বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেন পাড়ার এই পরিবারটি কয়েকদিন আগেই ফিরে এসেছে। এ পাড়ায় রয়েছে ‘বম পার্টি’র প্রধান নাথান বমের বাড়ি। ছবিটি ২০২৪ সালে তোলা। ছবি: উসিথোয়াই মারমা
বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেন পাড়ার এই পরিবারটি কয়েকদিন আগেই ফিরে এসেছে। এ পাড়ায় রয়েছে ‘বম পার্টি’র প্রধান নাথান বমের বাড়ি। ছবিটি ২০২৪ সালে তোলা। ছবি: উসিথোয়াই মারমা
পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাত-মৃত্যুর মধ্যে গত বছরের ২৩ মে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ৭০ বছর বয়সী দমুন বম। ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির’ মধ্যে কোথায় যাবেন জানতেন না তিনি। তবে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনছিলেন, সম্প্রদায়ের মানুষ পাড়া ছেড়ে ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, জীবন বাঁচাচ্ছে।
ওই অবস্থার মধ্যে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ দমুন বম স্ত্রী আর একমাত্র ছেলের হাত ধরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হন। পাহাড়-জঙ্গল-ক্ষুধা-অনিন্দ্রার এক বিপদসংকুল কঠিন যাত্রার মধ্য পৌঁছান মিজোরামে।
এক বছরের ‘শরণার্থী জীবন’ শেষে দমুন বম ও তার পরিবার মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছেন। তবে এসে তিনি আর নিজের পরিত্যক্ষ ভিটেয় উঠতে পারেননি। তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে।
সেই সঙ্গে রয়েছে খাবারের সংকট। সবকিছু ঠিকঠাক করে কবে নিজের ভিটা আর জুমঘরে পা রাখতে পারবেন–জানেন না সদর ইউনিয়নের পাইক্ষ্যং পাড়ার বাসিন্দা দমুন বম।
শুধু দমুন বমের পরিবার নয়; এমন আরও প্রায় ৩০০ পরিবার ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছে সামাজিক সংগঠন বম সোশাল কাউন্সিল। তবে তাদের মধ্যে শুধু ২০২৪ সাল বা সংশ্লিষ্ট সময়ে যাওয়া বমরা নন; তারও আগে ২০২২ সালের শেষে কিংবা ২০২৩ সালের শুরুতে যারা মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাও অনেকে ফিরছেন বলে কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বমের ভাষ্য।
তিনি বলেন, “দেশের মধ্যে জঙ্গলে পালিয়ে থাকা এবং মিজোরামে আশ্রয় নেওয়া পরিবার মিলে মোট ৩০০ কাছাকাছি পরিবার সম্প্রতি ফিরে আসছে। তবে কোন পাড়ায় কত পরিবার ফিরেছে এখনও সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। কারণ অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। খবর পেতে একটু সমস্যা।”
বম সোশাল কাউন্সিল বাস্তুচ্যুত এসব পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল এবং তাদের ফিরে আসার ব্যাপারে সেনাবাহিনী সরাসরি তত্ত্বাবধান এবং সহযোগিতা করেছে।
বান্দরবান সেনা রিজিয়ন এক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। ২৭ জুন বান্দরবান সেনা রিজিয়নের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “রুমা উপজেলার বাস্তচ্যুত বম জনগোষ্ঠীর পরিবার নিজ গ্রামে নিরাপদে ফিরেছেন। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা এবং সহিসংতায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু পরিবার পার্শ্ববর্তী দেশে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।”
রুমা উপজেলায় সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধান এবং সহযোগিতায় ১২২টি বম পরিবার নিজ নিজ পাড়ায় নিরাপদে ফিরে এসেছেন বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, “এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নয়, বরং পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘ মেয়াদী শান্তি ও সহাবস্থানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।”
বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী কত
কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের কারণে ভয় ও আতঙ্কে বম জনগোষ্ঠীর লোকজন এলাকা ছাড়তে শুরু করে ২০২২ সালে শেষ দিকে। সে সময় ৫০০ জনের মত বম সদস্য প্রতিবেশী ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নেয় বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়। পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন।
এরপর ২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে রুমা ও থানচিতে ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রুমার সোনালি ব্যাংকে ডাকাতি হয় ২ এপ্রিল রাতে। পরদিন ভর দুপুরে থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতরা হানা দেয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এ দুটি ঘটনায় জড়িত পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা, যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত।
ওই ঘটনার পর বান্দরবানের দুই উপজেলার চিরচেনা দৃশ্যপট হঠাৎ বদলে যায়। দুই উপজেলায় তিন ব্যাংক শাখায় ডাকাতির ঘটনার পর যৌথ বাহিনীর কেএনএফ-বিরোধী অভিযানে ‘গণহারে গ্রেপ্তারের’ মধ্যে চলাফেরা, খাদ্য সংগ্রহের মত কাজেও নানা বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হওয়ার কথা সে সময় বমরা বলেছিলেন। তখনও বমদের পাড়া ছাড়ার ঘটনা ঘটছিল।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বান্দরবান শহরে প্রেস ক্লাবের সামনে জেলা পরিষদের আয়োজনে করা ‘সম্প্রীতির মিছিল’ শেষে এক সমাবেশে বম সম্প্রদায়ের সদস্য ও খ্রিষ্ট্র ধর্মীয় যাজক রেভারেন্ড পাকসিম বম দাবি করেন, বসতবাড়ি ছেড়ে তিন হাজার বম ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এ কারণে নয়টি বমপাড়া এখন জনশূন্য।
‘জনশূন্য’ বান্দরবানের আটটি এবং রাঙামাটির একটি পাড়ার নাম জানিয়ে সেদিন পাকসিম বম বলেছিলেন, ভারতে পালাতে গিয়ে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির হাতেও বন্দি হয়েছেন অনেকে।
বম সোশাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম জানান, যারা ফিরেছেন তারা মূলত বান্দরবান সদর উপজেলার গেৎশিমানি পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের পাইক্ষ্যং পাড়া, রুমা উপজেলার জুরভারাং পাড়া, ইডেন পাড়া, ব্যাথেল পাড়া, হ্যাপি হিল পাড়া, দার্জিলিং পাড়া, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ফাক্ষ্যং পাড়া ও সুসং পাড়া, থানচি উপজেলার সিংত্লাংপি এবং প্রাতা পাড়ার বাসিন্দা। এর বাইরে আরও কিছু পাড়া থাকতে পারে।
রোয়াংছড়ি থেকে মিজোরাম: ৬ দিনের পথ
দমুন বম পাইক্ষ্যং পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে জুমচাষ এবং বাগান করে খেতেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ১৮ বছরের ছেলে সঙ্গেই থাকেন।
গত বছর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় মিজোরামে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে দমুন বম বলছিলেন, “মে মাসের ১৩ তারিখ আমাদের পাড়ার চার পরিবার এবং অন্য পাড়ার কয়েকটি পরিবার মিলে মোট ১৪-১৫টি পরিবার মিজোরামের উদ্দেশে রওনা দিই। ছয় দিন পর সেখানে পৌঁছেছি।
“পালিয়ে যাওয়ার সময় কখনও জঙ্গল, কখনও ঝিরি-ঝরনা পাড়ি দিতে হয়েছে। একবার উঁচু-নিচু পাহাড়, আরেকবার চরম খাড়া পাহাড় পার করে যেতে হয়েছে। যাওয়ার সময় সবাই যে যার মত করে পথে রান্না করে খাওয়ার জন্য হাঁড়ি-পাতিল এবং চাল নিয়ে গেছে।
“যেখানেই রাত হয়েছে সেখানেই রান্না খেতে হয়েছে। জঙ্গলে বিভিন্ন ফলমূল সংগ্রহ করে তরকারি হিসেবে খেয়েছি। এভাবে ছয় দিন পর মিজোরামের একটা জায়গায় পৌঁছেছি। সেখানে এক বছর ছিলাম।”
দমুন বম বলছিলেন, “দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে বম সোশাল কাউন্সিল এবং সেনা রিজিয়নের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের আশ্বাসে আমরা দুই পরিবার চলে আসি।
“আসার সময় রাঙামাটি হয়ে আসছি। তিন দিন সময় লেগেছে। জুনের ২১ তারিখ বান্দরবানে পৌঁছেছি। বাকিরা এখনও সেখানে রয়ে গেছে। পাড়ায় এসে দেখি ঘরও ভাঙা। কোনো কিছু ঠিক নাই। থাকার জায়গা পর্যন্ত নাই। আপাতত রোয়াংছড়ির অন্য একটি পাড়ায় আমার মেয়ের ঘরে উঠছি। আগে ঘর মেরামত করতে হবে এবং খাবার জোগাড় করতে হবে তারপর নিজের ঘরে উঠতে পারব।”
এসব সমস্যার ব্যাপারে বম সোশাল কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা পরিষদ এবং বান্দরবান সেনা রিজিয়নকে অবহিত করার কথা জানান দমুন বম।
অভাব: ধর্মগুরু থেকে দিনমজুর
সংঘাতের জেরে গত বছর জুলাইতে নিরাপদ আশ্রয়ে মিজোরামে পাড়ি জমিয়েছিলেন রুমা উপজেলার হ্যাপি হিল পাড়ার পাস্তর (ধর্মযাজক) লালমুনলিয়ান বম এর পরিবার। খ্রিষ্টান ধর্মযাজক তিনি। এ বছর মার্চে চার পরিবারের সঙ্গে ফিরে এসেছেন তারা।
এক বছর পর নিজের ভিটায় ফেরার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লালমুনলিয়ান বম বলেন, “এখন পাস্তর থেকে দিনমজুর হয়ে গেছি। ঘরে খাবার নাই। টাকাও নাই। বেঁচে থাকতে এখন দিনমজুরি করে চলতে হচ্ছে। আগে তো আম ও কলা বাগান ছিল। যত্নের অভাবে এগুলো আগাছা ও জঙ্গলে ভরে গেছে। পরিষ্কার করতেও অনেক দিন লাগবে। এখন কোনো ছেলেমেয়েও নাই। সবার বিয়ে হয়ে গেছে।”
তিনি বলছিলেন, “সেই সময় তো ভয়ে যে যার মত করে পাড়া ছেড়ে চলে যায়। কত পরিবার চলে গেছে ঠিক মনেও নেই। রুমা থেকে মিজোরামে পৌঁছতে ছয়-সাত দিন লেগে যায়। যাওয়ার সময় একদম বর্ষাকাল ছিল। বিশেষ করে তখন জোঁকের ভোগান্তি বেশি ছিল।
“হ্যাপি হিল পাড়ায় আগে মোট ২৭ পরিবার ছিল। এখন ১৭ পরিবার রয়েছে। বাকি পরিবার এখনও মিজোরামে রয়েছে। তারা আবার ফিরে আসবে কি-না আমার জানা নাই।”
খাদ্য সংকটে সরকারই ভরসা
যারা ফিরে আসছেন তাদের অধিকাংশই খাদ্য সংকটে পড়ার কথা বলছেন। এর প্রধান কারণ কৃষি জমি ও পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।
বম সোশাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম বলেন, “ফিরে আসা এসব পরিবারের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট রয়েছে। ঝামেলার সময় থেকে তারা ঠিকমত জুমচাষ করতে পারেনি। বাগান-বাগিচা ঠিকমত যত্ন নিতে পারেনি। যেগুলো হয়েছে সেগুলো আবার বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করতে পারেনি।
এখন যে খাদ্য সংকটই প্রধান সমস্যা, সে কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টি কম হয়েছে। যারা ফিরেছে, আপাতত এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করতে পারছে। খাবার খুঁজে নিয়ে আসতে পারছে। একটানা বৃষ্টি হলে খাল-জঙ্গলে পানির জন্য চলাফেরা করতে সমস্যা হত। তখন এই বমদের অনেকের না খেয়ে মরতে হত।”
প্রায় একই কথা বলছিলেন বম সোশাল কাউন্সিলের সাবেক এক শীর্ষ নেতা। তিনি বলছিলেন, “মনে হচ্ছে, সরকারি সহায়তা ছাড়া এই দুর্যোগ কাটানোর কোনো পথ নেই। এনজিওরা কাজ করতে চাইলে সরকারি বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা শর্ত দেওয়া হয়। ফলে তারা আগ্রহ দেখায় না।
“এখন পর্বত্য মন্ত্রণালয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, সেটা যত তাড়াতাড়ি আসে তত ভালো। শুনতে পারছি, এখানে থেকে যাওয়া কিছু পাড়া-প্রতিবেশী ফেরত আসা লোকদের সাহায্য করছে। কিন্তু তাদের সামর্থ্যও তো সীমিত।”
রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিরা বম বলেন, “কিছু পরিবার ফিরে এসেছে, তবে অধিকাংশই ফেরেনি। আশা করছি, তারা ফিরবেন।
“যারা ফিরেছেন তারা খাবারের সংকটের মধ্যে আছেন। তবে এখন বাজারে বমরা কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বা কিনতে পারছেন। যদিও তারা দোকান নিয়ে বসতে পারছেন না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে অনেকেই খাচ্ছেন।”
খাদ্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সহযোগিতা চেয়ে ২৬ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান বম সোশাল কাউন্সিলের সভাপতি।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই বলেন, “বমদের খাদ্য সংকটের ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য এরইমধ্যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগুলো শিগগির বাস্তবায়ন করা হবে। আর্থিক সহযোগিতা এবং খাদ্যশস্য বরাদ্দ এখনও আসেনি। বরাদ্দ এলে এগুলো বম সোশাল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।”
কাটছে না ভয়-আতঙ্ক
বন-জঙ্গলে পালিয়ে থাকা এবং আত্মীয়-স্বজনের ঘরে আশ্রয় নেওয়া অনেক বম পরিবার এখনও ফিরতে ভয় পাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বম সোশাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম।
তিনি বলেন, “এখনও কিছু পরিবার গভীর বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে। ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছে। হয়ত এখনও তাদের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিকভাবে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক শিশু পরিবারের সঙ্গে মিজোরামে চলে গেছে। কোনো কোনো শিশু এখনও পরিবার ছাড়া। হঠাৎ করে হয়ত মা-বাবারা চলে গেছে। ছেলেমেয়ে রয়ে গেছে হোস্টেল কিংবা কারও বাসাবাড়িতে।”
পাড়ার পরিস্থিতি জানতে চাইলে রোয়াংছড়ি উপজেলার ৩৪১ নম্বর পাইক্ষ্যং মৌজা হেডম্যান বৈথাং বম মোবাইল ফোনে বলেন, “কিছু দিন আগে দুই পরিবারের মত পাড়ায় ফিরেছে। বেশিরভাগ পরিবার এখনও ফেরেনি। আগে পাড়ায় মোট ৯৭ পরিবার ছিল। সে সময় ‘পরিস্থিতির কারণে’ ৬৭ পরিবারে পালিয়ে গেছে। তার মধ্যে মাত্র দুই পরিবার ফিরে আসছে।
“যেসব পরিবার আগে থেকে পাড়ায় ছিল, যারা পালিয়ে যায়নি, তাদের পরিস্থিতিও খুব ভালো না। তাদের অনেকের ঘরে খাবার নাই। তার মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার কিছু পরিবার ফিরে আসছে। তারপরও সবাই মিলে কষ্ট করে ভাগাভাগি করে খায়।”
‘মাইফলক’ বলছে সেনাবাহিনী
‘সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতায়’ রুমা উপজেলার ১২২টি বম পরিবার নিজ নিজ পাড়ায় নিরাপদে ফিরে এসেছে বলে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
যারা ফিরে এসেছেন, তাদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার কথাও গত ২৬ জুনের বিবৃতিতে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
সেখানে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মীর মুশফিকুর রহমান প্রত্যাবর্তনকারী পরিবারগুলোর উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের ফিরে আসা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়; এটি জাতীয় সংহতির প্রতীক এবং পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির পথে একটি মাইলফলক। নিরাপত্তা, পুনর্বাসন, শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী সবসময় পাশে থাকবে।”
সেনাবাহিনী আরও বলেছে, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র তৎপরতা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে তারা সদা সতর্ক থাকবে। যারা এখনও ফিরে আসতে পারেননি তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মাধ্যমে সমন্বয় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সম্মানজনক সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের উদ্যোগ চলমান থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে আশ্বস্ত করা হয়।
কী ঘটেছিল
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা জানা যায়। পরে ওই বছর অক্টোবরে ঢাকায় র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ‘কেএনএফ’ বা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়।
এর মধ্যে ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল এবং পরের দিন ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় সোনালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে নিয়ে যায় বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।
দুটি ঘটনাতেই পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন ‘বম পার্টি’র নাম আসে। এরপর থেকে রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়ি এলাকায় কেএনফের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অভিযান চালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কেএনএফের সংঘাতে নিহত হয় কেএনএফেরর বেশ কিছু সদস্য। সংঘাতে প্রাণ যায় সেনা সদস্যেরও। অভিযান চলাকালে ভয় ও আতঙ্কে পার্শ্ববর্তী এলাকা ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে বম জনগোষ্ঠীর কয়েকশ পরিবার।
আরও পড়ুন:
ভারতে আশ্রয় নিয়েছে ৩ হাজার বম, ৯ পাড়া খালি: রেভারেন্ড পাকসিম বম
২০২৪ সালে পাহাড়ে ২০০ মানবাধিকার লঙ্ঘন, ২১ হত্যা: জেএসএস
রুমায় বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত: আইএসপিআর
কেএনএফের প্রশিক্ষিত জামাতুল আনসারের ২৮ 'জঙ্গির' জামিন বাতিল
বান্দরবানে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ২ কেএনএফ সদস্য নিহত
'কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি': এখনও স্বাভাবিক হয়নি রুমা
পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই‘বম পার্টি’কারা?
ব্যাংক ডাকাতি-অর্থ লুট: রুমা ও থানচিতে ৬ মামলা
কেএনএফকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়া হবে না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
শান্তি আলোচনায় কেএনএফকে বিশ্বাস করেছিলাম, তারা ষড়যন্ত্র করেছে: সেনাপ্রধান
কেএনএফকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়া হবে না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রুমায় ব্যাংক লুট: সন্ধান মেলেনি‘অপহৃত’ব্যবস্থাপকের