‘আমার হাতে কেন তামাকের গন্ধ, আমি তো তামাক খাই না’। অতি পুরনো এই কৌতুক ব্যক্তি জীবনে ঘটলে ক্ষতি হয় তো পুষিয়ে নেয়া যায়, হাত সাবান দিয়ে নয় তো আধুনিক জীবনে অনুষঙ্গ হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে ফেললে কেল্লা ফতে। কিন্তু দেশ জাতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা ভুল করলে সেই দায় সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললে শোধরানো যায় না।
ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে রীতিমতো আঁৎকে ওঠার মতো অনেক ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে। এমন ভুলের সংশোধন করতে কত জুলুম-নির্যাতন আর রক্ত ঝরাতে হয়েছে। মানে, জাতির দেশপ্রমিক সন্তানের রক্ত ঝড়ানো ছাড়া সে ভুলের দায় শোধরানো যায় না। তাই তো আমরা জাতির কাণ্ডারিদের মুখে প্রায় শুনি, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ।’ কিন্তু যদি গোটা জাতিকে অজ্ঞতায় রেখে কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ওই অপকর্ম সাঙ্গ করে বিদেশে পাড়ি জমান, তখন শুধু হায় হায় করা ছাড়া আর কিই-বা করার থাকে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করেন। যার কারণে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনকালের সূচনা হয়। এতে গোটা জাতির ঘাড়ে যে বর্বরতা চেপে বসেছিল সেই দায় শোধ করতে দীর্ঘ দেড় দশকে কত বিপুল রক্ত ঝরেছে; তা কারো অজানা নয়। জেল-জুলুম, আয়নাঘর, খুন-গুমের শিকার, ব্যবসায়-বাণিজ্য, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন সত্যের পক্ষের কত শত সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, আলেম, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক।
এবার শুধু আমাদের হাত দিয়ে তামাক খাওয়া নয়, নিজ দেশে পরবাসী করার আয়োজন চলছে বলে মনে সংশয় জাগে। এ আয়োজনের মহাজনরা হলেন ৩৬ জুলাই বিপ্লবের শহীদদের রক্তের ঋণশোধের দায় নিয়ে গড়া সংস্কার কমিশনের একটি অন্যতম কমিশন, ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’। তারা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’ নামে একটি সুপারিশ দাখিল করেছেন। এখানে এমন একটি বিষয় লুকিয়ে আছে, যা এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে অনেকের দৃষ্টির আড়ালে আছে। ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’-এ বর্ণিত ৬.১.৫-এ এই ধারার উল্লেখ রয়েছে। আড়ালে-আবডালে থেকে পাস হয়ে গেলে অন্য দেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়া উপজাতি, যাদের এ দেশের সংবিধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে; তারা হবেন আদিবাসী। এ দেশের আদি জনগোষ্ঠী মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যারা সমতলে বসবাস করেন, তারা হবেন পরবাসী। যাকে বলে উড়ে এসে জুড়ে বসা। উপজাতি জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতির শক্তিবলে খুব সহজে দেশের মানচিত্র খামচে ধরতে পারে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’-এ যাদের আদিবাসী বলে সুপারিশ করে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে; তারা সবাই উপজাতি, কেউ আদিবাসী নন। তারাও স্বীকার করেন। যেমন শশী চাকমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমরা যে আদিবাসী নই, আমরা যে উপজাতি সেটি কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা তো সত্যি বার্মা, চীন, ভারত, ত্রিপুরা থেকে আসছেন। আমরা সবাই বহিরাগত। আমরা সংখ্যাতেও খুব কম। আমাদের আদিবাসী দাবি করার কোনো যুক্তি নেই।’ ( ইনকিলাব, ৯ আগস্ট ২০২২)
আইএলও কনভেনশন ১৬৯ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এ দেশে বসবাসকারী ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে কম করে হলেও ৫০টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এমন কি স্বাধীতা দিতেও বাধ্য থাকবে সরকার। কারণ বাংলাদেশে বসবাস করে ৫০টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা আট লাখ ২৫ হাজার ৪০৮ আর পুরুষের সংখ্যা আট লাখ ২৪ হাজার ৭৫১। মজার ব্যাপার হলোÑ মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, এ সংখ্যা আরো বেশি এবং দুর্গম এলাকায় তথ্য সংগ্রাহকরা না যাওয়ায় ওই সব এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত তথ্য জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জনশুমারি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী জনসংখ্যা ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬০, ঢাকায় ৮২ হাজার ৩১১, খুলনায় ৩৮ হাজার ৯৯২, ময়মনসিংহে ৬১ হাজার ৫৫৯, রাজশাহীতে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৫৯২, রংপুরে ৯১ হাজার ৭০, সিলেটে এক লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৪ জন ও বরিশালে চার হাজার ১৮১।
অঞ্চল নিরিখে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে বসবাস করে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খুমি, লুসাই, মারমা, রাখাইন, চাক, বম, খেয়াং, পাঙ্খোয়া জাতিগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। বাকি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের মধ্যে মনিপুরি, গারো, সাঁওতাল ও রাজবংশী উল্লেখযোগ্য। (সূত্র : প্রথম আলো, নাগরিক সংবাদ-১০ মে ২০২৪)।
মানচিত্র বদলে ফেলার শঙ্কা যে অমূলক নয়, তা আইএলও কনভেনশন ১৬৯-তে কী আছে একটু দৃষ্টি দিলে সহজে বোঝা যায়। আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এর মতে, আদি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নিরূপণের ক্ষেত্রে, তারা মূল জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর, নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থসামাজিক মানদণ্ডে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাহফুজ আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসারে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বতন্ত্র তথা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে, তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে না; তবে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন, স্বশাসিত সরকার ও তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি কার্যক্রম এবং তা পরিচালনার জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে প্রকারান্তরে তা এ অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করবে।’ (প্রকাশিত : পার্বত্যনিউজডটকম, ২৭ আগস্ট ২০১৫)। সঙ্গতকারণে আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এ শ্রম কমিশন সুপারিশ করায় আমাদের এতে ভয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
ইমেইল : [email protected]