সন্তানের জন্মের পরপরই প্রবল পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা লীনা। শিশুর যখন মাত্র এক মাস, তখন তার কেবলই মনে হতো আত্নহত্যা করার কথা। সে সময় স্বামী আবীর পাশে ছিলেন ছায়ার মতো। পিতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। শিশুর সব কাজেই সহযোগিতা করতেন লীনাকে। এমনকি শিশুকে খাওয়ার জন্য রাতে লীনা উঠলে আবীরও জেগে বসে থাকতেন স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। ধীরে ধীরে শিশু অরিত্রি বড় হয়েছে। মেয়ে অরিত্রি বাবার মতোই দায়িত্বশীল মানুষ হয়েছে এইটুকুন বয়সেই- জানান লীনা।

শিশুর জন্মের পর তার প্রাথমিক যত্নআত্তি কিংবা খেয়াল রাখার পুরো দায়িত্বটাই একসময় অলিখিতভাবে ছিল মায়ের। শিশুকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ডায়াপার বদলানো কিংবা ঘুম পাড়ানোর দায়িত্বগুলো মায়ের উপরেই চেপে বসতো। পরিবারের মুরুব্বিরা হয়তো সাহায্য করতেন, কিন্তু এই কাজগুলোতে বাবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকতো না বললেই চলে। বাবার কাজ ছিল অফিস করা বা বাজার করা। তবে ধীরে ধীরে সময় বদলেছে, বদলেছে নতুন প্রজন্মের বাবাদের চিন্তাধারা।

নতুন বাবা হয়েছেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অন্তর আহমেদ। বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত তিনি। অন্তর বলেন, একজন মায়ের আত্নত্যাগ নিজ চোখে দেখার পর মনে হচ্ছে বাবা হিসেবে যতটুকুই করি না কেন, সেটা আসলে কম। আর সন্তান তো মায়ের একার না। সন্তান পালনে বাবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কেবল মাকেই স্বস্তিতে রাখে না, বরং শিশুর সঠিক বিকাশেও সাহায্য করে।

একই কথা জানালেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি জানান, সন্তান পালনে বাবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাবারা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যে বাবা কেবল শিশুর অর্থনৈতিক চাহিদার দেখভাল করেন তার চাইতে সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় বাবার শিশুরা নিজেদের অনেক বেশি মূল্যবান এবং নিরাপদ অনুভব করে। এসব শিশুরা সামাজিক যোগাযোগেও দক্ষ হয়।

সন্তান পালনে বাবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আসলে কী? ‘ধরুন আপনি চাইলেই কর্মঘন্টা আপনার সুবিধা মতো ঠিক করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর কর্মঘন্টা বা অফিস শিডিউলের সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে ঠিক করুন যেন আপনার স্ত্রী অফিসে থাকাকালীন একটা বড় সময় আপনি সন্তানের দেখভাল করতে পারেন। সেটা সম্ভব না হলে অফিস থেকে ফিরেই পুরোটা সময় শিশুকে দিন। এই সময় দেওয়া মানে কিন্তু পাশে বসে মুঠোফোন ব্যবহার করা নয়। শিশুর সঙ্গে খেলুন, গল্প করুন। ঘরের কাজ ভাগ করে নিন স্ত্রীর সঙ্গে। সংসার ও সন্তান- দুটোই কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দুইজনের অংশগ্রহণে চলে। পরিবারের কোনও সদস্যের যত্ন করা, রান্না কিংবা কাপড় ধোয়ার মতো কাজ লিঙ্গ নির্ভর নয়। এই শিক্ষাও কিন্তু শিশু পরিবার থেকেই পাবে। কারণ তারা অনুকরণপ্রিয়। সে যখন দেখে পরিবারে সবাই সবাইকে সাহায্য করছে, তখন সেও সেটাই অনুকরণ করে- বলেন জান্নাতুল ফেরদৌস।  

তরুণ বাবা রাফি মোহাম্মদ কাজ করছেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার ছোটবেলাটা বাবার সাহচর্য ছাড়াই কেটেছে বলতে গেলে। বাবা দিন শেষে ফিরতেন ক্লান্ত হয়ে, তেমন কোনও কথাই হয়ে উঠত না। বাবা ছিলেন গুরুগম্ভীর প্রকৃতির, বাবাকে তাই ভয়ও পেতাম খুব। বাবা বাসায় ফিরলেও তটস্থ হয়ে থাকতাম। এভাবেই কেটেছে ছেলেবেলা। কৈশোরের শুরুতে বাবাকে হারালাম, এখন আসলে বাবার সাথে সুখস্মৃতি কী, সেটাই ঠিক মতো মনে করতে পারি না। তাই আমার খুব ইচ্ছা আমার সন্তানরা যেন বাবার সঙ্গে কাটানো আনন্দের স্মৃতি জমাতে পারে। মাকে সংসারের কাজ নিয়ে যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে দেখেছি, সেই একই পরিশ্রম যেন আমার স্ত্রী না করে সেদিকেও আমি লক্ষ রাখি। সংসার ও সন্তান- দুটোই আমরা দুইজন মিলেমিশে সামলাই।

সন্তান পালন মানে সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে শিশুর খোঁজ নেওয়া নয়, বরং প্রতি মুহূর্তে জানা শিশু কেমন আছে, কী করছে। পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া, কোয়ালিটি সময় কাটানো, শিশুর খাওয়া, গোসল করিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো শিশুর সঙ্গে সম্পর্কের ভীত মজবুত করে। ধরুন শিশু স্কুল থেকে ফিরেছে এক ঝাঁপি গল্প নিয়ে। তার সেই গল্প মন দিয়ে শোনাও খুব জরুরি। এতে শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়।

শিশুর স্কুলের টিফিন প্যাক করে দেওয়া, চুল বেঁধে দেওয়া ও সাথে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও এসব ছোট ছোট ঘটনা শিশুদের স্মৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। এগুলো বাবা-মায়ের প্রতি তাদের আস্থাশীল করে তোলে।

সন্তান পালনে বাবা-মা দুজনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শিশুকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করে, তেমনি তার সাহস, শক্তি ও বুদ্ধিমত্তাও বাড়ায়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠে সে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews