সংসদীয় গণতন্ত্রে বাজেট প্রণয়ন, পর্যালোচনা ও পাসের এখতিয়ার সংসদের। মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে বাজেট-প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপিত হয় এবং সংসদে পরীক্ষা-পর্যালোচনার পর সংসদের বাজেট পাস প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির সম্মতি (ধংংবহঃ) গ্রহণের বিধান আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সুতরাং সংসদের পূর্ণ দায়িত্ব কর আরোপের এবং পাবলিক মানি বরাদ্দ ও ব্যয়ের অনুমোদন তত্তাবধানের। অর্থবিলে যে পরিমাণ অর্থ অনুমোদিত থাকবে তার মধ্য থেকে আয়-ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্বাহী বিভাগ ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এর বাইরে যেকোনো প্রকার আয়-ব্যয় ও নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আলাদাভাবে সংসদের সম্মতি ও অনুমোদনে হতে হবে। বাজেট যেহেতু নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার পথনকশা এবং জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতার দলিল, সেহেতু সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাব চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অনুমোদন সুপারিশে সংসদে বাজেট বিতর্কের তাৎপর্য ও ভূমিকা অপরিসীম। ঠিক তাত্ত্বিক এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫-এর সম্পূরক এবং ২০২৫-২৬-এর নতুন বাজেটটি এই মুহূর্তে বিচার-বিশ্লেষণের কাঠগড়ায়। হাতে সময় মাত্র ১৩-১৪ দিন।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদে (শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের বাজেট বিতর্ক) এবং এমনকি তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হতো তা পাঠ-পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোতেও আইন পরিষদে বাজেটে অর্থনীতির নীতি-কৌশল নিয়ে প্রাণবন্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো। তাতে তথ্য-উপাত্তের সাথে যুক্তিতর্কের সুমহান এমন সম্মিলন ঘটত। পাকিস্তান শাসন আমলে, বিশেষ করে ছয় দফা আন্দোলন চলাকালীন সময়েও বাজেটে দেশের উভয় অংশের উন্নয়ন কৌশলে বৈষম্য ও বঞ্চনার পেক্ষাপটে যা উত্থাপিত হতো সেগুলো সংসদের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিভাগের প্রাজ্ঞ পণ্ডিতদের বাজেট বিশ্লেষণ স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতারা এবং আইন পরিষদ তথা ও দায়িত্বশীলদের দৃষ্টিসীমায় পৌঁছাত। সে সময়কার বাজেট বিতর্ক বিনির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রাজ্ঞ আলোচনার সুযোগের সদ্ব্যবহার চলত।
স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই প্রথম থেকে বাজেট প্রণয়ন ও নীতি বিশ্লেষণের ধারায় অনেক নতুন প্রবণতা, প্রাকরণিক প্রৎকর্ষতা বিশেষ করে বাজেটের প্রতি গণ-আগ্রহ ও অবহিতির ব্যবস্থা ছিল। এটিও ঠিক যে, মিডিয়ার ভূমিকায় বাজেট প্রণয়ন ও বিশ্লেষণে অনেক সংস্কার সাধিত হয়েছে। চিন্তা চৌবাচ্চা সিপিডিসহ সুশীলসমাজ বাজেট বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬-এর জাতীয় বাজেটের ওপর এবারের তর্ক-বিতর্কের হাল-হকিকত অনুধ্যান অধ্যয়নে গেলে দেখা যায়, বাজেটের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ উন্নয়ন দর্শন ও নীতিকৌশল নিয়ে বিতর্কের (যা উদীয়মান অর্থনীতির জন্য, ভবিষ্যৎ পথনকশা নির্ণয়-নির্ধারণের জন্য জরুরি) চেয়ে অতি তাৎক্ষণিক বিষয় (দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট ও করারোপ) ও তাদের সাময়িক প্রভাব নিয়ে দায়সারা গোছের আলোচনা সমালোচনা চলছে। এই আলোচনার ভিড়ে বাজেটে প্রক্ষেপিত অর্থনীতিতে অর্জিত সম্পদ ব্যবস্থাপনার নীতিকৌশল, উন্নয়ন অভীপ্সার অভিসার, দেশকে স্বয়ম্ভরতার পথে নিয়ে যাওয়ার পথনকশায় গতি প্রকৃতি শনাক্তকরণ ও সমালোচনার সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫-২৬-এর বাজেট বিতর্কে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আসতে পারত-
জাতীয় বাজেটের জাতীয়তা বা গণতান্ত্রিক চরিত্র : আমজনতার বাজেট বস্তুত জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। যাদের বাজেট তাদের মতামত সেখানে প্রতিফলিত হওয়া বাঞ্ছনীয় এ জন্য যে, তাহলে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সম্পদের সুষম বণ্টন সম্ভব হয়। বাজেট বাস্তবায়নের দ্বারা সুফলপ্রাপ্তিতে পক্ষপাতিত্ব, একদেশদর্শিতা, বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধি কিংবা কর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিপক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি সমন্বিত উন্নয়ন সাধন ধারণার পরিপন্থী। বরাবরের মতো নির্বাহী বিভাগ (অর্থ মন্ত্রণালয়) তাদের সহজাত অভ্যাসবশত, সবার সাথে আলোচনা থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে যে নীতি-দৃষ্টিকোণ, অবস্থা-ব্যবস্থা বাজেটে প্রস্তাব করেছে, সেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর যদি তেমন কিছু বলার বা করার না থাকে তাহলে তো বাজেটের জাতীয় চরিত্র মেলে না। এটি নিছক নির্বাহী বিভাগের বাজেট হয়ে যাচ্ছে এবং দেখা যায় নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন একই হাতে থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যা হলো- বাস্তবায়নকারী (নির্বাহী বিভাগ) তার নিজের স্বার্থ ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়েই যে নীতি প্রেসক্রাইব করে সবার সেটি অনুসরণ করা ছাড়া যেন গত্যন্তর থাকবে না। বাজেটকে জনগণের জন্য করার লক্ষ্যে যথা ব্যবচ্ছেদে না গেলে বাজেট জনগণের বা অর্থনীতির জন্য পুষ্টিকর বা উপাদেয় হয় না। জবাবদিহিমূলক পন্থায় না গেলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের বাজেট অসময়ের মতো তার স্বৈরাচারী বলয় থেকে বের হতে পারছে না বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
প্রত্যক্ষ কর বনাম পরোক্ষ কর : ২০২৫-২৬ বছরের বাজেট প্রস্তাবেও পরোক্ষ কর মূল্য সংযোজন কর ওরফে ভ্যাটকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হয়েছে। নতুন বাজেটেও (শূন্য তালিকা ব্যতীত) সব পণ্য ও সেবার ওপর একক ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ এবং ‘ক্ষেত্র বিস্তৃতকরণ ব্যতিরেকে এবং কর আদায় প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য ভ্যাট হিসাবায়নের ‘নতুন পদ্ধতি’ প্রেসক্রাইব না করে অনলাইন পদ্ধতিতে সহজসাধ্য ও নিয়মনিষ্ঠ করার পথে হাঁটা এখনো শুরু করা যায়নি। ধরেই নেয়া হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনলাইনে অভ্যস্ত হয়েছে বা হবে। মোদ্দা কথা, রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ উপায়ে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এটি এত সহজে কি বাস্তবায়ন করা যাবে? বাজেটে আগের ভ্যাট আইন ও নতুন আইনের মিশ্রণ ঘোষণা করা হয়েছে। আগের আইনে যা কিছু ছিল, সেখান থেকে কোনটি কেন রাখা হলো তা পরিষ্কার করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে করের আপাতন কোথায় বাড়ল কিংবা কোথায় কমলো, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সংস্কার না করে বাড়তি ভ্যাট আরোপ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সব বোঝা চাপিয়ে দেবে ভোক্তার ওপর। ভ্যাট আহরণে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে বা হবে। অপপ্রয়োগের ফলে সুন্দর আইনও অসুন্দর না হয়ে যায়। ভ্যাটের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) প্রতি মনোযোগ হ্রাস পেয়েছে। অথচ প্রত্যক্ষ করই কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। বিগত কয়েক বছরে আয়কর ক্রমেই অন্যতম উৎস হিসেবে উঠে আসতে থাকলেও ২০২৫-২৬ আয় সংস্কার ও আহরণে কার্যকর জোর পদক্ষেপে গ্রহণে গুরুত্ব আরোপের দৃষ্টিভঙ্গি নড়বড়ে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং সম্পদের বণ্টনবৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব লঘু করে পরোক্ষ কর ভ্যাটের ওপর ভরসা করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পদক্ষেপ প্রস্তাব করা হয়েছে। সব করদাতাকে করের আওতায় এনে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পারায় পরোক্ষ করের ওপর চাপ বাড়ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-উত্তর পরিবেশে অসময়ের এই বাজেটেও এটি যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ নয়।
পাবলিক সেক্টরের অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায়ভার বেসরকারি সেক্টরের ওপর চাপানো : রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৪৮টি সংস্থার মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি লোকসানে রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। সর্বাধিক ভর্তুকি নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো। জনপ্রশাসনের বাজেটের পাল্লা এখনো ভারী। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার বড় অংশই যাবে বেতনভাতা ও ভবন নির্মাণে। সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যের কারণে কেউ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে যাবে, আবার অসুখ হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবেন- এটি দুঃখজনক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মানোন্নয়নের জন্য বাজেট বা তাগিদ নেই। রি-ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের অনিয়ম অদক্ষতার এবং লুট হয়ে যাওয়া বেসরকারি ব্যাংকের ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম উৎসাহিত হচ্ছে কি না প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নন এনবিআর এবং নন-ট্যাক্স রেভিনিউ খাতে (যা সরকারি সংস্থা প্রদেয়) অর্জন লক্ষ্যমাত্রা ক্রমেই কমানো হচ্ছে আর এ কারণে হারাহারি মতে এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।
অন্তর্ভুক্তি বনাম বিচ্যুতি : নানান বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হচ্ছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছিল। বিনিয়োগ, বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য ও দক্ষ কোনো নীতি-কৌশলের অবর্তমানে সর্বভুক একধরনের বিশেষ চক্র তৈরি হয়েই চলছিল, বড় বাজেট, বড় প্রকল্পমুখী হচ্ছিল দেশ ও অর্থনীতি, যে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছিল। অর্থনীতির আন্তঃসহায়ক শক্তিকে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিচ্যুতির পরিবেশ তৈরি হয়েই চলছিল। সন্তুষ্টি ও স্বস্তির বিষয় যে, ২০২৫-২৬ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আগের দুরবস্থার অবসানকল্পে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গৃহীত নীতি-পরিকল্পনায় অর্জিত সাফল্যকে টেকসই করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণের পথে কোনো বিচ্যুতি বা ছাড় দেয়া সমীচীন হবে না।
উন্নয়ন ব্যয়ের যৌক্তিকতা : মেগা প্রকল্পের নামে মেগা খরচের পথে হাঁটছিল বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতি। প্রকল্প খরচ অযৌক্তিকভাবে বাড়ায় এসবের ব্যয় সাশ্রয়ে যথানজরদারির পরিবর্তে অবকাঠামো নিয়ে প্রচারমুখী প্রবণতা বাড়ছিল। অথচ অবকাঠামোর সুফল নিশ্চিত করতে যে ধরনের সুশাসন দরকার তা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। অন্যান্য প্রকল্পের টাকা কেটে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হলেও স্বচ্ছতার সাথে তা খরচ করা হতো না।
বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা : ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর কঠোর পদক্ষেপে হাঁটতেই হচ্ছে বা হবে। এবার যেহেতু বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে, তাই বিদেশী উৎসের ওপর আগের চেয়ে জোর কম দেয়া হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার জন্য শর্ত অনুযায়ী অর্থ খরচ করা যাচ্ছিল না। স্বনির্ভর হওয়ার মনোবল বৃদ্ধির পরিবর্তে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকৃতির ঋণভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছিল অর্থনীতি। একসময় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভকে ‘গৌরব’ মনে করে ফরেন লায়াবিলিটিস এমনভাবে বাড়ানো হতো যাতে একসময় অর্থনীতি ডেট ও কারেন্সি ক্রাইসিসে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছিল। সেটি সুসংহত করার ওপর দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে বা হবে।
বিনিয়োগ স্থবিরতা : বিনিয়োগ স্থবিরতা, বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের খরা; দুর্নীতি ও ব্যবসার বৈরী পরিবেশের কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি থেকে বাস্তবায়নের অদক্ষতার চিত্র পাওয়া যায়। সবশেষে সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থানের হার কমছে। ২০১০-১৩ সময়কালের কর্মসংস্থানের সাথে বর্তমানের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কর্মসংস্থানের হার আগের চেয়ে কমেছে। কর্মসংস্থান না হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে।
ব্যাংকিং, রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় : বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে কর্কট রোগের মতো ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতার কথা বলছেন সবাই। খেলাপি ঋণ, সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি, মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার কারণে ঋণ ব্যবস্থাপনায় আপস এবং সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন অন্তরায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই খাতটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর তুলে আনতে না পারলে দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক অর্জন হুমকির মুখে পড়বে, এটি বিবেচনায় রেখেই সব পক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে যে, একটি দুর্বল ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংক থেকেই পুকুর নয়, সাগরচুরির ঘটনা ঘটছে। এ চুরির ক্ষেত্রে একধরনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতেই যেন আইন সংশোধন করে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্র নিশ্চিত করা হয়ছিল এবং সরকারি ব্যাংকের লুটেরাদের আইনের আওতায় না এনে আবারো করের টাকায় মূলধন জোগানের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছিল। এটি করদাতা ও আমানতকারীদের মধ্যে দারুণ অনাস্থা ও নিরুৎসাহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রেমিট্যান্স বাড়ছে। মালয়েশিয়া ও কাতার ইস্যু প্রবাসী আয়ের জন্য একটা ঝুঁকি হিসেবে দেখা যাচ্ছিল। রফতানি আয় পরিস্থিতিও অনেকগুলো বীবমবহবড়ঁং ভধপঃড়ৎ-এর দ্বারা প্রভাবিত। ক্রমেই রফতানি আয় কমছে। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী পণ্যের (বিশেষ করে গার্মেন্ট) বহির্বাজারকরণের ওপর নানান বাধা আসছে। বিষয়গুলো যথা বিবেচনায় নিয়ে রফতানিপণ্য বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে, নতুন বাজার খুঁজতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রফতানি খাতকে কার্যকর পরিপোষণ এবং শুল্ক কর প্রণোদনা সমন্বয়ের বিকল্প নেই।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান