ময়মনসিংহ ইঞ্জিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী ধ্রুবজিতের মৃত্যুর পর ওর চিরকূটে দায়ী করে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা কি আবার শিক্ষা ব্যবস্থার চাপ নিয়ে যে চির পুরাতন আলোচনা ছিল, সেটিকে সামনে এনেছে।

শিক্ষা কখনোই চাপ হওয়া উচিত ছিল না এবং হলে সেটি কেবল বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়। ঠিক এখন যেরকমটা হচ্ছে। আমরা চাই একটি চাপমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। এটা শুধু আমাদের চাওয়া নয়, উন্নত বিশ্ব এটা করে দেখিয়ে দিচ্ছে, সেই সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ধরনই হলো শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপমুক্ত রাখা। যে দেশগুলো যত উন্নতি করেছে, তাদের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাও। এটা হলো শিক্ষার প্রকৃত আধুনিকায়ন।

আমরাই শুধু এর ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়েছি ঠিকই, শিক্ষিতের হার বেড়েছে, তবে চাপমুক্ত করতে পারিনি। শিক্ষাকে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার চেষ্টা করেছি। ভালো ফলাফলকে এমন একটি মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখানে কেউ ফেল করলে আত্মহত্যা করারও রেকর্ড এদেশে কম নয়। যেমনটা দেখলাম ধ্রুবজিৎ কর্মকারের বেলায়, ধ্রুবজিৎ আত্মহত্যা করেন গত ১৯ মে। এরপর ধ্রুবজিৎ কর্মকারের ‘আত্মহত্যার’ ঘটনায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদী একটি নাটিকায় তুলে ধরা হয়েছে ধ্রুবজিতের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটও। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে একাডেমিক কম্বাইন্ড সিস্টেম বাতিল করে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত প্রচলিত একাডেমিক সিস্টেমে ফেরত যাওয়ার দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। এই সবই হয়তো কিছু বাস্তবায়ন হবে, কিছুটা অবাস্তবায়িত রয়ে যাবে। কিন্তু ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের মনোতোষ কর্মকার ও সুপ্তি কর্মকারের দুই ছেলের মধ্যে ছোটটি আর ফেরত আসবে না।

শিক্ষাকে পণ্যে তৈরি করেছি আমরা। আনন্দের উপকরণ, জ্ঞান আহরণের বিষয় হিসেবে সংযুক্ত না করে ভালো ফলাফলে এবং একটি ভালো চাকরির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছি। শিক্ষা মানুষের মধ্যকার অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করার কাজ করলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রয়োগের উদ্দেশ্য এবং ধরণেই এমনটা হচ্ছে বলা যায়। শিক্ষা এবং শিখনের ধারণাটা হয়েছে এমন যে প্রচুর পৃষ্ঠা মুখস্ত করতে হবে, প্রাইভেট কোচিং পড়তে হবে এবং যে কোনো উপায়ে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। যদিও চাকরির বাজারে সবাই ভালো করছে না। কাঁধে ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে স্কুলে গিয়ে চাপ খেলেই শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। বড়জোর একটি শিক্ষিত যন্ত্র তৈরি হয়।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এ.পি.জে আবদুল কালাম শিক্ষা নিয়ে খুবই চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “যতদিন শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি পাওয়া হবে, ততদিন সমাজে শুধু চাকররা জন্মাবে, মালিক নয়।” যে কথার বাস্তবিক প্রমাণ আমরা আজকের সমাজে প্রতিফলিত হতে দেখছি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া। একটা সার্টিফিকেট আর চাকরি তারপর জীবনে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের দেশে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহুবার ঘষামাজা করা হয়েছে। কখনো কোন বিষয় অকারণেই বাতিল করা হয়েছে, আবার প্রয়োজনের খাতিরে কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশরা– এমনটাই বলা হয়ে থাকে। মূলত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কিছুটা পরিবর্তন করে আজও আমাদের দেশে চলছে শিক্ষাদান। ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের দায়িত্ব পেয়েছিলেন লর্ড মেকলে। মেকলে জানতেন, ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার শক্তি। যে শিক্ষা ছিল গুরুগৃহ ও আশ্রমকেন্দ্রিক।

লর্ড মেকলের এ উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন নিয়ে একটি চিন্তা চেতনা ছিল এরকম– তিনি ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সংসদে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমি ভারতের আনাচে কানাচে ঘুরেও একজন ভিক্ষুক কিংবা একজন চোরের দেখা পাইনি। এদেশে এতটা ধনসম্পদ, এদেশের মানুষের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের এতটা উচ্চস্তর দেখেছি যে, এদেশবাসীর শিক্ষা,তাদের ধর্মবিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুরোপুরি ভেঙে দিতে না পারলে আমরা কোনদিনই দেশটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব না।” এই ভাষণে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, “আমরা এসব ঐতিহ্যগত শিক্ষাব্যবস্থা আর সংস্কৃতিকে এমনভাবে বদলে দেব যেন তারা যা কিছু বিদেশী, যা কিছু ইংলিশ, সে সব কিছুকেই তাদের নিজেদের চেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবতে শিখবে। নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে তারা, ঠিক আমরা যেমনটা চাইব, তেমনই একটি আত্মবিস্মৃত পদানত জাতিতে পরিণত হবে।”

ইংরেজদের সেই ইচ্ছার প্রতিফলন আজও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখতে পাই। আমাদের পোশাকে, আমাদের চালচলনে আমরা সর্বদাই সেই সাহেবদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি। নিজেদের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে আমরা পর সংস্কৃতির শিক্ষাই লাভ করতে শিখেছি। প্রখ্যাত অক্ষয় কুমার দত্ত ‘বঙ্গদেশে শিক্ষার বর্তমান অবস্থা’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন “শিক্ষা প্রণালী যদি অপকৃষ্ট হয় তবে কোন জাতি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে না। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষ্যের সকল প্রকার মানসিক বৃত্তির উন্মেষকার্য সম্পাদন। যাহাতে মনুষ্যের শারীরিক, মানসিক, সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন হয় শিক্ষাকার্যের তাহাই লক্ষ্য হওয়া কর্তব্য।”

আমাদের অভিভাবকদের কাছে শিক্ষা একটি প্রতিযোগিতা যেখানে প্রথম হওয়ার জন্যই দৌড়ায় মেধাবীরা! সিলেবাস, পরীক্ষা, মার্কস, রেজাল্ট এবং এসব অর্জনে অসহনীয় চাপ। সেই চাপের বেশিরভাগটাই দেখা যায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ বিজ্ঞাপনে লিখতে হয় কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কতজন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শিক্ষা চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থারও। কিন্তু এখনও কার্যকর অবস্থানে আমাদের শিক্ষা পৌঁছাতে পারেনি। এর পেছনে বড় কারণ হলো এই মুখস্ত বিদ্যার প্রভাব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য। তাঁর ‘শিক্ষার বাহন’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “মুখস্ত করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাঁদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল?” তো এই চৌর্যবৃত্তিতে আমরা জাতি হিসেবে শিক্ষা নিয়ে ঠিক কতখানি অগ্রসর হতে পারি সে এক বিরাট প্রশ্ন? শিক্ষা থাকতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। একজন ব্যক্তিকে শিক্ষিত করার অর্থ হলো তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তাকে কোনো কাজে দক্ষ করে গড়ে তোলা, তাকে প্রকৃত জ্ঞানের চর্চায় উৎসাহিত করা। মোট কথা শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে টিকে থাকার লড়াইয়ে যথেষ্ট শক্তি জোগানো।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমতন যুদ্ধ হয়। সেটা হলো জিপিএ ফাইভ নিয়ে। এটা রীতিমত দেশের অভিভাবকদের কাছে মানসম্মানের ব্যাপার। সন্তান যদি জিপিএ ফাইভ না পায় তাহলে পাড়া মহল্লাশুদ্ধ মানুষ গালমন্দ করতে থাকে। এমনকি নিজের মা-বাবার মুখটাও সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে। শুদ্ধ শিক্ষার ইতিহাসের বিপরীত ব্যবহারের ফল যে আমাদের এমন বেহাল দশা করে ছাড়বে তা কে জানত। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না তার কোন প্রয়োজন নেই। আজকাল যেন একটাই মূল লক্ষ্য, কেবল সার্টিফিকেট। সেটা লেখাপড়া করে হোক বা টাকা দিয়ে কিনে হোক কার্যসিদ্ধি হলেই হলো। কোনো মতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ। কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষায় ফেল বা কম মার্ক পেলেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে মনুষ্যত্ব অর্জনে। আর তাই যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে বা আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তারা যেন সব শেষ হয়ে গেছে এটা মনে না করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সঙ্গ দিতে পারে সন্তানের অভিভাবক। যেসব কলেজে কোন শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি সেসব কলেজ থেকে ভবিষ্যতে মেধাবী কেউ বের হবে না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। তবে পাশ না করার কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। কলেজ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি প্রমাণিত হলে ব্যাবস্থা নিতে হবে। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজন। পাশের হার বৃদ্ধি করে আপাত শিক্ষার প্রসার হলেও মান না বাড়লে স্থায়ী ক্ষতি হয়। আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা আশা করি যেখানে কেউ শিক্ষা গ্রহণকে চাপ হিসেবে না নিয়ে সহজ স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানান্বেষণের কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। ঠিক যেভাবে আমরা খাদ্য গ্রহণ করি সেভাবে শিক্ষাও স্বেচ্ছায় এবং ধারাবাহিকভাবে গ্রহণ করবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews