খাইয়া-পরিয়া বাঁচিয়া থাকিবার বাহিরে জগতে কোনো কিছুই অপরিহার্য নহে—এমনটিই বলিয়া থাকেন মনোবিজ্ঞানীরা। কিন্তু যখন কোনো কিছু অপরিহার্য বলিয়া মনে করা হয় এবং সেই বস্তু যদি কাহারো নিকট হইতে সরাইয়া দেওয়া হয় এবং তখন যদি সেই ব্যক্তি আতঙ্কিত বোধ করিয়া থাকেন, আপসেট হইয়া পড়েন, তবে বুঝিতে হইবে তিনি ঐ বস্তু দ্বারা আসক্ত হইয়া পড়িয়াছেন তীব্রভাবে। মাদকের বিষয়টি সেইভাবেই দেখা হয়। এই মাদকের মতোই যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করিয়া ভয়ংকর আসক্তি সৃষ্টি করিতেছে স্মার্টফোন। বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের নিকট অশনিসংকেতের মতো। সমীক্ষা বলিতেছে, অধিকাংশ মানুষ কেবল স্মার্টফোন ঘাঁটিয়াই বত্সরের মোট ৮ হাজার ৭৬০ ঘণ্টার মধ্যে ১ হাজার ৮০০ ঘণ্টা নষ্ট করিতেছেন। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, ইহার প্রভাব পড়িতেছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর। পাশাপাশি দুই জন মানুষ বসিয়া আছেন, কিন্তু স্মার্টফোনের মাধ্যমে বুঁদ হইয়া আছেন ভার্চুয়াল জগতে। পাশাপাশি থাকিয়াও যেন তাহারা যোজন দূরত্বে বসবাস করিতেছেন! সমীক্ষা স্পষ্টতই জানাইতেছে যে, ৪৭ শতাংশ মানুষ দিনে তিন-চার ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ মানুষ ফোনের চার্জ না থাকিলে আতঙ্কিত বোধ করেন। ইহার মধ্যে ৩৭ শতাংশ মানুষ ঘন ঘন স্মার্টফোন ঘাঁটেন আর ৩৪ শতাংশ মানুষের মেজাজ খারাপ হয় ফোন ব্যবহার করিতে না পারিলে।
বাস্তবিক অর্থে স্মার্টফোন এমন হইয়া গিয়াছে যে দুই মিনিটও হাতে না থাকিলে মনে হয় কী যেন নাই, কী একটা যেন সমস্যা হইতেছে, কোথায় যেন ছন্দপতন হইয়াছে। ব্রিটেনের কিংস কলেজ লন্ডনের একটি গবেষণায় বলা হইতেছে, তরুণেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন না স্মার্টফোন কম কম দেখিতে। অন্য একটি সমীক্ষা বলিতেছে, প্রতি তিন জনে এক জন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জানাইয়াছেন, তাহারা বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটাইবার সময়ও প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার ফোন না ঘাঁটিয়া থাকিতে পারেন না। আশঙ্কার কথা হইল, ৭৩ শতাংশ মানুষই তাহাদের কৈশোরে স্মার্টফোন হাতে পাইয়া যাইতেছেন। ইহা দূরের নহে, এই উপমহাদেশের চিত্র। অধিকাংশ মানুষই তাহার বন্ধু বা আত্মীয়দের সহিত মুখোমুখি গল্প করিবার চাইতে স্মার্টফোনে চ্যাট করিতেই বেশি পছন্দ করেন। মজার ব্যাপার হইল, তিন-চতুর্থাংশ মানুষই বুঝিতে পারিতেছেন, স্মার্টফোনে এই আসক্তি ভালো নহে। ইহার ফলে একসময়ে তাহাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলিবে। কিন্তু স্মার্টফোনের নেশা যেন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে!
এই স্মার্টফোনের যুগে জীবনানন্দ দাশ কি বনলতা সেন কবিতা লিখিবার সময় তাহার মুখোমুখি বসিবার আকুতি প্রকাশ করিতেন? নাকি স্মার্টফোনে চ্যাটে জুড়িয়া দিতেন গল্প? সেই ক্ষেত্রে ‘পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ কি ফুটিয়া উঠিত আমাদের কল্পমানসে? স্মার্টফোন আমাদের যেন তাহার দাস বানাইয়া দিতেছে। নষ্ট করিতেছে অমূল্য সময়। সময় ফুরাইলে সাধন হইবে কী করিয়া? সুতরাং সময় থাকিতে সাবধান হওয়া জরুরি।