দলীয় নেতাকর্মীদের অশ্রুসজল ভালোবাসায় সিক্ত হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সদ্য প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। শুক্রবার নিজ এলাকায় বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে। তার মৃত্যুতে দলের পক্ষ থেকে চারদিনের শোক চলছে। শুক্রবার শোক শেষ হবে।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীতে তার তিনটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিঙ্গাপুর থেকে তার হান্নান শাহ’র লাশ দেশে আসে। এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা তার লাশ গ্রহণ করে বাসায় নিয়ে আসেন।

বুধবার সন্ধ্যা থেকে মহাখালীর ডিওএইচএস-এর বাসায় নেতাকর্মী, আত্মীয়স্বজনদের ভিড় জমে। লাশবাহী গাড়ি ডিওএইচএস-এর ৫ নম্বর রোডে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই বাসার সামনে থাকা নেতাকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।  

দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সদস্য এবং রাজনীতির রাজপথের প্রিয় সহকর্মীকে শেষবারের মতো দেখা ও শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার রাতেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আ স ম হান্নান শাহ’র বাসায় ছুটে যান দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এছাড়া জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুল হালিমও যান হান্নান শাহ’র বাসায়।

হান্নান শাহ’র মৃত্যুর পর বিবৃতিতে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় জীবনে বর্তমান ক্রান্তির সময়ে তাকে যখন খুব দরকার, সে সময় তিনি চিরতরে চলে গেলেন। এই অকাল মৃতুতে আমরা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশ হারালো জাতীয় স্বার্থরক্ষার এক দেশপ্রেমিক অধিনায়ককে, জাতি হারালো তার এক সাহসী সন্তানকে। এ ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একজন সাহসী সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। তার বর্ণাঢ্য সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল গভীর দেশাত্মবোধ ও দক্ষ পেশাদারিত্ব। দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথের সাহসী যোদ্ধা হিসেবেও লড়াই করেছেন। ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘তার মৃত্যু আমাদের নিদারুণ কষ্ট দেয়। তার সঙ্গে দীর্ঘ রাজনৈতিক পধচলায় তাকে একজন স্পষ্টবাদী হিসেবে দেখেছি। দলের বিপদে তিনি মুখ খুলেছেন, দলের প্রয়োজনে শক্ত কথাও বলেছেন। তার মৃত্যুর শোককে আমরা শক্তিকে পরিণত করে এই স্বৈরাচার সরকারের পতনকে তরান্বিত করব।

আসল বিএনপির উদ্যোক্তা কামরুল হাসান নাসিম দাবি করেন, ‘সদ্য প্রয়াত হান্নান শাহ ছিলেন একজন উঁচুমানের রাজনীতিক ও জাতীয়তাবাদী চরিত্র। তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আস্থাভাজন ছিলেন। মনেপ্রাণে আধুনিক ছিলেন। বাংলাদেশকে অনেক দূরে দেখতে চাইতেন। আমি কার্যত তার মৃত্যুতে শোকাহত, অনেক ক্ষেত্রে ভাষাও হারিয়ে ফেলছি।’

২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ  মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, ‘১/১১ প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী শক্তি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে তার সাহসী ভূমিকা সমগ্র জাতিকে এখনও অনুপ্রাণিত করে এবং আগামী দিনেও করবে।’

হান্নান শাহ’র গ্রামের বাসিন্দা ও ছাত্রদলের আশরাফুল ইসলাম রবিন বলেন, ‘পরিবারের মানুষের মতো নেতাকর্মীদের আদর, ভালোবাসা ও সাহস দিয়ে আগলে রাখতেন।  হান্নান শাহ তার কর্মে বেঁচে থাকবেন বহুকাল।’

বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হাজার হাজার দলীয় নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হন আ স ম হান্নান শাহ। এর আগে মহাখালী ডিওএইচএস মসজিদে এবং জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের জানাজায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও জাপার নেতারা শ্রদ্ধা জানান। 

ডিওএইচএস মসজিদের জানাজায় বিকল্পধারা সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বিএনপির সাবেক নেতা তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, বিএনপির নেতা ওসমান ফারুক, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, রুহুল আলম চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আনিসুজ্জামান প্রমুখ ছিলেন। সংসদের জানাজায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষে বিরোধীদলীয় হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর, বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন, শামসুজ্জামান দুদু, ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গণিসহ অনেকে। এরপর জানাজা শেষে হান্নান শাহ’র কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান তারা।

সংসদ ভবনের জানাজা শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জিয়া পরিবারের আস্থাভাজন একজন ছিলেন হান্নান সাহ। আজকে তাকে শেষ বিদায় দিলাম। দোয়া করি মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। তিনি এখন সব পর্যালোচনার উর্ধ্বে উঠে গেছেন।’

দুপুর ১২টার দিকে প্রয়াত নেতা আ স ম হান্নান শাহর লাশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয়। এ সময় শত শত নেতাকর্মীর শেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। বাদ জোহর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আব্দুল মঈন খান, কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, মোহাম্মদ শাহজাহান, আহমেদ আযম খান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আব্দুস সালাম, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সসহ অনেকে অংশ নেন। এছাড়া ২০ দলীয় জোট নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, শফিউল আলম প্রধান, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গোলাম মোস্তফা ভুইয়া প্রমুখ জানাজায় অংশ নেন।

বিএনপির পক্ষ থেকে জানা গেছে, ১৯৮১ সালে ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল সেনা সদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাঙ্গুনিয়া থেকে তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান শাহ।  হান্নান শাহকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন এইচ এম এরশাদ। পরে তিনি সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (এপিডি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৮৩ সালে বিএডিসির চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন হান্নান শাহ। শুরুতে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) ও ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সবোর্চ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, যা এ বছর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলেও বহাল ছিল।

১৯৪২ সালে গাজীপুরে কাপাসিয়ার ঘাগুটিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন সদ্য প্রয়াত আ স ম হান্নান শাহ। তার বাবা ফকির আব্দুল মান্নান ১৯৬৫-৬৮ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। হান্নান শাহ’র ছোট ভাই শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। পারিবারিক জীবনে হান্নান শাহ তার স্ত্রী নাহিদ হান্নান, মেয়ে শারমিন হান্নান সুমি এবং দুই ছেলে শাহ রেজাউল হান্নান ও শাহ রিয়াজুল হান্নানকে রেখে গেছেন।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হান্নান শাহ। এরপর মঙ্গলবার ভোরে স্থানীয় একটি মসজিদে প্রথম জানাজা হয় তার। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে হান্নান শাহ’র মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আসে। শুক্রবার গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পরে বাদ জুম্মা গ্রামের বাড়ি ঘাগুটিয়ার চালা বাজারে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

/এসটিএস/এমএমএনএইচ/



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews