চিকিৎসকদের কেউ কেউ বলছেন, নতুন এ প্রযুক্তি রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ডাক্তারদের কাজে আসতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ওয়াটসন ফর অনকোলজি বাংলাদেশে কতটা কার্যকর হবে তা পরীক্ষিত নয় এবং তা অনুমোদনও পায়নি।

ওয়াটসন ফর অনকোলজি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন, যার কাজ হল তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্যান্সার রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চিকিৎসককে সহায়তা করা।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস (আইবিএম) ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওয়াটসন সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের স্লোয়ান কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারের সঙ্গে চুক্তি করে।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিশ্বখ্যাত ওই প্রতিষ্ঠানের অনকোলজিস্টদের বিশ্লেষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতির তথ্য ব্যবহার করে ওয়াটসনকে রোগীদের রিপোর্ট বুঝতে ও চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরিতে ‘প্রশিক্ষিত’ করে তোলা হয়।

আইবিএম-এর দাবি, ওয়াটসন এখন ১৩ ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় ‘প্রশিক্ষিত’। বিশ্বের ১৫৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ওয়াটসনকে তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছে।

তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটানোর অঙ্গীকার নিয়ে এসে শুরুতে অনেক বেশি আলোচনায় থাকলেও ওয়াটসন নিয়ে উচ্ছ্বাস পরে আর ততটা থাকেনি।

অনকোলজিস্টদের এডুকেশনাল পোর্টাল অনকোলজিপ্রো ওয়াটসনকে ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘খুবই সহায়ক’ বলে মূল্যায়ন করেছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ সেইফটি বিভাগ গতবছর বলেছে, ওয়াটসন যেভাবে কাজ করে তাতে একে ‘মেডিকেল ডিভাইস’ বলা চলে না।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি ও রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে প্রশিক্ষিত এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের অন্য জায়গায় অন্য রোগীদের ক্ষেত্রে কতটা সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে, সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।

গত বছর জুনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি হাসপাতালে ওয়াটসন ফর অনকোলজি সেবা চালুর ঘোষণা দিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় আইবিএম। ঢাকায় তাদের এজেন্ট রাইট সল্যুশনস লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল ও আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল ওয়াটসনের সেবা নেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলছেন, বাংলাদেশের কোনো চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানে ওয়াটসন ব্যবহারের চুক্তির বিষয়ে তিনি অবগত নন।

“তারা আমাকে এখনো ইনফর্ম করে নাই। অনুমোদন নেওয়া ম্যান্ডেটরি। বাংলাদেশের কোথাও, গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত, কোনো প্রকার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সরকারের অনুমোদন ছাড়া পরিচালিত হতে পারে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এজেন্ট হল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখান থেকে অনুমোদন ছাড়া বা লাইসেন্স পাওয়ার আগে কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালাতে পারবে না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাইট সল্যুশনসের সিইও রিদওয়ান মুস্তাফিজ বলেন, তারা বাংলাদেশে ওয়াটসন ফর অনকোলজি সেবা পরিচালনায় অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। তবে এখনও অনুমোদন মেলেনি। 

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি এবং জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৫ লাখ। দেশে প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা।

রিদওয়ান মুস্তাফিজ বলেন, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার ক্যান্সার রোগীর বিপরীতে ডাক্তার আছেন মাত্র একজন। সব মিলিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন দেড়শ জনের মত। তাদের ৯৫ শতাংশ রেডিয়েশন অনকোলজির চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত। মেডিকেল অনকোলজির ডাক্তার মাত্র ৫ শতাংশ।

“আমাদের ডাক্তাররা অভিজ্ঞ হলেও বেশিরভাগই কাজ করেন ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে; তাই প্রত্যাশিত ফলাফল আসে না। ওয়াটসন ফর অনকোলজি সুনির্দিষ্টভাবে রোগীর জন্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান নিয়ে আসে।”

তিনি জানান, ২০১৬ সালে ভারতে স্তন ক্যান্সার বিষয়ক এক সম্মেলনে মনিপাল হাসপাতালের কেইসস্টাডি উপস্থাপন করা হয়, যেখানে দেখানো হয় চিকিৎসক বোর্ডের মতামতের সঙ্গে ওয়াটসনের পরামর্শ ৯০ শতাংশ মিলে গেছে।

ওয়াটসন ফর অনকোলজি সেবা নিয়ে এ বছর জানুয়ারিতে সুইডিশ প্রতিষ্ঠান ইলেকটার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আইবিএম। থাইল্যাণ্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালও ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওয়াটসন ব্যবহার শুরু করেছে।

যত বেশি ব্যবহার হবে, যত বেশি রোগী ও রোগের তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ হবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হিসেবে ওয়াটসনের দক্ষতা তত বাড়বে বলে আইবিএম সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। 

তারা বলছেন, চিকিৎসা পদ্ধতির সুপারিশ করার ক্ষেত্রে নিজের বিশ্লেষণের জন্য ৩০০ মেডিকেল জার্নাল, ২০০ পাঠ্যবই এবং প্রায় ১৫ মিলিয়ন পৃষ্ঠার তথ্য আছে ওয়াটসনের স্মৃতিতে।

রিদওয়ান মুস্তাফিজ বলেন, “আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম ঢাকা মেডিকেল, ক্যান্সার সেন্টার, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ওয়াটসনের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য। সরকারি হাসপাতালে হলে গ্রামের মানুষ ওখানে বসেই বিশেষজ্ঞ অভিমত পেত।

“আমরা সরকারকে অনুরোধ করব ফান্ড বরাদ্দের জন্য। অপর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার সব রোগীর দেখভাল ঠিকমত করতে পারছেন না। ওয়াটসনের মত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিসটেমের সুবিধা নিয়ে ডাক্তাররা তাদের কর্মদক্ষতা ২৩-২৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে পারেন। এতে তারা আরও বেশি রোগী দেখতে সক্ষম হবেন।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা অ্যাডিশনাল টুল হতে পারে। এগুলো হলে ভালো। তবে এটা মানুষের জন্য কল্যাণকর কিনা তা আপনি বা আমি বললে হবে না, এটা বলতে হবে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে।” 

এ প্রশ্নে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, “আমাদের দেশে অনকোলজি বিষয়টা তুলনামূলকভাবে নতুন। হাসাপাতালে রোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহের কাজটি যদি অটোমেটেড করা যায়, একটা ডাটাবেইজে যদি রাখা যায়, তাহলে রোগী সম্পর্কে তথ্য জানা সহজ হবে ডাক্তারদের। পাশাপাশি ক্যান্সার গবেষণায় রোগীদের কেইসগুলো ব্যবহার করা যাবে।”

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল ও আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় যুক্ত অধ্যাপক কামরুজ্জামান চৌধুরী মনে করেন, দেশের তরুণ অনকোলজিস্ট ও প্রান্তিক এলাকার ডাক্তারদের জন্য ওয়াটসন সহায়ক হতে পারে।

“এই সিস্টেমে সময় সাশ্রয় করা সম্ভব। রেয়ার ক্যান্সার কেইসে ওয়াটসনের ট্রায়াল পাওয়া না গেলেও নিয়মিত কেইসগুলোতে ওয়াটসন ফলাফল দিতে পারে। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে বাংলাদেশের অ্যাডভান্সড কেইসগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা গেলে তা ক্যান্সার গবেষণা ও চিকিৎসায় সহায়ক হবে। অবশ্য সেজন্য আইবিএমের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।”

বাংলাদেশে ওয়াটসনের সেবা পেতে কেমন খরচ হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি স্পেশালাইজড হসপিটাল বা আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে।

তবে রাইট সল্যুশনস বলছে, ওয়াটসনের সেবা নিতে একজন রোগীর একবারে ২৫ হাজার টাকার মত লাগতে পারে, যা দিয়ে তিনি পাঁচ বছরের চিকিৎসা পরিকল্পনা পেতে পারেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews