কাশ্মীরে নিহত মাদ্রাসা শিক্ষককে যেভাবে 'সন্ত্রাসী' তকমা দিয়েছে ভারতের গণমাধ্যম

ছবির উৎস, Farooq Ahmed

ছবির ক্যাপশান,

মুহাম্মদ ইকবাল সাতই মে সকালে নিহত হন

  • Author,

    শেরিল্যান মোলান

  • Role,

    বিবিসি নিউজ, মুম্বাই

  • ২০ মিনিট আগে

ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গেলে এখনও ফারুক আহমেদ রাগে ফুঁসছেন।

সীমান্তের অন্যপাশ থেকে উড়ে আসা গোলার আঘাতে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইকবাল সাতই মে সকালে নিহত হন। আগের দিনই পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত।

পাকিস্তান অবশ্য পহেলগামের হামলায় তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

মি. আহমেদ বলছিলেন, যে জিয়া-উল-উলুম মাদ্রাসায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতেন, সেখানেই মারা যান তার ভাই মি. ইকবাল।

তবে তার মৃত্যুটা ছিল পরিবারের সামনে সমস্যার শুরু।

মি. ইকবালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে মিথ্যা অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল যে, ওই অভিযোগ অসত্য।

পুঞ্চ শহরে মুহাম্মদ ইকবালের বাড়ি

ছবির উৎস, Farooq Ahmed

ছবির ক্যাপশান,

পুঞ্চ শহরে মুহাম্মদ ইকবালের বাড়ি

'কাটা ঘায়ে লবনের ছিটা'

"আমার ভাই একজন শিক্ষক ছিল, কিন্তু তারা তার দাড়ি ও মাথার টুপি দেখেই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে," বলছিলেন মি. আহমেদ।

"এটা যেন আমাদের কাটা ঘায়ে লবনের ছিটা দেওয়া। আমরা ইকবালকে হারিয়েছি আর তারপরেই গণমাধ্যম তাকে অসম্মান করল।মৃত মানুষ তো আর নিজের হয়ে কিছু বলতে পারে না!" বলছিলেন ফারুক আহমেদ।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারদিন ধরে চলতে থাকা সামরিক সংঘাতের সময়ে পাল্টা-পাল্টি গোলাবর্ষণে মি. ইকবাল সহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন।

পাকিস্তান ৪০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে, তবে এর মধ্যে কতজন সরাসরি গোলাবর্ষণের কারণে মারা গেছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

একদিকে যখন সামরিক সংঘাত বাড়ছিল, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি লড়াই শুরু হয় – অনলাইন ও টেলিভিশনে ভুয়া খবর ছড়ানোর লড়াই।

মি. ইকবালের পরিচয় নিয়ে যেমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তেমনই টিভি ও সংবাদ পোর্টাল সহ মূলধারার গণমাধ্যমে আরও নানা বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল।

এইসব ভুয়া তথ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল যে পাকিস্তানের করাচী বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত। যদিও পরে ভারত সরকার নিজেরাই এই তথ্য ভুয়া বলে জানিয়েছিল।

কিছু কিছু ভুয়া খবর আবার চিহ্নিত করাও কঠিন ছিল, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের মুখে এরকম কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তার দেশের দুটি যুদ্ধবিমান সংঘর্ষে ধ্বংস হয়েছে।

"উগ্র দেশপ্রেম এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ওই সংঘাতের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে" - প্রতীকী ছবি

ছবির উৎস, Ritesh Shukla/Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

"উগ্র দেশপ্রেম এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ওই সংঘাতের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে" - প্রতীকী ছবি

মাত্রা ছাড়া ভুয়া খবর

ভারতের একটি স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল নিউজ লন্ড্রির ম্যানেজিং এডিটর মনীষা পাণ্ডে বলছিলেন, "যে মাত্রায় ভুয়া তথ্য এবং যাচাই না করা তথ্য প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।"

তিনি এটা অবশ্য মেনে নিয়েছেন যে, চ্যানেলগুলি দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় কিছুটা যে আবেগ উসকিয়ে দেওয়ার মতো খবর করবে, এটা প্রত্যাশিত, তবে যে "উগ্র দেশপ্রেম এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন"ভাবে ওই সংঘাতের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তার মাত্রা ছিল অভূতপূর্ব, অন্তত তিনি আগে কখনও এরকমটা দেখেন নি।

চ্যানেলগুলির এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রচারের ফল মি. আহমেদের থেকে বেশি বোধহয় আর কাউকে ভোগ করতে হয় নি।

"আমি জানি না নিউজ চ্যানেলগুলো কোথা থেকে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে খবর পেয়েছিল," বলছিলেন মি. আহমেদ।

"কার সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা? আমার ভাই যে সন্ত্রাসবাদী তার কী প্রমাণ ছিল তাদের কাছে ?" প্রশ্ন মি. আহমেদের।

ঘটনার পরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, তবুও ওই পরিবারটি এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

ফারুক আহমেদ

ছবির উৎস, Farooq Ahmed

ছবির ক্যাপশান,

ফারুক আহমেদ

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানা যায়

ফারুক আহমেদ বলছিলেন যে সাতই মে তার ভাই প্রতিদিনের মতোই সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। তবে ফিরে আসে তার প্রাণহীন দেহটা।

দুপুরের মধ্যে তারা তাকে বাড়ির কাছেই একটি কবরস্থানে দাফন করেন।

পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন মি. ইকবালের শেষকৃত্যে, তাই বেশ কিছুটা সময় পর্যন্তও তারা জানতেনই না যে সংবাদমাধ্যমের একাংশে একটা মিথ্যা খবর দেখানো হচ্ছে।

বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ কেউ ফরোয়ার্ড করে। ওই মেসেজটি ছিল একটি নামকরা নিউজ চ্যানেলের একটি ভিডিও ক্লিপ।

সেখানেই দাবি করা হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনী একজন 'সন্ত্রাসীকে' হত্যা করেছে, খবরের সঙ্গে স্ক্রিনে মি. ইকবালের ছবি ভেসে উঠেছিল।

"আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরেই আরও মানুষ আমাদের ফোন করতে শুরু করেন। তারা জানতে চাইছিলেন যে ঘটনাটা আসলে কী, কেন গণমাধ্যমে ইকবালকে সন্ত্রাসী বলে খবর দেখাচ্ছে!" বলছিলেন মি. আহমেদ।

পুঞ্চ শহরে গোলাবর্ষণের পরে

ছবির উৎস, PUNIT PARANJPE/AFP via Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পুঞ্চ শহরে গোলাবর্ষণের পরে

পুলিশের বিবৃতি

ইকবাল আহমেদকে 'সন্ত্রাসী' বলে বর্ণনা করে খবর দেখিয়েছিল জি নিউজ, এবিপি এবং নিউজ ১৮ সহ আরও কয়েকটি চ্যানেল। এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ওই চ্যানেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি।

একটি চ্যানেল দাবি করেছিল যে মি. ইকবাল পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে "সন্ত্রাসী শিবিরের ওপরে ভারতীয় হামলায়" নিহত হয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী' ছিলেন।

মি. আহমেদ বলছিলেন, "আমাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে পুঞ্চে বসবাস করছেন। এটা তারা কীভাবে বলল যে আমার ভাই পাকিস্তানে ছিল? তাদের (গণমাধ্যমের) লজ্জিত হওয়া উচিত।"

মি. ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এত ব্যাপকভাবে এবং এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে আটই মে পুঞ্চ পুলিশ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট করে যে সীমান্তে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের সময়ে মাদ্রাসার ভেতরেই মারা গেছেন তিনি।

"পুঞ্চ পুলিশ এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দৃঢ়ভাবে খারিজ করছে। মৃত মৌলানা মুহম্মদ ইকবাল এলাকার একজন সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ ছিল না," জানিয়েছিল পুলিশ।

তবে এই বিবৃতিটা যখন আসে, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।

"তার আগেই তো ভুয়া খবরটা ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে," বলছিলেন মি. আহমেদ।

তিনি আরও বলছিলেন যে নিউজ ১৮ চ্যানেলটি ছাড়া আর কেউই ওই ভুলের জন্য প্রকাশ্যে তাঁর কাছে বা তাদের নিজেদের দর্শকদের কাছে ক্ষমা চায় নি।

পাকিস্তান থেকে উড়ে আসা গোলার টুকরো

ছবির উৎস, Muzamil Mattoo/NurPhoto via Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পাকিস্তান থেকে উড়ে আসা গোলার টুকরো

আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবনা

ফারুক আহমেদ বলেছিলে যে তিনি চ্যানেলগুলির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, তবে তাতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ তার পরিবারকে তো দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা লড়তে হচ্ছে এখন।

মি. ইকবালের দুই স্ত্রী ও আট সন্তান রয়েছে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য।

মি. আহমেদ বলছিলেন, সরকার যে কয়েক লক্ষ ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, তা দিয়ে তো মাত্র এক বা দুবছর চলতে পারে। তাই ভবিষ্যতের জন্য চিন্তাভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে তাদের।

"পুরো পরিবার আমার ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। সে খুবই শান্ত এবং ভদ্র মানুষ ছিল, বাচ্চাদের পড়াতে খুব পছন্দ করত," বলছিলেন মি. আহমেদ।

"কিন্তু এসব কথা এখন দুনিয়ার মানুষকে কে জানাবে! অনেকের কাছে আমার ভাই তো এখনও একজন সন্ত্রাসী, তাই তাকে মেরে ফেলা সঠিক কাজ হয়েছে। তারা আর আমাদের কষ্ট বুঝবে কী করে?" প্রশ্ন ফারুক আহমেদের।

অতিরিক্ত প্রতিবেদন: ভারত শাসিত কাশ্মীর থেকে আকিব জাভেদ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews