আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি

যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ ভালো

মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই :অ্যাটর্নি জেনারেল

সমকাল প্রতিবেদক


উচ্চ আদালতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, 'আমরা মূল (বাহাত্তরের) সংবিধানে ফিরে যেতে চাই।' এটি (সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসের বড় লজ্জা। এর বিরোধিতা করে রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'এটি বঙ্গবন্ধুর নীতি ও জনগণের মতের পরিপন্থী। ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন।' উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে গতকাল বুধবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানা দিক তুলে ধরা হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানির ষষ্ঠ দিনে এই শুনানি চলে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, 'বর্তমানে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ৯০ ভাগের বেশি। দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।'

গতকাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও রিটকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর ১২ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে প্রথম বক্তব্য শুরু করেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। আজ বুধবার সকাল ৯টায় তার অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

শুনানি :গতকাল বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আমরা আপনাকে বেশি প্রশ্ন করব না। কারণ, আমরা যাই বলি তা মিডিয়ায় চলে যায়।' বিচারক অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি ব্যাখ্যা করেন, সেটা হবে কষ্টদায়ক। সংবিধানের অপব্যাখ্যা না করতে অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ইংল্যান্ডের কী অবস্থা! আপনি লিখিত যুক্তিতর্কে অনেক কিছুই না জেনে লিখেছেন।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেন। আমরা ঘরে (বাহাত্তরের সংবিধান) ফিরতে চাই।'

এরপর প্রধান বিচারপতি ইংল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে লেখা বইয়ের একটি অংশ অ্যাটর্নি জেনারেলকে পড়তে দেন। পড়ার পর প্রধান বিচারপতি বলেন, 'পৃথিবীতে একমাত্র সভ্য দেশ ইংল্যান্ড। যে দেশে অলিখিত সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। অলিখিত সংবিধানে চুল পরিমাণ এদিক-ওদিক হয়নি। ব্রেক্সিটে পরাজিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কী চিন্তা-চেতনা তাদের।' এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'তাদের ইতিহাস তো লুণ্ঠনের। তাদের সভ্য বলতে পারেন না। তারা আইনের শাসন ডেভেলপ করেছে এটা বলতে পারেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা লুণ্ঠন করে যাচ্ছে।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'আমি সভ্য দেশ বলতে বুঝিয়েছি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা তাদের নাগরিক সুরক্ষা দিতে পেরেছে।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'অন্যদের লুণ্ঠন করে নিজের নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে। তারা কি আদি সংবিধানে ফিরে যাবেন? আমেরিকার সংবিধানে তো আছে 'উই দ্য পিপল'। সেখানে আগে দাসপ্রথা ব্যবস্থা চালু ছিল। এটা মাথায় রেখেই পরে পনেরো শতকের দিকে পরিবর্তন হয়েছে। এখন ইথিওপিয়া, মরক্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক আমেরিকায় ভর করছে। এখন কি তারা আদি সংবিধানে ফিরে যাবে?'

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'মার্শাল ল'র সময়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল করা হয়েছে। এটি সংবিধানের বড় লজ্জা। সেখানে রিলিজিয়াস (ধর্ম) বিষয়টি আছে।' তিনি বলেন, 'সমস্ত পাণ্ডিত্য আপনাদের, আমাদের। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে হাত দিতে পারেন না।' জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'তা হলে জুডিসিয়াল ইমপ্রুভমেন্ট থাকবে না? জুডিসিয়াল রিভিউ থাকবে না? জনগণের অধিকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন এলে সংবিধানের এ টু জেড ব্যাখ্যা করব।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এটা ঠিক না। আপনারা শুধু যোগ করতে পারেন।' অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ১৬তম সংশোধনী বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়া করে আইনের খসড়া করলেন। আমরা মন্ত্রণালয়কে আইন না করার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু তারা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়া করার কী ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'সাবেক টেকনোক্র্যাট আইনমন্ত্রী (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ), যিনি এই আদালতেরই একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের এক ধরনের সুবিধা দিতেই জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন।'

এ বক্তব্যে আপত্তি তুলে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'তিনি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন। বারের নির্বাচিত দুইবারের সভাপতি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্রলোক। কাউকে খাটো করতে হয় না। তিনি মন্ত্রিত্বে থাকাকালে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। এ সময় সুপ্রিম কোর্টকে 'আন্ডারমাইন্ড' করবেন না বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, 'টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে এত কথা বলছেন? তাহলে কেন এ প্রথা রেখেছেন, কেন বাতিল করেননি?' তিনি আরও বলেন, 'যার কথা বলেছেন, তার সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়েছে। বিচারে তার অবদান রয়েছে। তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।'

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক ইশতেহারে ছিল। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি না থাকলে এটা হতো না।'

প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আপনার কোর্ট সম্পর্কে একটা গণশুনানি নেন। বিচারপ্রার্থী ও জনগণের মতামত নেন।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'বর্তমানে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ৯০ ভাগের বেশি। আমি সম্প্রতি বাঁশখালী চৌকি আদালতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি বিচারপ্রার্থীদের। ডিসি অফিসেও এত লোক আসেন না। দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।'

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এটি (সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসে লজ্জা। আমেরিকা-ভারতে মার্শাল ল হয়নি। আমাদের এখানে হয়েছে। মার্শাল ল-র মাধ্যমে যতখানি হয়েছে, ততখানি বাদ দিতে চাই। বিগত সময়ে পারিনি। ধর্মীয় কিছু বিষয় ছিল। রাস্তাঘাটে মারপিট লেগে যাবে। আপনাদের মতামত রাখার সুযোগ আছে।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'একটিতে আপস করতে পারলে অন্যটিতে নয় কেন?' জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এখনও আইন হয়নি। আইনে সব বিস্তারিত আলোচনা হবে।' এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষ করেন।

রিটকারীর পক্ষের বক্তব্য :বিরতির পর রিট আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, '৭২-এর সংবিধানের ব্যাপারে বক্তব্যে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে সংবিধান তৈরির সময় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে সুপ্রিম কোর্ট বারের দু'জন (ওই সময়ের মন্ত্রিসভার দু'জন সদস্য) সদস্য বলেছেন। ওই সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর নানা অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন।'

মনজিল মোরসেদ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, 'আমরা যে সংবিধানের কথা বলি, ১৯৭২ সালের সংবিধান_ এটা বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে করা সংবিধান তিনি নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত নয়, সেটা বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত। যার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই জাতির পিতাই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধান সংশোধন করেছেন।'

শুনানির শেষ পর্যায়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, 'স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশ। এটাতে হাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এতে আঘাত করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো আইন করা হলে সেটা বাতিল করতে পারেন সুপ্রিম কোর্ট।'

উচ্চ আদালতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, 'আমরা মূল (বাহাত্তরের) সংবিধানে ফিরে যেতে চাই।' এটি (সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসের বড় লজ্জা। এর বিরোধিতা করে রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'এটি বঙ্গবন্ধুর নীতি ও জনগণের মতের পরিপন্থী। ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন।' উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে গতকাল বুধবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানা দিক তুলে ধরা হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানির ষষ্ঠ দিনে এই শুনানি চলে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, 'বর্তমানে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ৯০ ভাগের বেশি। দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।'গতকাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও রিটকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর ১২ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে প্রথম বক্তব্য শুরু করেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। আজ বুধবার সকাল ৯টায় তার অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।শুনানি :গতকাল বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আমরা আপনাকে বেশি প্রশ্ন করব না। কারণ, আমরা যাই বলি তা মিডিয়ায় চলে যায়।' বিচারক অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি ব্যাখ্যা করেন, সেটা হবে কষ্টদায়ক। সংবিধানের অপব্যাখ্যা না করতে অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ইংল্যান্ডের কী অবস্থা! আপনি লিখিত যুক্তিতর্কে অনেক কিছুই না জেনে লিখেছেন।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেন। আমরা ঘরে (বাহাত্তরের সংবিধান) ফিরতে চাই।'এরপর প্রধান বিচারপতি ইংল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে লেখা বইয়ের একটি অংশ অ্যাটর্নি জেনারেলকে পড়তে দেন। পড়ার পর প্রধান বিচারপতি বলেন, 'পৃথিবীতে একমাত্র সভ্য দেশ ইংল্যান্ড। যে দেশে অলিখিত সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। অলিখিত সংবিধানে চুল পরিমাণ এদিক-ওদিক হয়নি। ব্রেক্সিটে পরাজিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কী চিন্তা-চেতনা তাদের।' এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'তাদের ইতিহাস তো লুণ্ঠনের। তাদের সভ্য বলতে পারেন না। তারা আইনের শাসন ডেভেলপ করেছে এটা বলতে পারেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা লুণ্ঠন করে যাচ্ছে।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'আমি সভ্য দেশ বলতে বুঝিয়েছি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা তাদের নাগরিক সুরক্ষা দিতে পেরেছে।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'অন্যদের লুণ্ঠন করে নিজের নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে। তারা কি আদি সংবিধানে ফিরে যাবেন? আমেরিকার সংবিধানে তো আছে 'উই দ্য পিপল'। সেখানে আগে দাসপ্রথা ব্যবস্থা চালু ছিল। এটা মাথায় রেখেই পরে পনেরো শতকের দিকে পরিবর্তন হয়েছে। এখন ইথিওপিয়া, মরক্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক আমেরিকায় ভর করছে। এখন কি তারা আদি সংবিধানে ফিরে যাবে?'অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'মার্শাল ল'র সময়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল করা হয়েছে। এটি সংবিধানের বড় লজ্জা। সেখানে রিলিজিয়াস (ধর্ম) বিষয়টি আছে।' তিনি বলেন, 'সমস্ত পাণ্ডিত্য আপনাদের, আমাদের। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে হাত দিতে পারেন না।' জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'তা হলে জুডিসিয়াল ইমপ্রুভমেন্ট থাকবে না? জুডিসিয়াল রিভিউ থাকবে না? জনগণের অধিকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন এলে সংবিধানের এ টু জেড ব্যাখ্যা করব।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এটা ঠিক না। আপনারা শুধু যোগ করতে পারেন।' অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ১৬তম সংশোধনী বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়া করে আইনের খসড়া করলেন। আমরা মন্ত্রণালয়কে আইন না করার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু তারা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়া করার কী ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না।এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'সাবেক টেকনোক্র্যাট আইনমন্ত্রী (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ), যিনি এই আদালতেরই একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের এক ধরনের সুবিধা দিতেই জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন।'এ বক্তব্যে আপত্তি তুলে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'তিনি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন। বারের নির্বাচিত দুইবারের সভাপতি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্রলোক। কাউকে খাটো করতে হয় না। তিনি মন্ত্রিত্বে থাকাকালে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। এ সময় সুপ্রিম কোর্টকে 'আন্ডারমাইন্ড' করবেন না বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, 'টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে এত কথা বলছেন? তাহলে কেন এ প্রথা রেখেছেন, কেন বাতিল করেননি?' তিনি আরও বলেন, 'যার কথা বলেছেন, তার সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়েছে। বিচারে তার অবদান রয়েছে। তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।'অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক ইশতেহারে ছিল। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি না থাকলে এটা হতো না।'প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আপনার কোর্ট সম্পর্কে একটা গণশুনানি নেন। বিচারপ্রার্থী ও জনগণের মতামত নেন।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'বর্তমানে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ৯০ ভাগের বেশি। আমি সম্প্রতি বাঁশখালী চৌকি আদালতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি বিচারপ্রার্থীদের। ডিসি অফিসেও এত লোক আসেন না। দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।'অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এটি (সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসে লজ্জা। আমেরিকা-ভারতে মার্শাল ল হয়নি। আমাদের এখানে হয়েছে। মার্শাল ল-র মাধ্যমে যতখানি হয়েছে, ততখানি বাদ দিতে চাই। বিগত সময়ে পারিনি। ধর্মীয় কিছু বিষয় ছিল। রাস্তাঘাটে মারপিট লেগে যাবে। আপনাদের মতামত রাখার সুযোগ আছে।' প্রধান বিচারপতি বলেন, 'একটিতে আপস করতে পারলে অন্যটিতে নয় কেন?' জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এখনও আইন হয়নি। আইনে সব বিস্তারিত আলোচনা হবে।' এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষ করেন।রিটকারীর পক্ষের বক্তব্য :বিরতির পর রিট আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, '৭২-এর সংবিধানের ব্যাপারে বক্তব্যে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে সংবিধান তৈরির সময় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে সুপ্রিম কোর্ট বারের দু'জন (ওই সময়ের মন্ত্রিসভার দু'জন সদস্য) সদস্য বলেছেন। ওই সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর নানা অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন।'মনজিল মোরসেদ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, 'আমরা যে সংবিধানের কথা বলি, ১৯৭২ সালের সংবিধান_ এটা বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে করা সংবিধান তিনি নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত নয়, সেটা বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত। যার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই জাতির পিতাই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধান সংশোধন করেছেন।'শুনানির শেষ পর্যায়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, 'স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশ। এটাতে হাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এতে আঘাত করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো আইন করা হলে সেটা বাতিল করতে পারেন সুপ্রিম কোর্ট।'



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews