মাজিদুল ইসলাম উজ্জ্বল
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এক ভূখণ্ড। মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের এ ভূখণ্ডটি আজ পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পরও যেন বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে পারছে না। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, গণহত্যা কোন শব্দই যেন আজ গাজা উপত্যাকার জন্য যথেষ্ট নয়। এ নির্মম পরিস্থিতির সূচনা শুধুই হামাস-ইসরাইলের সংঘর্ষে নয় বরং এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৮ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৫ বছরের ইতিহাস শুধু দখল বা যুদ্ধ নয় বরং একটি জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ধারাবাহিক পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ। যা আজ গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত। জাতিসংঘের একপাক্ষিক প্রস্তাব ও বিশ্বশক্তির নীরবতায় এ নির্মমতার পথ সুগম হয়েছে।
১৯৯৩ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত একত্রিত হয়ে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ শান্তি চুক্তিতে ফিলিস্তিনীরা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখলেও ৩০ বছরের বাস্তবতায় সেটা ফিলিস্তিনের জনগণের সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। সে চুক্তিতে পিএলও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে তারা ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ইসরাইলের সমর্থন পায়। কিন্তু ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূমি দখলের বৈধতা নিয়েও বাকি ২২ শতাংশ ভূমিতে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি ইসরাইল। ২০০৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি স্থাপন আগের তুলনা দ্বিগুণ হয় এবং ২০২৩ নাগাদ সে হার চারগুণ হয়। ৩০ বছরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনের ভূমিতে আরও ৭ লাখ ইহুদীর আবাসস্থল তৈরী করেছে ইসরাইল। আর ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীরা আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। প্রতিবাদ করলেই তার পরিণতি হয়েছে গুলী করে হত্যা অথবা ইসরাইলের কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। তাই ইসরাইল ও আমেরিকা সমর্থিত ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও স্বীকার করেছেন যে, ইসরাইল সব চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাই আমরাও আর কোন চুক্তি মানতে বাধ্য নই।
ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার ঘটে ২০০৬ সালের নির্বাচনেকে কেন্দ্র করে। এ নির্বাচনের প্রধান দু’প্রতিদ্বন্দ্বী হয় ফাতাহ নেতৃত্বাধীন পিএলও এবং ইসলামিক প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাস। ফাতাহ নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লাগামহীন দুর্নীতি, পক্ষপাত এবং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ রয়েছে ফিলিস্তিনী জনগণের মধ্যে। এছাড়াও ইসরাইল ও পশ্চিমা শক্তির প্রতি নমনীয় আচরণ, ইহুদী বসতি স্থাপন রুখতে ও ফিলিস্তিনীদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থতার কারণে তার প্রতি সাধারণ জনগণ আশাহত ছিলো। অন্যদিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে তারা হামাসকে বিবেচনা করে। আর ২০০৬ সালের নির্বাচনের সময়ে হামাস দুর্নীতি বিরোধী এবং সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলো। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে সহায়তা এবং ইসলামপন্থী দল হওয়ায় ধর্মীয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে হামাসের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। যার ফলে নির্বাচনে হামাস বিশাল বিজয় লাভ করে। কিন্তু হামাসকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করায় নবগঠিত সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। মাহমুদ আব্বাসও হামাসকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অনুরোধ করেন। গাজায় নিজের অনুগত বাহিনীকে শক্তিশালী করেন যেন হামাসের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ বাহিনীগুলোকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করেছিলো যাতে হামাসের কর্তৃত্ব দমন করা যায়। এর ফলে ২০০৭ সালে হামাস ও ফাতাহ এর উত্তেজনা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় এবং জুন মাসের মধ্যে হামাস গাজা পুরোপুরি দখলে নিয়ে সরকার গঠন করে। অপর দিকে পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাসের পৃথক সরকার গঠিত হয়। তারপর থেকেই গাজা এক অবরুদ্ধ উপত্যকায় পরিণত হয়।
হামাস নিজেদের সীমিত সামর্থ্য এবং নিশ্চিত বিপদ জেনেও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। এ কারণে অনেকেই ফিলিস্তিনের এ দুর্দশার জন্য হামাসকেই দায়ী করেন। কিছু ইসলামিক স্কলারও এ হামলাকে ‘মৌচাকে ঢিল’ ছোড়ার সাথে তুলনা করেছেন। আর পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সংঘাত যেন এ হামলার কারণেই শুরু হয়েছে। কিন্তু হামাসের বিবৃতি এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের গবেষণা পর্যালোচনা করলে এ হামলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন “হামাস বিনা কারণে হামলা চালায়নি।” এর কারণগুলোর মধ্য প্রথম আছে ইসরাইলী আগ্রাসন।
দশকের পর দশক ধরে চলা ইসরাইলী দখলদারিত্ব এবং নির্বিচারে হত্যা, গ্রেফতার ও নিপীড়ন বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যে কারণে গাজাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত ইসরাইলী সেনা এবং গোয়েন্দা সদস্যের বক্তব্য হতে জানা যায়- ইসরাইল কখনোই গাজার মানুষদের আত্মনির্ভরশীল হতে দেয়নি। তাদের পানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাতে বাধা দেয় ইসরাইল। সেখানে কোন কলকারখানা তৈরী হওয়ার আগেই গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইল। এমনকি তাদের কৃষিক্ষেত বা জলপাই বাগানও জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের সব ধরনের উপায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র বিমানবন্দরটিও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। তাই ইসরাইলের প্রতি হামাস এবং গাজাবাসীর অনেক ক্ষোভ জমে রয়েছে। ইসরাইলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনীদের মুক্ত করতে হামাস এ হামলায় ২৫১ জন ইসরাইলীকে বন্দী করে নিয়ে যায়।
ইহুদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ভূমিতে আগমন ঘটবে মসীহের। তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী তার আগমণের ৩টি শর্ত রয়েছে।
ক. সার্বভৌম ইহুদী রাষ্ট্র গঠন। খ. পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইহুদীদের একত্রিত হওয়া। গ. সোলাইমানি মন্দির বা থার্ড টেম্পল তৈরী করা।
ইসরাইলের ইহুদীদের বিশ্বাস মতে তাদের প্রথম দুটি শর্ত পূরণ হয়ে গেছে। এখন শুধু আল আকসা মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে থার্ড টেম্পল তৈরি করলেই মসীহের আগমন ঘটবে। এ টেম্পল তৈরী করার জন্য ‘রিটার্নিং টু দ্য মাউন্ট’ এবং ‘বোনেহ ইসরাইল’ নামক দুটি সংগঠন সক্রিয় হয়েছে। এছাড়াও ইসরাইলের টেম্পল ইনস্টিটিউট সব সরঞ্জাম প্রস্তুত করে রেখেছে। ২৪ ক্যারেট সোনায় তৈরি ৪৫ কেজি ওজনের আলোকদানি ‘গোল্ডেন ম্যানোরাহ’, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা পাঁচটি লাল গরু এবং আল আকসার পাশেই থার্ড টেম্পল এর মডেল তৈরি করে রাখা হয়েছে। হামাস মনে করে মাহমুদ আব্বাস যেহেতু ইসরাইলের সমর্থনেই ক্ষমতায় রয়েছে তাই সে ইসরাইলের এসব কাজে কোন বাধা দিচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও দিবে না। তাই হামাস নিজেদের উপর ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানির পরিণতি জেনেও ৭ অক্টোবর হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল আর সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাকিকীকরণের আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিলো। ইতোমধ্যেই আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান ও বাহরাইন কিছু দিন আগেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যদি সৌদি আরবও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় তবে ফিলিস্তিনের শেষ স্বপ্নটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না। তাই এই আলোচনা বন্ধ করাও হামাসের হামলার অন্যতম কারণ।
গাজায় গণহত্যার জন্য মাহমুদ আব্বাস ও তার মিত্ররা হামাসকেই দায়ী করে আসছে। তিনি গাজার পুনর্গঠন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে চাইলেও পশ্চিম তীরেই তিনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। বরং, সাময়িক যুদ্ধবিরতির সময়েও ইসরাইল পশ্চিম তীরে হামলা চালিয়ে হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে, বাস্তুচ্যুত করে আরও ৪০ হাজার মানুষকে।
অপরদিকে হামাসের দাবি সুস্পষ্ট। তা হলো গাজার পুনর্গঠন, ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা। এ দাবির বিরুদ্ধে তারা যেকোন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এমনকি গাজা ছাড়ার বিনিময়ে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রস্তাবও তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে এটি শুধুই ভূখণ্ডের লড়াই নয়, বরং একটি পবিত্র যুদ্ধ। অধিকার ও মাতৃভূমি রক্ষার জন্য জীবন দানের রাস্তাই তারা বেছে নিয়েছে। হামাসের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতার মৃত্যুর পরেও অনমনীয় রয়েছে স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি।
এ অবস্থায় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অন্ধ সমর্থন পাওয়া ইসরাইল তার বেপরোয়া আগ্রাসন বন্ধ না করলে এর সমাধান সম্ভব নয়। ইসরাইল তার ইতিহাসজুড়ে প্রায় সব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। গাজা যুদ্ধের মধ্যেই হিজবুল্লার সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পরও ২৭০০ হামলা চালিয়েছে লেবাননে। আবার নিরাপত্তার অজুহাতে নিয়মিত সিরিয়াতে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। তাই কেবল হামাসকে দমন করে সমস্যার সমাধান হবে না। ইসরাইলকে সংযত করা, আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং দু’রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।