তিনি পুরনো সমাজকে ভেঙে সেখানে নতুন একটি সমাজ গড়ার জন্য লিখছেন; তাঁর ফলে স্বভাবতই কায়েমি স্বার্থের যারা ধারক ও বাহক তারা ক্ষুব্ধ, বিচলিত, ক্রুদ্ধ ইত্যাদি হবেনই। এবং সেটা তারা হয়েছেনও।

হিন্দুসমাজ তাঁকে উপেক্ষা করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের ভেতরও বিদ্বেষ ছিল, বিশেষ করে এই কারণে যে, তিনি একজন ব্রাহ্ম মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং স্ত্রীর বিধবা মাতাই অনেককাল ধরে ছিলেন তাঁর সংসারের পরিচালক। রুচিবান হিন্দুরা তাঁর গান খুব পছন্দ করতেন, তাঁরা কখনো কখনো তাঁকে গৃহে এবং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় জেনে নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতেন। আর তিনি যে ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, ধর্মপ্রাণরা তাতে প্রীত হননি।

কিন্তু বড় রকমের আপত্তিটা এসেছিল মুসলমান সমাজের কাছ থেকেই। দুই কারণে। প্রথমত, তিনি ওই সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমান সমাজ ছিল অনেকটা পিছিয়ে। তৃতীয় একটা কারণও ছিল। সেটা হলো, নজরুলের প্রতিভা। নজরুল ‘মহররম’ , ‘ফাতেহা দোয়াজদাহাম’ , ‘ফাতেহা ইয়াজদাহাম’, ‘কোরবানী’ , ‘সাতিল আরব’ , ‘খেয়াপারের তরণী’ র মতো অসামান্য কবিতা লিখেছেন; ইসলামি গান লিখেছেন অসংখ্য; ফার্সি-আরবি শব্দকে বাংলা সাহিত্যে চালু করে দিয়েছেন, সেই কবিই কী না আবার এমনসব কবিতা লিখলেন যেগুলো পড়লে মনে হয়, তিনি ইসলামবিরোধী তো অবশ্যই, বোধকরি নাস্তিকও। লিখলেন হিন্দুয়ানি কবিতাও।

রক্ষণশীল অংশ তাঁকে যাচ্ছেতাই রকম গালাগাল করেছে। শয়তান, অনাচারী, নরাধম, ফেরাউন, নমরুদ, খোদাবিরোধী, ধর্মজ্ঞানশূন্য বুনো বর্বর, কুলাঙ্গার ইত্যাদি বলেছে। নজরুল নিজেই মন্তব্য করেছেন, ‘এই গালির গালিচাতে বোধ হয় আমি একালের সর্বশ্রেষ্ঠ শাহানশাহ।’কেউ কেউ তাঁকে বুঝতেই পারেনি, খেয়াল করেনি যে, নজরুল যা লিখেছেন তা সমাজের উপকারের জন্যেই। তাঁর লেখা গজল ও তথাকথিত ইসলামবিরোধী রচনার মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই, উদ্দেশ্য একই - সমাজকে আন্দোলিত করা এবং তাকে আনন্দলাভের পথে পরিচালিত করা। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও ভন্ডরা, সরল বিশ্বাসী মানুষেরা নন। এমন কী এস ওয়াজেদ আলীর মতো অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সাহিত্যিকও একসময়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, নজরুলের পক্ষে উচিত কাজ হতো মুসলিম সংস্কৃতির ভেতরে থেকেই সাহিত্যরচনা করা এবং তার বাইরে না যাওয়া।

কলকাতায় যখন নজরুলের নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় তখন নজরুলের বয়স মাত্র ৩০। এই সংবর্ধনার বিরুদ্ধে মুসলমান সাহিত্যসেবীদের একাংশ বেশ সক্রিয় ছিল। আয়োজকদের ভেতর প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। ঢাকা থেকে ‘বুদ্ধির মুক্তি’র আন্দোলনের সদস্যরা এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানান। এই প্রসঙ্গে আবুল হুসেনের একটি উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকার রায়সাহেবের বাজার থেকে তিনি লিখেছেন :

আপনারা যে আয়োজন করতে পেরেছেন এতেই আশ্চর্য হচ্ছি, কারণ বর্তমান বাংলার মুসলমান সমাজ প্রতিভার কদর করতে শেখেইনি, বরং প্রতিভাকে মেরে ফেলেই তারা ইসলাম ও তার প্রবর্তকের গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে চায়।

লেখক, প্রাবন্ধিক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন’ বই থেকে সংকলিত।

বাংলা ইনসাইডার/এমআরএইচ




Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews