করোনা মহামারীর প্রকোপে আজ প্রায় সাড়ে তিন মাস আমরা কাগজে-কলমে ঘরবন্দি আছি। হোম কোয়ারেন্টিন, লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব যারা মানছেন না, তাদের কারণেই ‘কাগজে-কলমে’ কথাটা লিখলাম। অস্বস্তিকর এ বন্দিজীবন আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। একটু-আধটু অফিস-আদালত, মিল-কারখানা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজা খুললেও পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রয়ে গেছে।
প্রয়োজনের তুলনায় করোনা পরীক্ষা সিকি ভাগও হচ্ছে না। তাই সংক্রমণ বাড়ার প্রকৃত পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যা কম-বেশি ৪০-এর আশপাশেই ঘুরছে। এর বাইরে উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে। শঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্য দিয়ে মানুষের দিন কাটছে। ঘরবন্দি জীবনের অস্বস্তি তো রয়েছেই।
কিন্তু এতটা আতঙ্কিত হওয়া এবং অস্বস্তিতে থাকার কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সরকারি নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অনেকেরই ইতিহাস পাঠবিমুখ একটি চরিত্র রয়েছে। ব্যতিক্রমদের কথা সব সময় আলাদা। পৃথিবীর, ভারতের এবং বাংলার মহামারীর অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে সেসব ছবি যদি মনের ক্যানভাসে ভাসিয়ে রাখতে পারি, তবে অনেক পথনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব; এ সংকটকালে যা আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে আসতে পারে।
পৃথিবীতে মানুষ খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে অসংখ্যবার মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক মহামারীও হয়েছে কয়েকবার। এ সময়ের চেয়ে অনেক কম বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল তখন। প্রতিষেধক বা চিকিৎসাও তেমন পায়নি আক্রান্ত মানুষ। তবে অনেক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্য সচেতন ও সতর্ক থেকেছে। এভাবে একটি বর্ম তৈরি করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে মানুষ।
এ বাংলায় ষোলো শতক থেকেই অনেকবার মহামারীর মুখোমুখি হতে হয়েছে বাঙালিকে। প্রতিবারই লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। তবু হার মানেনি মানুষ। হার মেনেছে মহামারী। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখক আবুল কাশিম ফিরিস্তার বর্ণনায় জানা যায়, ১৫৪৮ সালে বিহারে ভয়ানক প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। প্লেগ অনেক প্রাচীন রোগ।
খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে সুমের অর্থাৎ আজকের ইরাকে ভয়াবহ প্লেগ ছড়িয়ে ছিল। মানুষ যখন জাগতিক কোনো সহায়তা পায় না, তখন ঐশ্বরিক শক্তির সাহায্য কামনা করে। আর এ কারণেই ‘নারগল’ নামে একজন দেবতা যুক্ত হন সুমেরের ধর্মবিশ্বাসে। তিনি ছিলেন প্লেগ রোগের বিশেষ দেবতা।
বাংলায় প্লেগ ও কলেরা ভয়াবহ মহামারী হিসেবে কয়েকবারই দেখা দিয়েছে। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আফগান সুলতানদের শাসন ছিল। এ সময় রাজধানী গৌড়ে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। প্লেগের ধরন অনেকটা করোনার মতোই। জ্বর, মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি এবং ভীষণ ছোঁয়াচে; কিন্তু চিকিৎসা তেমন না থাকায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্লেগে গৌড়ে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যেত। এত শবদেহ দাফন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মরদেহ বিল-ঝিল আর ভাগীরথী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। এ সময় বাংলা জয় করতে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের সেনাপতি খান-ই-খানান মুনিম খান। তিনিও প্লেগে আক্রান্ত হয়ে গৌড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৯৬-এর প্রথমদিকে বোম্বেতে প্লেগ রোগের সূচনা হয়। দ্রুত মহামারী আকারে কলকাতা ও আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছিলেন। ঠিক একইভাবে করোনা নিয়েও আমাদের অভিজ্ঞতা নতুন। ইংরেজ সরকার এইচ এইচ রিজলিকে প্রধান করে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে।
এ বোর্ডে ইংরেজ ডাক্তারের পাশাপাশি এদেশীয় ডাক্তারদেরও রাখা হয়। যুক্ত করা হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের মানুষকে। প্রথমদিকে সরকারের মধ্যে একটু রাখঢাক ছিল। এদিকে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সিম্পসন তার রিপোর্টে জানান, ১৮৯৬-এর আগেই কলকাতায় প্লেগ রোগ শুরু হয়; কিন্তু সরকারি মেডিকেল বোর্ড তা স্বীকার করতে চায়নি।
১৮৯৮-এর মধ্যে ব্যাপকভাবে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষ মারা যেতে থাকে। এ সময়ের করোনাকালের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা সামনে চলে এসেছিল তখন। সে যুগে স্বাস্থ্য দফতর আরও অসহায় অবস্থায় ছিল। ওষুধ-ভ্যাকসিন বলতে গেলে কিছুই ছিল না। সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলা হয়। শহরের ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার বিশেষ ব্যবস্থা নেয় পৌরসভা।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ কমানোর কথা বলা হয়। দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে প্লেগ সংক্রমণের হার বেশি ছিল। ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছিল বেশি। একটি লক্ষণীয় বিষয়- নারীদের চেয়ে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। জীবন হারিয়েছে পুরুষই বেশি। করোনার ক্ষেত্রেও একই ফলাফল। এর প্রধান কারণ, সে যুগে নারীরা বাইরে বেরোত কম। এখনও কি অনেকটা অভিন্ন কারণ নয়? এ উদাহরণের সূত্রে সামাজিক সংস্পর্শ থেকে দূর থাকার বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা মানতে হবে।
কলকাতা শহরে প্লেগ রোগীদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল তৈরি হতে থাকে। ইংল্যান্ড থেকে অনেক ডাক্তার নিয়ে আসা হয়। এখানেও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা কাজ করে। মুসলমানরা দাবি করে, তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতাল করার টাকা তারাই দেবে। মাড়োয়ারিরা নিজেদের জন্য আলাদা হাসপাতাল তৈরি করে কলকাতায়।
বলা যায়, ১৮৯৮ পর্যন্ত প্লেগের চিকিৎসার ব্যাপারে ডাক্তারদের সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্লেগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। আমরা যেমন নিয়ন্ত্রণহীন প্রশাসনিক দুর্বলতায় শহরের রোগ গ্রামে ও বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দিয়েছি, সে যুগে কিন্তু শহরের মানুষকে কঠিনভাবে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
গ্রামের মানুষও সচেতনতা দেখায়। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য অনেক জায়গাতেই বাঁশের সাঁকো ভেঙে দিয়ে গণসংযোগের সুযোগ কমিয়ে দিত। এমন কী কোনো প্লেগ রোগী মারা গেলে সংক্রমণ না ছড়ানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে রোগীর ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিত। স্বাস্থ্যবিধি মানায় শেষ পর্যন্ত প্লেগ মহামারীকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল বাংলার মানুষ।
আরেক প্রাণঘাতী মহামারী ছিল কলেরা। ১৮১৭ সালে এ মহামারীর প্রাদুর্ভাব প্রথম দেখা দেয়। কলকাতা থেকে কলেরা ছড়ানো শুরু হয়। ক্রমে তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, চীন প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সে সময় এক কলকাতাতেই গড়ে প্রতি হাজারে ১১-১২ জন মানুষ মারা যেত।
১৮১৭ সালে শুরু হওয়া কলেরা মহামারী ১৮২৪ পর্যন্ত কম-বেশি এর দাপট নিয়ে অব্যাহত থাকে। এরপর একই সময়ে না হলেও বিভিন্ন পর্যায়ে কলেরা বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়। সারা পৃথিবীজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১৮৯৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে রাশিয়ার অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ। এ সময়ে রাশিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ কলেরায় মারা যায়। ১৮১৭ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ভারতে কলেরা গ্রাস করে দেড় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। ১৮৭৯-এর আগে কলেরার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।
ফলে খুব অসহায়ভাবেই মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ১৮১৭ সালের কলেরায় ঢাকায় প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দু’শ মানুষ মৃত্যুবরণ করত। তখন ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো হাসপাতালও ছিল না। সে সময় ঢাকার কালেক্টর স্যার রবার্ট মিটফোর্ডকে এ বাস্তবতা ব্যথিত করে। ১৮২৮ সালে তিনি দেশে ফিরে যান। মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তি উইল করে যান ঢাকায় হাসপাতাল তৈরি করার জন্য। মিটফোর্ড হাসপাতাল তৈরির ইতিহাস এখান থেকেই শুরু হয়।
এ সময় কলেরায় বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। প্রতিদিনই এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে কান্নার রোল শোনা যেত। এমন অসহায় অবস্থায় মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই পাথরযুগের মানুষ থেকে শুরু করে এ আধুনিক যুগ পর্যন্ত এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল। বলা হয়, কলেরা মহামারীর সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মন্দির, পুরোহিত তান্ত্রিকদের দ্বারস্থ হতো। কলেরার একটি স্থানিক নাম ছিল ওলাওঠা। প্রাচীন সুমেরীয়রা যেমন প্লেগের দেবতা রূপে ‘নারগল’কে সৃষ্টি করেছিল; তেমনি গ্রাম-বাংলায় আবির্ভাব হল ওলাদেবীর।
অসহায় মুসলমান গ্রামবাসী ছুটলেন পীরের দরগায়; ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, তাবিজ-কবজে মুক্তি পেতে চাইলেন। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল কমল না। কলেরা ছড়ানোর পেছনে জীবাণুবাহিত পানিপান ছিল সবচেয়ে বড় কারণ। সে যুগে গ্রাম-বাংলায় পুকুর ও নদীর পানির ওপরই ভরসা ছিল। রোগের কারণ শনাক্তের পর মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা নেয়া হতে থাকে। এ সচেতনতার পথ ধরেই ক্রমে কমে আসতে থাকে কলেরার প্রাদুর্ভাব।
ইতিহাসের এ ছবি থেকে আমাদের আজকের করোনাকালে শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। আমরা দেখেছি, এ বৈশ্বিক মহামারীতে সারা পৃথিবীর মানুষকে লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টিন মানাতে কষ্ট হয়েছে। এর একটি কারণ হতে পারে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা থাকায় মানুষের মধ্যে একটি নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে করোনাযুদ্ধে অসহায় হয়ে পড়েছিল উন্নত দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাও।
এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা যে আরও করুণ, এ কথা বুঝতে চান না অনেক সাধারণ মানুষ। আমাদের পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় স্বাস্থ্য বিভাগ ও চিকিৎসাব্যবস্থা দুর্নীতিতে তলিয়ে গেছে। এবার করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়েছে। তাই ১৬ থেকে ১৯ শতকের অসহায় মানুষের মতো আমাদেরও আত্মচৈতন্যে ফেরা উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া এ মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।
অনেক জীবনের বিনিময়ে হলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের পূর্বসূরিরা মহামারীকে পরাজিত করেছিলেন। সে যুগের তুলনায় এখন তো আমরা অনেক বেশি সবল। একটু নিজেদের সংযত রেখে যদি ব্যক্তি এবং সমাজ ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারি, তাহলে কেন সে পথে হাঁটব না!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়