ করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে। আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা ইশতেহারে তরুণদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিষয় উপস্থাপনে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন। তবে ইশতেহার যেন শুধুই নির্বাচনীকেন্দ্রিক একটি দলিল না হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে এবং এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ইশতেহার যেন কোনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না হয়। শুধু কাগজে-কলমে অঙ্গীকার নয়, বাস্তবায়নের পথও দেখাতে হবে। ইশতেহার হতে হবে দেশ-জাতির কল্যাণের নিরিখে প্রণীত। সমাজে বৈষম্য কমছে না। উন্নয়ন হলেও উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখনও নিরক্ষর। প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর রেখে টেকসই উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এর জবাবদিহি প্রয়োজন।যুক্তরাজ্য সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনে যেসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, সেসব তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিয়ে বরং এগুলো আমলে নিয়ে ভুলত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়াটাই হবে শ্রেয়। মন্দের ভালোর মতো নির্বাচন করে গণতন্ত্রের জন্য শুভফল বয়ে আনা যাবে না। মাঠ পর্যায়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও অনুসারীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ বা অন্য কোনো অনিয়ম তদন্তে নির্বাচনী তদন্ত কমিটির দায়িত্বশীলদের নির্মোহ অবস্থান নিয়ে সত্যিকার চিত্র তুলে ধরতে হবে। পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, তফসিলের পরও গ্রেফতার থামছে না। প্রধান প্রতিপক্ষের প্রার্থী, কর্মী, সমর্থকরা আতঙ্কে আছেন। তফসিল ঘোষণার আগে শুরু হওয়া সংলাপে (যা পরেও হয়েছে) সরকারের তরফে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানি করা হবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলাগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিএনপি একটি তালিকা দিয়েছে আটকদের। নির্বাচন কমিশন নতুন করে যেন আর বিতর্ক সৃষ্টি না করে, এটাই প্রত্যাশা। বিরোধী দলগুলোর আপত্তি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ছয়টি আসনে ভোট নেওয়া হবে ইভিএমে। হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন কমিশনের তো এখন লক্ষ্য একটাই হওয়া উচিত, কোনো রকম বিতর্কে না জড়িয়ে কাজের কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা। কারও মনে নতুন করে আস্থার সংকট যাতে সৃষ্টি না হয়, এমন পদক্ষেপ নেওয়া। তারা কেন এবং কী উদ্দেশ্যে এমন কর্মকাণ্ড করে নতুন করে আস্থায় চির ধরাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।প্রত্যাশা মোতাবেক সব দলের অংশগ্রহণে অনেক কিছুর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে। তা যেন পণ্ড না হয়, দায়িত্বশীল কোনো মহলের অদূরদর্শিতা কিংবা হীন স্বার্থবাদিতার কারণে, এ ব্যাপারে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কথা হয়েছে। এই বিষয়টি অন্যতম জরুরি। আমাদের সামনে নানারকম অপ্রীতিকর চিত্র রয়েছে। নতুন করে যেন আর কিছু না দাঁড়ায় সেই চেষ্টাটা থাকুক। যেসব নেতিবাচক ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেছে, সেগুলোর যথাযথ প্রতিকার করে নির্বাচন কমিশনকে প্রমাণ করা বাঞ্ছনীয় যে, তারা সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নির্বাচনের অন্যতম শর্ত, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। তা নিশ্চিত করতে আর উদাসীনতা, অনীহা কিংবা সময়ক্ষেপণ নয়। নির্বাচনের আগে প্রতিটি মুহূর্ত এখন প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার জন্য সমান সুযোগের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। এটা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। এবার যে প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাগ্রে এই বিষয়টি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখার ব্যবস্থাটা নেওয়াই তো ছিল অন্যতম লক্ষ্য।রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews