আমার জন্ম উত্তরবঙ্গের পাবনা জেলার সদর থানার কিসমত প্রতাপপুরে। তিন সপ্তাহ আগে এখানে এসে বিদ্যুৎ বিভাগের যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ২৪ ঘণ্টায় ১২-১৪ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। কখনও একনাগাড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন সময় কাটাতে হচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ এসে মাত্র ১০-১৫ মিনিট পরই চলে যাচ্ছে, এমনটিও হচ্ছে।এসেছিলাম ছোট্ট বাংলো বাড়িটার বারান্দা থেকে সামনে প্রশস্ত লনে বৃষ্টি ঝরার দৃশ্য দেখব এবং বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনব বলে। ভেবেছিলাম একরাশ সুখানুভূতি নিয়ে ঢাকায় ফিরতে পারব। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটি। বৃষ্টি কার্পণ্য না করলেও প্রচণ্ড গরমে জীবন ধারণ অসহ্য হয়ে পড়েছে। এত বৃষ্টি সত্ত্বেও গরমের প্রচণ্ডতা কমছে না। গত বছরও এ সময় এসে প্রায় এক মাস কাটিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এত গরম অনুভব করিনি। তাছাড়া বিদ্যুতের লুকোচুরিও ছিল অনেক কম। সেদিক থেকে দেখা যায় গত বছরের তুলনায় বিদ্যুতের অবস্থা আরও বেহাল! অথচ এই এক বছরে এ ক্ষেত্রে অবস্থার আরও উন্নতি হওয়ার কথা। গলদটা কোথায় তা বিদ্যুৎ বিভাগের হর্তাকর্তারাই বলতে পারবেন।যাক সে কথা। প্রকৃতির কথায় ফিরে আসি। দিনের পর দিন প্রকৃতিও মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উত্তরবঙ্গের এই পাবনায় বলতে গেলে জীবন যৌবনের প্রায় সবটাই কেটেছে। কিন্তু এমন বৈপরীত্য এবং অসহনীয় প্রাকৃতিক অবস্থার অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। একবার মনে করলাম ঢাকা ফিরে যাব। কিন্তু নিজের শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার কথাই শেষে ভাবলাম। বিদ্যুৎ বিভাগ যাতে সদয় হয় তজ্জন্য আমার স্ত্রী তাদের নিষ্ঠুরতার কথা লিখে ফেসবুকে ছেড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার এবং অন্য অনেকের ফেসবুকেও তা ভেসে উঠল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হচ্ছে না। দৈনিক ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন কাটাতে হলেও বৃষ্টির ছন্দ দেখার জন্য এখান থেকে নড়ছি না। আমার বারান্দা থেকে দক্ষিণ দিকে আমগাছ, জামগাছ পার হয়ে কয়েকটি নারিকেল গাছের পর দিগন্ত পর্যন্ত চোখে পড়ে। চারপাশেই খোলা আকাশ দেখা যায়। এ অবস্থায় আকাশের মেঘ আর বৃষ্টিকে আমি খুব উপভোগ করি। ছোটবেলায় ইচ্ছা করে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজতাম। সেদিন হঠাৎ করে সেই ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বাড়ির সামনের দীর্ঘ লনে হাঁটাহাঁটি করে বৃষ্টিতে ভিজলাম। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ভিজে তারপর গোসল করে ফেললাম। ভেবেছিলাম সর্দি বা মাথাব্যথা হবে। কিন্তু কিছুই হল না। সেদিক থেকে আল্লাহ্ এখনও ভালো রেখেছেন। এখন প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। দুই-একটি কবিতা হয়তো লেখা যেত। কিন্তু এবারে তা হবে না। কারণ ‘রহিম গায়েন’ নামে একটা উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়ে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উপন্যাসটা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন তারই পাঁচ-সাত পৃষ্ঠা করে লিখে চলেছি। ভাবছি আরও কয়েকদিন থেকে পাণ্ডুলিপিটা শেষ করে তবেই ঢাকা ফিরব। যদিও প্রতিদিনই বিদ্যুতের অত্যাচারে জীবন কাটাচ্ছি। আজ শেষরাতেও বিদ্যুৎ সাহেব চলে গিয়ে এখন সকাল ১০টা অবধি ফেরেননি। বিদ্যুৎ সাহেবের এমন অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণের মুখে মুখে এখন বিদ্যুৎ বিভাগের সমালোচনা। এমনও হতে পারে, আমি যে এলাকায় আছি সেই এলাকায় ডাকসাইটে কেউ না থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগ এলাকাটিকে লোডশেডিংয়ের ডাম্পিং এরিয়া হিসেবে বেছে নিয়েছে। জীবনযাপনে কষ্ট পাচ্ছি বলে দেখার মাঝে বারবার বিদ্যুৎ বিভাগের অত্যাচারের বিষয়টি এসে যাচ্ছে। আবারও প্রকৃতির কথা বলি।আকাশে সবসময় ঘন মেঘের ঘনঘটা। কখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছে, আবার কখনও থেমে থেমে। তবে গত সন্ধ্যা রাতে আকাশ পরিষ্কার ছিল। সারা আকাশে তারার খই ফুটেছিল। আমি এবং আমার স্ত্রী বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় চেয়ারে বসে প্রাণভরে তারাভরা আকাশ দেখলাম। প্রকৃতির কী খেয়াল! বিকালেও বৃষ্টি ছিল। অথচ সন্ধ্যা রাতেই ফকফকে নীল আকাশে তারার মেলা। বহুদিন, বহু বছর এমন তারাভরা আকাশ দেখিনি। মনে হল অতীতের চেয়ে এখন আকাশে তারার সংখ্যা অনেক বেশি। স্ত্রীকে বললাম, ‘অন্য আকাশের তারারা বোধহয় আমাদের আকাশে বেড়াতে এসেছে, নইলে সারা জীবন আকাশে যেভাবে তারা দেখেছি, এখন তারার সংখ্যা অনেক অনেক বেশি মনে হচ্ছে কেন? সারা আকাশই যেন তারায় তারায় ছেয়ে গেছে।’ শুনে স্ত্রী বললেন, ‘হয়তো সত্যি তারার সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমরা গত ২৫-৩০ বছর এভাবে খোলা আকাশের নিচে বসে তারা দেখি না। এই ২৫-৩০ বছরে যেসব তারা বা গ্রহের আলো পৃথিবীতে পৌঁছেনি এতদিনে হয়তো সেগুলোর আলোও পৃথিবীতে পৌঁছেছে।’ তার বিশ্লেষণ সঠিক কিনা তা ভেবে বললাম, এ বিষয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ওই মুহূর্তে আকাশে তারার সংখ্যা বেশি বলে মনে হল। তারাদের কথা ছেড়ে আবার মেঘ বৃষ্টির কথায় ফেরা যাক।যে মেঘ-বৃষ্টি দেখার জন্য ঢাকা থেকে প্ল্যান করে পাবনা এসেছি, সে আশা পূরণ হয়েছে বলে মনটা খুশিতে ভরে আছে। সারা দিন আকাশভরা টইটম্বুর মেঘমালা দেখি, ঝর ঝর ধারায় বৃষ্টি ঝরা দেখি, বাইরে যাওয়ার তাড়না না থাকায় মাঝে মাঝে বসে লেখালেখি করি। দুই-চারদিন বাদে কিছু সময়ের জন্য ঘরের বাইরে গিয়ে নদীর মাছ, দেশি মুরগির ডিম, দেশি মুরগি কিনে ঘরে ফিরি। একসময় পাবনা জেলা মাছ, দুধ, মণ্ডা-মিঠাই ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত ছিল। ছেলেবেলায় গরম ভাতের সঙ্গে আলুভর্তাসহ খাঁটি ঘি খাওয়ার কথা এখনও মনে পড়ে। সেই মাছ, দুধ, মিষ্টির সুনাম এখনও পাবনায় কিছুটা অক্ষুন্ন আছে। যদিও মাছের বাজারে গেলে দেখা যায় চাষের মাছে বাজার সয়লাব, তবুও চেষ্টা করলে নদীর মাছও পাওয়া যায়। তবে দুধের সুনাম এখনও আগের মতো অক্ষুন্ন থাকায় এখানে খাঁটি মণ্ডা-মিঠাই পাওয়া যায়। আর পাবনার ঘোষ সম্প্রদায়ের অধিকাংশই এখন এখানে না থাকায় মিষ্টির ব্যবসায় মুসলমানরাও ভাগ বসিয়েছেন। ফলে মুসলমান ও হিন্দু ঘোষরা পাল্লা দিয়ে রমরমা মিষ্টির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর পাবনার মানুষও দই-মিষ্টির ভীষণ ভক্ত। বড় বড় মিষ্টির দোকানে সবসময় ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে।পাবনার আরও একটি ঐতিহ্য হল পদ্মার ইলিশ। তাছাড়া পদ্মা নদীতে অন্যান্য দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মাছও পাওয়া যায়। জেলেরা সারা রাত মাছ ধরে সকালে তা বাজারে বিক্রি করেন। অনেকে বংশ পরম্পরায় শুধু এসব মাছই খেয়ে থাকেন। তবে পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ার সে ঐতিহ্য এখন আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন। পদ্মা নদীও এখন শুকিয়ে অল্প একটু স্থানে নিজের অবস্থান কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে। আর এভাবে পাবনার জলবায়ু-আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কারণ পাবনার দক্ষিণের প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে আগের মতো সেই দক্ষিণ বায়ু আর পাবনাবাসীর প্রাণ জুড়ায় না। খোদ পদ্মা নদীই এখন ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। সেখানে মানুষ বসতি স্থাপন করে চাষাবাদ শুরু করেছে। আমার বাড়ির দক্ষিণ দিকের এ বালুভূমি এবং অল্পকিছু জলাভূমি পার হলেই রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। ছাত্রজীবন থেকে এ পর্যন্ত সেখানে আমি দশ-বারোবার গিয়েছি। ছেলেবেলায় যেখানে বিশাল নদী পাড়ি দিতে হতো, সেখানে এখন প্রায় হেঁটেই যাওয়া যায়। এ ভূমি পরিবর্তনের কারণে পাবনার আবহাওয়াও উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। ধু ধু বালুর মধ্যে বসতি গড়ে ওঠায় নছিমন, করিমন, ভটভটি, অটোরিকশা পর্যন্ত রাস্তা করে নিয়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডলও দূষিত হচ্ছে। আগের মতো নির্মল বাতাস এখন আর নেই। গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ-বস্তার স্তূপ। সেসব অঞ্চলে ছোট ছোট প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠায় গ্রামের মানুষকেও দূষিত বায়ু সেবন করতে হচ্ছে। অথচ এসব দিকে পরিবেশ অধিদফতরের কোনো খেয়াল নেই। শোনা যায়, প্রতি ঈদের আগে এসে তারা এসব কারখানা থেকে ঈদ বকশিশ নিয়ে যায়।এ অবস্থায় উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত পাবনার খাদ্যসামগ্রী, সুজলা-সুফলা শস্যক্ষেত, আম্রকানন, খরস্রোতা পদ্মায় পালতোলা নৌকা, স্টিমারের হাকডাক আর আগের মতো নেই। অথচ ছেলেবেলায় আমরা এসব প্রাণভরে দেখেছি এবং উপভোগ করেছি। রবিঠাকুর পদ্মা নদীতে ধানের আঁটিভরা নৌকা দেখেই ‘সোনার তরী’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। তিনি যে কক্ষটিতে বসে পদ্মা নদীর শোভা উপভোগ করতেন, বৃষ্টি দেখতেন- সে কক্ষটি এখনও অক্ষত থাকলেও পদ্মা নদীর সে শোভা আর নেই। আর তা নেই বলেই ঋতু বৈচিত্র্যেও আগের মতো বিচিত্রতা নেই। তবুও তখনকার পদ্মা নদীর উত্তর পাড়ের আমার বাড়িতে এখনও আষাঢ় মাসে ঢল নামে, শ্রাবণ মাসে অজস্র ধারায় বৃষ্টি ঝরে, ভাদ্র মাসে কিছুটা হলেও যৌবন ফিরে পায় পদ্মা। আশ্বিন মাসে খানিকটা ঝড়-বৃষ্টি হয়। আর ঋতু বৈচিত্র্যের সেই খেলা দেখতে আমার মতো কবি মানসও বারবার ছুটে আসে উন্মুক্ত প্রকৃতির কাছে। যেখানে এখনও পাখিরা গান গায়, আকাশ তারায় ভরে, বাতাস বাঁশি বাজায়, নদী ঢেউ তোলে, জেলেরা মাছ ধরে, মাঝিরা গান করে, কৃষকেরা ধান কাটে। আর বয়স্ক মানুষেরা রবীন্দ্রদর্শনে আকুল হয়ে কবিগুরুর লেখা কবিতার চয়ন আবৃত্তি করে, ‘গগনে গরজে মেঘ ঘনবরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’।মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews