জুলাই বিপ্লব। জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের নাম। আত্মপরিচয় ও আত্মগৌরবে অভিষিক্ত হওয়ার উজ্জ্বল অভিযাত্রা। স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অভিধায় পরিচিত ও স্বকীয় চেতনার আলোকে জাতীয় পতাকা সমুজ্জ্বল করার স্বপ্ন। স্বাধীনতার গৌরবদীপ্ত ঘোষণার আরেক নাম। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন আর শ্রেণিসুবিধার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধ্যায়। দীর্ঘ দিনের শোষণ-বঞ্চনা, অবিচার, ভোটহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনতার অধিকার আদায়ের দেদীপ্যমান ক্যানভাস জুলাই বিপ্লব। বিপ্লবের কুশীলবদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। এ বিপ্লবের মাধ্যমে জাতিকে নিজেকে নতুন করে চেনার লড়াইয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। সুস্থতা কামনা করছি যারা এখনো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সেসব আহত ও পঙ্গু বীরদের।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এরই বাস্তব প্রতিফলনের বিশাল জীবন্ত ক্যানভাস জুলাই বিপ্লব। জুলুম, অত্যাচার, পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর নির্মমতায় যখন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, প্রতিবাদী যোদ্ধারা প্রচণ্ডভাবে কোণঠাসা, তখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা রাজপথের দখল নিয়ে লাঠিচার্জ, গুলি, টিয়ার শেল, ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং আওয়ামী ভাড়াটে গুণ্ডাদের তাণ্ডবকে অসীম সাহসে পরাজিত করে বিজয়ের রঙিন সূর্য জাতির আকাশে হাজির করেছে। তাদের অসম সাহসিকতা, আত্মত্যাগ এবং অদম্য স্পৃহা জাতির বুকে আশা জাগিয়েছে। জাতিকে দেখিয়েছে নতুন পথ। কোটা পদ্ধতি নামক এক জগদ্দল পাথর সরানোর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ক্রমেই দানাবাঁধা ‘এক দফা এক দাবি, স্বৈরাচার কবে যাবি’ আন্দোলনে জাদুমন্ত্রের মতো সবার অজান্তেই এ দেশের গণমানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মুটে-মজুর, রিকশাওয়ালা, হকার একীভূত হয়ে বুলেটের রক্তপিপাসাকে পরাজিত করে নতুন যুগ ও নতুন ভোরের সূচনা করার উদাহরণ পৃথিবীতে খুবই কম। এ দেশের ছাত্র-জনতা নিজের অধিকার, স্বাধীনতার সম্যক ধারণা সম্পর্কে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে উচ্চকিত করে নতজানু শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর অভিযাত্রায় জাতিকে আবারো পথনির্দেশনা দিয়ে জানান দিলো- এ জাতি ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
অনেক আশার স্বপ্ন বুকে নিয়ে সে দিন ছাত্র-জনতা রাজপথে মোকাবেলা করেছিল এক দানবীয় শক্তির। তাদের বুকে ছিল সর্বস্তরে মেধার মূল্যায়নের স্বপ্ন। ছিল সুবিচারের প্রত্যাশা ও আর্থ-সামাজিক মুক্তির নেশা। ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বজ্রশপথ। যার প্রকাশ দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নেয়া থেকে। এই স্বপ্নই তাদের তাড়িত করেছিল ময়লা সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে নামতে, রাতভর নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিতে। তাদের স্বপ্নের আকাক্সক্ষাগুলো মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল সারা দেশের দেয়ালের গ্রাফিতিতে। গ্রাফিতিগুলো শুধু মনের আবেগ নয়, এটি ছিল বুকের ভেতর জমে থাকা আকাক্সক্ষার, জাতির ভবিষ্যৎ রূপরেখার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। গ্রাফিতিগুলো আজো মুছে যায়নি। একই সাথে মুছে যায়নি বুকের ভেতর রক্তঝরা স্বপ্নগুলো। কিন্তু কেন যেন এগুলো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, উপেক্ষিত হচ্ছে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।
রাষ্ট্র বদলানোর ৩৬ জুলাইয়ের স্বপ্নের দীপ্ত প্রেরণা, নতুন স্বাধীনতার চেতনায় সিক্ত ‘লাল জুলাই’ ছিনতাই হয়ে হারিয়ে গেল ৮ আগস্টে। দেশের আপামর মানুষের স্বপ্ন; নতুন নায়করা দেশটাকে বদলাবে, নতুন সমাজ গড়বে, সৃষ্টি হবে নতুন পরিবেশ, বইবে শান্তির সুবাতাস, সুবিচারের জন্য মানুষকে নিঃস্ব হতে হবে না। কিন্তু এর সবই সমাহিত হলো সচিবালয়, উত্তরপাড়া, মতিঝিল, শাহবাগ আর রমনার শ্যামলিমায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একক জাতিসত্তা গড়ার পরিবর্তে শুরু হলো আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড খোঁজা। বিভিন্ন মিডিয়াকে নিয়োজিত করা হলো অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ৩৬ জুলাইকে বিভাজিত করতে। নায়ক এবং মহানায়ক তৈরির এ চেষ্টা ৮ আগস্ট থেকেই শুরু হলো। অত্যন্ত সফলভাবে আন্দোলনের নায়কদের বিভাজিত করা হলো। ফলে আজ ৩৬৫ দিন পর দেখা যাচ্ছে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কেউই চিন্তিত নয়। দেশের সর্বনাশা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা নেই কারো মুখে। কৃষকের ব্যাপারে সবাই নিশ্চুপ। দারিদ্র্য কমানোর কথা শোনা যায় না কোনো বোদ্ধার মুখে। সাধারণ কর্মজীবী অর্থনীতির বাস্তবতায় অবিরাম ধুঁকছে। কারো সময় নেই এ দিকে তাকানোর, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ব্যাপারে কমবেশি সবাই চুপ। আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে কারুরই যেন কোনো দায়ভার নেই। ক্ষমতা নামক হালুয়ার কতটুকু কিভাবে ভাগে পাওয়া যাবে তা নিয়েই সবাই ব্যস্ত। নিহতদের ক্ষতিপূরণ, তাদের পরিবারের পুনর্বাসন, আহতদের চিকিৎসা, শিক্ষার কথা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আত্মত্যাগ, মাদরাসাছাত্রদের কথা কারো মুখে উচ্চারিত হচ্ছে না। প্রকারান্তরে তারা যেন ক্রমেই উপেক্ষিত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবের অধ্যায় থেকে। ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে কোনো কিছুই ঘটেনি- এ বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। মোটকথা বিপ্লব, বিপ্লবের সৈনিক, বিপ্লবের চেতনাকে সুকৌশলে মুছে ফেলার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে।
নির্বাচন, নির্বাচন পদ্ধতি, ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করেন না; কিন্ত রাজনীতি মানে তো শুধু ক্ষমতার রদবদল নয়। সুশাসন, সুবিচার, সুশিক্ষা, সুচিকিৎসা, মেধাভিত্তিক নিয়োগ, বেকার সমস্যার সমাধান, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ সবই বোঝায়। জনকল্যাণের নামে করা ৩৯ দিন সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের সেবাবঞ্চিত করে রাখার ঘটনাও দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। এই এক বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন রয়ে গেছে আগের মতোই। স্বাধীন জাতিসত্তার কোনো চিত্র চিত্রায়িত হয়নি। এর জন্য কাউকে সরব হতে দেখা যায়নি। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের সুফল, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী ঐতিহাসিক ঘটনার মতো ৩৬ জুলাইও আজ ছিনতাই হয়ে গেছে। নির্যাতিত, নিপীড়িত সাধারণ জনগণের স্বপ্ন, আশা, বেদনা বুকের মধ্যেই লজ্জায় অপমানে মুখ লুকাল আরো একবার।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]