জুলাই-আগস্ট মাসের ‘ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে’ হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় চতুর্থ ও পঞ্চম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।

গতকাল বুধবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এ দিন দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মূর্মু এবং এনটিভির রংপুর ব্যুরো প্রধান এ কে এম মঈনুল হক।

‘দুই পুলিশ গুলি করেছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি’ : রিনা মূর্মু বলেন, আমি রিনা মূর্মু, ধর্ম খ্রিষ্টান। সাঁওতাল বংশের লোক। আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে অর্থনীতির ছাত্রী ছিলাম। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে রংপুরেও আন্দোলন শুরু হয়। ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলছিল। ১৪ জুলাই জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট থেকে মিছিল নিয়ে রংপুর শহরের মডার্ন মোড়ে যাই। সেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের সামনে স্মারকলিপিটি পড়ে শোনাই। এর পর আমরা মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে রওনা দিলে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হই। শেষ পর্যন্ত আমরা জেলা প্রশাসকের হাতে স্মারকলিপি প্রদান করি।

আমাদের কোনো কমিটি ছিল না। আমি আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলাম। সে দিনের মতো আমাদের কর্মসূচি শেষ করি। ১৪ জুলাই সন্ধ্যার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে মন্তব্য করেন। এর প্রতিবাদে রাতেই মেয়েদের হল থেকে আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করি। ১৫ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করি। আমি যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে সেখানে গিয়ে দেখি ছাত্রলীগ একই স্থানে কর্মসূচি দিয়েছে।

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, শামীম, বাবুলসহ ক্যাম্পাসের বাইরের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিল। তাদের হাতে রামদা, লাঠি, রডসহ দেশীয় অস্ত্র ছিল। তারা ওগুলো শিক্ষার্থীদের দমন করার উদ্দেশ্যে এনেছিল। তাদের কারণে আমরা একত্র হতে পারিনি। সরদার পাড়া থেকে আমাদের একটি মিছিল আসার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে হামলা চালায়। এতে আমাদের সমাবেশ আর অনুষ্ঠিত হয়নি এবং কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।

১৬ জুলাই আমরা আন্দোলনের জন্য দুটি স্থান নির্ধারণ করি- একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট (বর্তমানে শহীদ আবু সাঈদ গেট) এবং অন্যটি লালবাগ। ১৬ জুলাই সকাল ১০টার দিকে জেলা স্কুলের সামনে রংপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে প্রেস ক্লাবে গেলে আমি সেখানে যোগ দেই। এর পর আমরা মিছিল নিয়ে চারতলা মোড়ের দিকে যাই।

পথে পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। সেখানে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও আমাদের সাথে যোগ দেয়। পরে আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে একত্র হই। সেখানে আগে থেকেই পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু লোক অবস্থান করছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিই। তখন পুলিশের সাথে আমাদের বাগি¦তণ্ডা হয়। হঠাৎ করেই পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

মিছিলে আনুমানিক ৫ থেকে ৬ হাজার শিক্ষার্থী ছিল, যাদের মধ্যে আরমান, ইমরান, আবু সাঈদ, সাবিনা ইয়াসমিন, রাইসুলসহ অনেকে ছিল। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের বিপরীত পাশে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে যাই। সে সময় আবু সাঈদকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ লাঠি দিয়ে মারধর করে। আবু সাঈদ রাস্তার ডিভাইডারের একটু সামনে দাঁড়ায় এবং তার দুই হাত প্রসারিত করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে অবস্থানরত দুইজন পুলিশ সদস্য আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি করে।

আবু সাঈদ মাটিতে পড়ে যায়। আমাদের সহযোদ্ধা আয়ান আবু সাঈদকে উঠায়। পরে আরও কয়েকজন এসে তাকে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যায়। যে দুইজন পুলিশ গুলি করেছিল, পরে তাদের নাম জানতে পারি, একজনের নাম আমির আলী, আরেকজনের নাম সুজন চন্দ্র। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে আবু সাঈদকে গুলি করার ঘটনাটি সরাসরি দেখেছি। আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি, আবু সাঈদ মারা গেছে।

আমি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, যেসব পুলিশ সদস্য সরাসরি গুলি করেছে, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা এবং ছাত্রলীগের বিচার দাবি করছি।’

রিনা মূর্মুর জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন। জেরায় তিনি বলেন, আপনি বলেছেন আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করেছে। কতটুকু দূরত্ব থেকে গুলি করেছিল? জবাবে সাক্ষী রিনা মূর্মু বলেন, ২০ থেকে ২৫ হাত দূর হবে।

আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ঘটনার সময় আপনি কাকে দেখেছেন? সাক্ষী রিনা মূর্মু বলেন, পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ছিল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী ছিল। আইনজীবী বলেন, আপনি এখানে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিলেন। জবাবে সাক্ষী রিনা বলেন, এটা সত্য নয়।

আমির হোসেন বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তার সাথে দেয়া বক্তব্যের সাথে কোর্টে আপনার দেয়া বক্তব্যে কিছুটা অমিল রয়েছে।’ তখন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম আদালতকে জানান, ‘তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেয়া বক্তব্য এবং আদালতে দেয়া বক্তব্য তুলনা করে প্রশ্ন করা যাবে না। কারণ কাদের মোল্লার মামলার সময় আপিল বিভাগ এমন একটি আদেশ দিয়েছিলেন, যা এখনও বলবৎ রয়েছে।’

এ সময় শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, আমাকে (শেখ হাসিনা) ফাঁসি দিয়ে দিবেন? জবাবে আদালতের বিচারক বলেন, ফাঁসি যেন দিতে না হয় সে জন্যই তো প্রত্যেক পয়েন্ট নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের জন্য আপনাকে নিয়োগ করা হয়েছে। জবাবে শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেন, চেষ্টা করছি। এ পর্যায়ে সাক্ষী ও জেরা শেষে মুলতবি করা হয়। এর পর ৩০ মিনিটের বিরতি দিয়ে শুরু হয় দিনের দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ।

আমি এ কে এম মঈনুল হক। পেশায় একজন সাংবাদিক। আমি ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে রংপুরে কর্মরত আছি। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেলা ২টার আগে থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর প্রেস ক্লাব এলাকা থেকে একটি মিছিল নিয়ে সেখানে আসে।

মিছিলটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে আসে, সেখানে আগে থেকেই পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সরকারি দলের সমর্থকরা অবস্থান করছিল। পুলিশের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকেও দেখতে পাই।

আন্দোলনকারীরা গেটের সামনে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা করে এবং কেউ কেউ কথা বলার চেষ্টাও করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যেতে চায়।

এ সময় পুলিশ এবং তাদের সাথে থাকা ব্যক্তিরা বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। আন্দোলনকারীরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এর পর পলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে।

তখন বেলা ২টা পার হয়ে গেছে। আমরা ওই সময়কার ভিডিও ফুটেজ সরাসরি এনটিভিতে প্রেরণ শুরু করি। বেলা আনুমানিক ২টা ১৩ মিনিটে আমার সহকর্মী আসাদুজ্জামান আরমানসহ আমি এনটিভির লাইভে যুক্ত হই।

২টা ১৭ মিনিটে দেখি, এক যুবক (পরে পরিচয় জানা যায়, আবু সাঈদ) কালো টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়ায়। সে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছিল। তখন গেটের কাছে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি তার বুক ও পেটে লাগে। সে কয়েক পা পেছনে যায়, বসে পড়ে, এরপর পড়ে যায়। এর পর কয়েকজন সহপাঠী তাকে উদ্ধার করে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যায়। এনটিভির লাইভে এই দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। একই সাথে আমাদের ক্যামেরা প্যান করে গেটের সামনে গুলি চালানো পুলিশদেরও দেখায়। এটি এআই দিয়ে তৈরি নয়। এটা এনটিভির লাইভ সম্প্রচারিত দৃশ্য। ফুটেজের একটি কপি আমি পেনড্রাইভে সংরক্ষণ করেছি এবং আজ আদালতে জমা দিয়েছি। তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই ছিল আমার জবানবন্দী।

জবানবন্দী শেষে শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষী মঈনুল হককে জেরা করে বলেন, এ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আপনি গুলির দৃশ্য ও আসামির দৃশ্য এক সময়ে এক সাথে ভিডিও করতে পারেন না। এ সময় আদালত বলেন, এ প্রশ্ন তো যুক্তিতর্কের সময় বলবেন এখন নয়। পরে আইনজীবী বলেন, আবু সাঈদ হত্যা করা ভিডিও ফুটেজটি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকদের অনেকে হাসাহাসি শুরু করেন। জবাবে সাক্ষী এ কে এম মঈনুল হক বলেন, এটি সত্য নয়। এ পর্যায়ে আদালত সাক্ষ্য শেষ করে মামলা মুলতবি ঘোষণা করেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews