মহাসড়কে তীব্র যানজট, অগ্রিম টিকিট সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, গাড়ির জন্য কাউন্টারে কাউন্টারে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষাÑ সব মিলিয়ে এবারের ঈদুল আজহার যাত্রা ছিল দুর্ভোগের। গত ঈদুল ফিতরে যাত্রাপথ ছিল তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক। সেই অভিজ্ঞতায় অনেকেই ভেবেছিলেন, ঈদুল আজহার যাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘœ হবে। কিন্তু এবার বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, গেলো ঈদুল ফিতরের আগে লম্বা ছুটি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে থেকেই বন্ধ থাকায় মানুষ ধাপে ধাপে ঢাকা ছাড়তে পেরেছিল। এতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও চাপ সামাল দিতে পেরেছিল সহজে। কিন্তু ঈদুল আজহায় সরকারি ছুটি শুরু হয় ঈদের মাত্র দুই দিন আগে। ফলে ছুটির প্রথম দিন থেকেই ঢাকা থেকে ঘরমুখো মানুষের স্রোত নেমে আসে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে। ৫ ও ৬ জুন ঢাকার বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, যারা অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেছিল, তারাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাউন্টারগুলোতে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। আর যাদের টিকিট ছিল না, তারা পড়েছে দ্বিগুণ সমস্যায়। টিকিটের খোঁজে ছুটে বেড়ানো ও যারবাহনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে খোলা ট্রাকে, পণ্যবাহী পরিবহনে আবার কেউ ট্রেনের ছাদে যাত্রার চিত্র দেখা গেছে। অন্যদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশপথে কোরবানির পশুর হাট বসানো এবং পশুবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করায় বাস চলাচলে মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়তে এবং ঢাকায় ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।

বিভিন্ন মহাসড়কে দেখা গেছে দীর্ঘ যানজট। অনেক যাত্রীকে টার্মিনালে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কাউন্টার থেকে অগ্রিম টিকিটধারী যাত্রীদের বিলম্বে টার্মিনালে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। মহাখালী টার্মিনাল থেকে রওনা হওয়া যাত্রী ইসরাক রহমানের ‘৬ জুন রাত সাড়ে ৯টার বাস এসেছে রাত সাড়ে ১২টায়। রংপুরের পথে রওনা দিয়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত যমুনা সেতুর টোলপ্লাজায় আটকে ছিল। টিকিটের অতিরিক্ত দাম, তার ওপর এই যানজটে উত্তরবঙ্গের মানুষের ভোগান্তি চিত্র ছিল এমনই। গাবতলী টার্মিনালের আরেক যাত্রী নাঈম হোসেন ফারুক ৬ জুন ‘রাত ১২টার গাড়ি ছিল, কিন্তু ৭ জুন সকাল ৮টায় ওই বাস রওনা হয়। রাজশাহীগামী যাত্রী সাজ্জাদ জানান ‘৫ জুন সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে গাড়ি থাকার কথা থাকলেও বাস ছেড়েছে বিকেল ৫টায় আবদুল্লাহপুর থেকে।’ ঠাকুরগাঁওয়ের যাত্রী সাখাওয়াত জানান ‘৫ জুন রাত ১০টা ১৫ মিনিটের বাস এসেছে পরেরদিন সকাল ৯টায়।

বাসের সংখ্যা কম, যাত্রীর চাপ বেশি। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিযোগিতা। বিআরটিএ’র ভিজিল্যান্স টিম সক্রিয় থাকলেও টার্মিনালের বাইরের যানবাহনের ভাড়া নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়। এমনকি লোকাল বাসগুলোও অতিরিক্ত ভাড়ায় দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনেও ছিল বিশৃঙ্খল চিত্র। অতিরিক্ত যাত্রী সামলাতে গিয়ে যাত্রীসেবা ব্যাহত হয়। অনেক যাত্রী অনলাইনে অগ্রিম টিকিট না পেয়ে সরাসরি স্টেশনে গিয়ে হতাশ হয়েছেন। স্ট্যান্ডিং টিকিটও মিলছিল না। কেউ কেউ জোর করে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেছেন, এমনকি প্রতিটি ট্রেনের ছাদেও বিপুল যাত্রী উঠতে দেখা গেছে।

সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যানজট এড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। বিআরটিএ নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালায়। গোয়েন্দা সংস্থাও টিকিট কালোবাজারি ও যাত্রী নিরাপত্তায় সক্রিয় ছিল। তবে বাস্তবচিত্র ছিল ভিন্ন। যাত্রীচাপ ও প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে কোনও সংস্থাই পুরোপুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি।

ঈদের আগে ৫ জুন গাজীপুরের চন্দ্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক পরিদর্শন শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঈদের আগে ছুটি কম থাকায় একদিনে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। আমাদের বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু চাপ এত বেশি যে, আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আমরা ভেবেছিলাম, আগের ঈদের মতো নির্বিঘœ যাত্রা হবে, কিন্তু এবার মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ঈদের যাতায়াত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এসে ভোগান্তি কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন।

তবে এবারের ঈদুল আজাহায় ছুটি ব্যবস্থাপনা ঠিক না করলে দেশের যাত্রাসাধারণ ভয়াবহ দুর্ভোগে পরবেন এমন শঙ্কার কথা দেশের যাত্রী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সরকারকে বার বার সর্তক করেছিলেন। বিদায়ী ঈদুল ফিতরে লম্বা ছুটির কারণে ঈদযাত্রা স্বস্থিদায়ক হওয়ায় ঈদুল আজহায়ও সরকার ১০ দিন ছুটি দেন। সমীক্ষা ছাড়া এই ছুটি কাজে আসবে না বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে গত ১২ মে ২০২৫ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঈদের প্রস্তুতি সভায় তুলে ধরা হয়েছিল। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বিষয়টি সরকারের সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া, প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ এহসানুল হক, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিম ইসলামসহ সংশ্লিষ্টদের জানানো হলেও কেউ বিষয়টি আমলে নেননি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিগত ২৫ বছরের মধ্যে বিদায়ী পবিত্র ঈদুল ফিতরে স্বস্থিদায়ক ঈদযাত্রার পেছনে মূলত তিনটি কারণ ছিল, ১। ঈদের আগে ৪ দিনের লম্বা ছুটি, ২। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের প্রভাবশালী মাফিয়া নেতারা পালিয়ে যাওয়ায় সড়কে মাস্তানিতন্ত্রের অবসান হয়, যা মাঠ পর্যায়ে বড় বড় ব্রান্ডের গাড়িগুলোর কর্মকর্তা ও চালকদের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। ৩। আমাদের সেনাবাহিনী নিরলস মাঠে ছিল, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সক্রিয় ছিল, বিআরটিএ, ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে মানুষ ভোগান্তিমুক্ত যাতায়াত নিশ্চিত করা গেছে। সংগঠনটির সমীক্ষা বলছে, ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের তুলনায় ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনা ২১.০৫ শতাংশ, নিহত ২০.৮৮ শতাংশ, আহত ৪০.৯১ শতাংশ কমেছিল, যা অন্তর্বর্তী সরকারের বড় অর্জন হিসেবে নানা মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাই ঈদুল আজহার লম্বাছুটি বিন্যাস করে ঈদের আগে ৩ ও ৪ জুন ২ দিন ছুটি নিশ্চিত করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, যাতায়াতের ভোগান্তি কমানো সক্ষম হবে বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফোরামের সভায় ও গণমাধ্যমে নানাভাবে তুলে ধরা হয়। সর্বশেষ গত ২৭ মে পবিত্র ঈদুল ফিতরের ন্যায় ঈদুল আজহায় স্বস্থিদায়ক ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে ধাপে ধাপে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সুবিধার্থে ঈদের ছুটি ব্যবস্থাপনা ঠিক করে ঈদের আগে ২ দিনের বাড়ানোর দাবিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে না নিয়ে দেশের যাত্রীসাধারণকে এহেন দুর্ভোগে ঠেলে দিলেন।

লম্বাছুটির কারণে এবারের ঈদে বেশি মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় রাজনীতিবিদেরও মাঠে আনাগোনা বাড়বে। ফলে বেশি মানুষের যাতায়াত হবে এটাই ছিল নিশ্চিত। কেবল মুসলমানেরা নয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই ছুটিতে গ্রামে যান। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রতিবছর কী পরিমাণ মানুষের ঈদে যাতায়াত হয় তার একটি সম্ভাব্য সমীক্ষা রিপোর্ট গণমাধ্যমে দিয়ে থাকে। তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদুল আজহায় ঢাকা থেকে ১ কোটি ১০ লাখ ও ঢাকার আশেপাশে জেলা থেকে আরো ৩০ লাখসহ ১ কোটি ৪০ লাখ থেকে দেড়কোটি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আরো ৩ কোটি মানুষের যাতায়াত হতে পারে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ৭ জুন ২০২৫ ঈদুল আজহা উদযাপনের দিন নির্দিষ্ট ছিল। ঈদের আগে ৫ ও ৬ জুন মাত্র ২ দিনের সরকারি ছুটিতে একদিনে ৭৫ লাখ করে দুই দিনে দেড়কোটি মানুষ গ্রামে পাঠাতে ঈদযাত্রায় ভয়াবহ ভোগান্তি হবে। দুইদিনের দেড়কোটি মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে পাঠানোর মতো সড়ক, রেল, নৌ কোনো পথেই আমাদের যানবাহনের সক্ষমতা নেই বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি পক্ষ থেকে বার বার সরকারকে জানানো হয়। তাছাড়া ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের পার্থক্য আছে। ঈদুল আজহায় সড়কের পাশে পশুরহাট বসে, ঐ হাটকে কেন্দ্র করে মূল সড়কে ট্রাক থেকে পশু নামানো হয়। এতে যানজট-জনজট একাকার হয়ে যায়। যানবাহনের গতি কমে আসে। এছাড়াও পশুবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে বাসের গতি কমে আসে। বাজার সংলগ্ন এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। ফলে যানবাহনের গতিও কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে দেওয়া ১১ ও ১২ জুন ২ দিনের ছুটি বিন্যাস করে ঈদের আগে ৩ ও ৪ জুন এগিয়ে নিয়ে আসার দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি হয়নি।

আসলে একসাথে বেশি মানুষ রাস্তার নামলে কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই কাজে আসে না তা আবারো প্রমাণিত হলো। তাই আগামীতে দুর্ভোগ এড়াতে ঈদের ব্যবস্থাপনায় যানবাহনের সক্ষমতা ও যাত্রী পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গেলে যাত্রী দুর্ভোগ, ভাড়া নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।

লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews