ব্লগে লেখালেখির কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হিটলিস্টে আছেন কমপক্ষে ৮৪ ব্লগার। তবে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন-পরিবর্ধন হচ্ছে এই তালিকা। হিটলিস্টে ঢুকছে নতুন নতুন নাম। কার আগে কাকে আক্রমণ করা হচ্ছে সেই লক্ষ্যবস্তুও পরিবর্তিত হচ্ছে দিন দিন। গত ফেব্রুয়ারিতে খুন হয়েছেন ব্লগার অভিজিৎ রায়। মার্চে খুন হলেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু। এ পর্যন্ত গত এক বছরে মোট খুন হয়েছেন আটজন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং অ্যাক্টিভিস্টদের সমর্থক ও সহযোগী। এর মধ্যে সাতজন সরাসরি ব্লগিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সবার মৃত্যু হয়েছে মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। জানা যায়, বাংলাদেশে ব্লগে লেখার সূত্র ধরে উগ্রবাদীদের হিটলিস্টে থাকাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো খুনের ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালে। ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। তিনি থাবা বাবা নামের ব্লগে লেখালেখি করতেন। খুনের কয়েক দিন আগে জামায়াত-শিবির সমর্থিত সোনার বাংলা ব্লগে তাকে 'কতল' করার হুমকি প্রচার করা হয়। পরে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাসার সামনে নৃশংসভাবে খুন হন। একই দিন ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন অগ্রণী ব্যাংকের কর্মী জাফর মুন্সি। তিনি এর আগের দিন মতিঝিলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। পরে তার ওপর চালানো সংঘবদ্ধ আক্রমণে মাথায় মারাত্দক আঘাতে আহত হন তিনি। পরদিন তার মৃত্যু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় খুন হন ব্লগার মামুন হোসেন। ১ মার্চ খুন হন সিলেটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগজ্জ্যোতি তালুকদার। সেদিন রাত পৌনে ১০টার দিকে জগজ্জ্যোতি তালুকদার এক সঙ্গীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে নগরীর আখালিয়া বাজারের দিকে যাওয়ার সময় একদল উগ্রপন্থি তাদের কুপিয়ে গুরুতর আহত করে এবং মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতে জগজ্জ্যোতি তালুকদারের মৃত্যু হয়। ৯ এপ্রিল বুয়েটের শহীদ নজরুল ইসলাম হলে ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী হেফাজতে ইসলামের সমর্থক মেজবাহ উদ্দিনের চাপাতির কোপে গুরুতর আহত হন আরিফ রায়হান দীপ। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান গ্রামের ফ্ল্যাটে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করা হয় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও মুক্তচিন্তার সমর্থক আশরাফুল ইসলামকে। ৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যুগ্ম-সম্পাদক ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে। একই সময় আহত হন আরেক ব্লগার ও অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

খুনের ঘটনার বাইরে চাপাতি দিয়ে কোপানোও হয়েছে কয়েকজনকে। তারা ভাগ্যগুণে খুন না হলেও দীর্ঘদিনের চিকিৎসার পর সুস্থ হন। এর মধ্যে দুই দফায় কোপানো হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে। তাকে ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় নিজ কার্যালয়ের সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। ওই বছরের ৭ মার্চ রাতে মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের কাছে কুপিয়ে জখম করা হয় ব্লগার সানিউর রহমানকে। ২০১৩ সালের জুনে এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় কোপানো হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাকিব আল মামুনকে।

এর বাইরে উগ্রপন্থিদের হাতে বিভিন্ন সময় খুন হয়েছেন আরও অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে হামলার শিকার হন অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ। চাপাতি ও কুড়ালের কোপে মারাত্দক আহত ড. হুমায়ুন আজাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছর ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে মারা যান। গেল বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও মুক্তচিন্তার লেখক শফিউল ইসলাম লিলনকে বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটিতেই টার্গেট ছিল মস্তিষ্ক ও মাথা। কারণ উগ্রপন্থিরা মনে করে, মস্তিষ্কই তাদের মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। পেছন থেকে কোপানো হয়, যেন চেহারা না দেখা যায়।

এদিকে অনলাইন ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০১৩ সালে ৮৪ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। সূত্রমতে, এই তালিকায় থাকা ব্লগার ও নতুন সংযোজিতদেরই হিটলিস্টে রেখেছে উগ্রপন্থিরা। তবে ব্লগ-সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বেশির ভাগ কোনোভাবেই ধর্ম অবমাননার সঙ্গে জড়িত নন। তারা শুধুই মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী। সূত্রমতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর শাহবাগে মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারসহ নতুন প্রজন্মের গণজোয়ারের পর এই ৮৪ জনের তালিকা তৈরি হয়। রাজীব হায়দার খুন হলে তালিকায় থাকা অন্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ হয় সরকার। তখন সিদ্ধান্ত হয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার। পরে পুলিশের বিশেষ শাখার গোয়েন্দারা প্রায় এক মাস ব্লগারদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, পারিবারিক অবস্থানসহ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেন। বলা হয়, তালিকাভুক্ত অনেকেরই আগ্নেয়াস্ত্র কেনার ক্ষমতা নেই। এ ছাড়া ২৩ ব্লগারের আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় এবং সংরক্ষণের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এর পরই ব্লগারদের অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি ঝুলে যায়। থেমে যায় ব্লগারদের নিরাপত্তার বিষয়টি।

এসব বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও ব্লগার ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা দিতে উদাসীন। ব্লগারদের হত্যা করছে ধর্মান্ধরা। কিন্তু হত্যার তেমন কোনো ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ। কাউকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে হত্যাকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে আরও বেশি শক্তি অর্জন করছে। অন্যদিকে ব্লগার অনন্য আজাদ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন মন্তব্য করে বলেছেন, '২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই। সে সময় পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে নাস্তিক-মালাউন বলে গালি দেয়। যে পুলিশ আমাদের নাস্তিক-মালাউন বলে গালি দেয়, তাদের কাছে আমরা সুরক্ষা আশা করতে পারি না।'



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews