এবার ছুটিতে গারো পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সুযোগ পেলেই যাই। একদিকে গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে সরল সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম আতিথেয়তা। কয়েকবারই ওয়ানগালায় গিয়েছি। দেশ-বিদেশের অনেকেই যায়। কবি শামসুর রাহমানও গিয়েছেন এবং ওয়ানগালায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসে অনুভূতি লিখেও প্রকাশ করেছেন। ওয়ানগালা কী, সে সম্পর্কে দুটি কথা বলা প্রয়োজন। আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে বনজ ফল খেয়ে বেঁচেছিল। সমগ্র মানবজাতিও একইভাবে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। হঠাৎ তারা ঘাসের মধ্যে ধান আবিস্কার করে। এই ধানকে চালে রূপান্তর করে ভাতের সন্ধান পায়।
মানুষের এই আবিস্কারকে আদিবাসীরা ধরিত্রীর মার অবদান বলে মনে করে। তাই ফসল তোলার কালে এই উৎসবের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই উৎসবই হচ্ছে ওয়ানগালা। ওয়ানগালায় নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র সহকারে নৃত্যগীত হয় এবং আদিবাসীদের খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করা হয়। এই উৎসবে আদিবাসীরা নিজেদের তৈরি বস্ত্রাদিও পরিধান করে। বাংলাদেশের অবিভক্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়কে ঘিরেই গারো বা মান্দীদের বসবাস। বর্তমানে টাঙ্গাইলের মধুপুর, ঘাটাইল ও নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত একসময় শুধু গারোদের বসবাস ছিল। বর্তমানে সেখানে প্রচুর বাঙালি বসবাস করে এবং গারো পাহাড়ের মূল ভূখণ্ড এখন ভারতের মেঘালয়ে। মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সহযোগী ছিল। মেঘালয়ের প্রধান শহর তুরা তখন ছিল আসামের অন্তর্গত। এই তুরাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ট্রেনিং ও যুদ্ধ পরিকল্পনা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এবং তার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গারোরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ ও পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরও এ অঞ্চলে গারোদের মেঘালয়ে অভিবাসন বন্ধ হয়নি।
যাই হোক, আমরা দু'জন ছুটির মধ্যে গারো পাহাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা প্রথমে যাব ধোবাউড়ায় এক গ্রামে, তারপর হালুয়াঘাট হয়ে আসকিপাড়া। আমাদের গন্তব্যে যেতে হলে তারাকান্দা থেকে ডানে যেতে হয়। তারাকান্দা থেকে ধোবাউড়া পর্যন্ত পথ এমনই ভাঙাচোরা যে, মেরুদণ্ডের হাড় পর্যন্ত টের পেয়ে যায়। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে গোবিন্দপুরে আমাদের এক সহকর্মীর বাড়িতে উপাদেয় মধ্যাহ্নভোজ সম্পন্ন করি। রাস্তার অবস্থা দেখে আমরা বেশ বেলা থাকতেই হালুয়াঘাটের পথে রওনা দিই। গোবিন্দপুর থেকে ধোবাউড়া পথটা একটু সহনীয় হলেও হালুয়াঘাটের পথ কখনও একটু ভালো হলে আশায় বুক বাঁধি, বাকি পথটা সে রকমই থাকবে। কিন্তু মুহূর্তেই সে স্বপ্ন খানখান হয়ে যায়। আবার পথ কণ্টকাকীর্ণ।
হালুয়াঘাটে এসে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাবলাম, একটু পরেই পথটা মসৃণ হবে। কিছুটা হলেও সে আশায় মরীচিকা। যাই হোক, শাপলা বাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একই রকম পথে একমাত্রা বলে একটি প্রতিষ্ঠানে বৈকালিক চায়ের আতিথেয়তা গ্রহণ করি। আমার সফরসঙ্গী বন্ধু মমতাজ ভুইয়া দীর্ঘদিন জাপানে ছিলেন। তার স্ত্রীও ছিলেন জাপানি এবং অপর্ণা সেনের ছবি জাপানিজ ওয়াইফের মতোই বাংলাদেশপ্রেমী হয়ে ৩৭ বছর এ দেশে বসবাস করে কিছুদিন আগে আবুধাবিতে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এই একমাত্রা প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হিরোকি এক জাপানি যুবক এবং তার স্ত্রী অভিনেত্রী মা য়ে এবং আরও কিছু বাঙালি বন্ধু মিলে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যংকের সহায়তায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেখানে অসহায় শিশুদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষার ব্যবস্থা করে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। সেখানকার ব্যবস্থা দেখে এবং শিশুদের সঙ্গে কথা বলে আমরা মুগ্ধ হলাম। একই সঙ্গে একটা অনিশ্চয়তা বোধ করলাম। কারণ এ দেশে কোনো মহৎ কাজ অনেক দিন চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। কীভাবে যেন ভালো কাজের মধ্যে দুর্বৃত্তরা ঢুকে যায়! এই দুর্বৃত্তরা খুবই বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধিকে খারাপ কাজে লাগানোর জন্য নানা রকম ফন্দিফিকির তাদের জানা। সরল জাপানি যুবক বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে কাজটি করছেন; কিন্তু তিনি কি দুর্বৃত্তদের বুঝতে পারবেন? এসব চিন্তা করা ঠিক নয়। আশা করি, ঠিক তিনি পৌঁছে যাবেন তার গন্তব্যে।
সন্ধ্যার পর আমরা আবার আসকিপাড়া পর্যন্ত গাড়ির চাকার সঙ্গে এবড়োখেবড়ো পথের কঙ্করের প্রবল যুদ্ধ শেষে যাত্রাবিরতি করলাম। আসকিপাড়ায় আমার বহুদিন ধরে যাতায়াত। প্রতিবারই ভাবি, এবার বুঝি বিদ্যুতের আলো দেখতে পাব। পৌঁছেই আলো দেখলাম ঠিকই; কিন্তু জেনারেটরের ঘড়ঘড় শব্দ। পরদিন সকালেই বারোয়ারি মিশনের দিকে যাত্রা। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, উন্নয়নে পশ্চাৎপদ কিন্তু সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এই আদিবাসী জনপদে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আসেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে চমৎকার মিশন, চার্চ, স্কুল ও হাসপাতাল গড়ে তোলেন। মধুপুরের জলছত্র এবং হালুয়াঘাটে দুটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তা এতই খারাপ, রীতিমতো কোদাল দিয়ে এক জায়গার গর্ত বন্ধ করে আবার যাত্রা। কিন্তু নালিতাবাড়ীর সীমানায় পৌঁছেই চমৎকার পথ। শুনলাম, এই পথে রংপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়। বারবার সবার মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল মতিয়া চৌধুরীর নাম। এসব অগ্নিকন্যার অবদান। বারোয়ারি মিশনে ঢুকে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। মনে হতে পারে, এটি একটি চমৎকার পরিচ্ছন্ন রিসোর্ট, আবার নানারকম ভাস্কর্যে সুসজ্জিত এসব পাহাড়কে অক্ষত রেখে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা করা হয়েছে। তারপর আবার আসকিপাড়ায় ফিরে আসা।
জেনারেটরের বিদ্যুতে হয়তো রাত কাটানো যেত; কিন্তু সমস্যা হলো ওইদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। খেলা দেখতেই হবে। বুদ্ধিমতী গারো কন্যা মলয়া বলল, একমাত্র উপায় হচ্ছে আদিবাসী লেখক ও নেতা সঞ্জীব দ্রংয়ের মায়ের বাড়ি সাংড়ায় গিয়ে খেলা দেখা যেতে পারে। সেও এক দুর্গম পথ, তবুও গেলাম এবং খেলা দেখে মধ্যরাতে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে প্রত্যাবর্তন। পরদিন ভোরে আবার সেই তিক্ত পথে হালুয়াঘাট ফেরা। হালুয়াঘাট সীমান্ত পেরিয়ে ফুলপুরের দিকে রওনা হই। পথ খুবই মসৃণ। ময়মনসিংহ পর্যন্ত আরামদায়ক ভ্রমণ। সেখান থেকে ঢাকার তো কথাই নেই। বাংলাদেশে পথঘাট ও বিদ্যুতের যথার্থ উন্নতি সত্ত্বেও হালুয়াঘাটে কেন পথঘাট নেই; কেন বিদ্যুৎ নেই- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ নয়। কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই যে, এ অঞ্চলকে বঞ্চিত করতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায়, উন্নয়ন কি তাহলে বৈষম্যের বেড়াজালে বন্দি? যদি তাই হয় তাহলে এ বেড়াজাল ছিন্ন করতে হবে সামগ্রিক স্বার্থ কিংবা প্রয়োজনে। এ রকম চিত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও রয়েছে।
নালিতাবাড়ী, ফুলপুর বঞ্চিত হলো না; তাহলে ওই অঞ্চলটি বঞ্চিত হলো কেন? যদিও ফুলপুরের অধীন তারাকান্দা, ধোবাউড়ার কিছু পথের অবস্থা হালুয়াঘাটের মতোই। আমার বন্ধু মমতাজ বারবার বলছিলেন, সরকারের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রচুর বরাদ্দ আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের জন্য অর্থ দিতে চায়। কারণ এত বড় জনসংখ্যার মধ্যে তাদের বিনিয়োগ অর্থবহ হবে। তারপরও এ অঞ্চলের পথঘাটের উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না কেন? কিছু জায়গায় পথঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ, তা মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই। খুবলে খুবলে পড়ে আছে কংক্রিটের পথ। আমাদের চালক খুবই বুদ্ধিমান, রাজনীতিসচেতন মানুষ। তিনি স্থানীয় নেতৃত্বের দোষারোপ করছিলেন। এলাকার চেয়ারম্যান, সাংসদ, মন্ত্রীকে দায়ী করছেন বারবার। সব শেষে তিনি বললেন, এখানকার পাবলিকের সহনশীলতাও বেশি। কিন্তু এই সহনশীলতা সহ্যের সীমা অতিক্রম করুক, তা আমরা কেউ চাই না। আশা করব, আগামী ওয়ানগালায় আমরা ওই এলাকায় বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাটের সুব্যবস্থা দেখতে পাব। দেশের উন্নয়ন সামগ্রিক অর্থে যদি বৈষম্যের বেড়াজালমুক্ত হতে না পারে, তাহলে তা যেমন টেকসই হবে না, তেমনি এর সুফলও সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারবে না।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব