সরকার পতনের পর দেশে দেড় হাজারের বেশি ভাস্কর্য ও ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভাস্কর্য বিভাগের নামই বদলে দিয়েছে। ছবি: প্রতীকী, এআই
সরকার পতনের পর দেশে দেড় হাজারের বেশি ভাস্কর্য ও ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভাস্কর্য বিভাগের নামই বদলে দিয়েছে। ছবি: প্রতীকী, এআই
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) তাদের ভাস্কর্য বিভাগের নাম পরিবর্তন করেছে—খবরটি এরই মধ্যে চাপা পড়ে গেছে। বিজয় সরণির যেখানটাকে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ নাম দেওয়া হয়েছিল, সেখানকার ভাস্কর্য-ম্যুরাল ভেঙেচুরে দিয়ে গণমিনার নির্মাণের খবরটিও চাপা পড়ে যাবে। সংবাদমাধ্যম অবশ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের নাম বদলের মতো গণমিনার নির্মাণের খবরটিকে উপেক্ষা করেনি। তবে কোথায় এ মিনারটি করা হচ্ছে এই তথ্যটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও নিশ্চুপ। এর পেছনে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ উপাধি পাওয়ার ভয়ও রয়েছে হয়তো।
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে স্থাপন করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়। তারপরও সেখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর কিছু ম্যুরাল অবশিষ্ট ছিল। অবশেষে সেগুলোও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইতিহাসের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর বলছে, সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে গণমিনার নির্মাণ করা হবে। জুলাই শহীদদের স্মরণে গণমিনার তো হতেই পারে। হওয়া উচিত। তবে যেখানটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও বাংলাদেশের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর কিছু ম্যুরাল ছিল, সেখানেই করতে হবে কেন?
গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর অজস্র ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেবেছিলাম, এটা তাৎক্ষণিক ক্ষোভের প্রকাশ। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে যত্রযত্র বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বঙ্গবন্ধুর এমন উৎকট ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল, নিচে ক্যাপশন লিখে না দিলে বোঝার উপায় ছিল না এটি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি, যেটি দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে জানা যায় বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা, তার বাবা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাদের পরিবারের সদস্যদের এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের নামে ৯৭৭টি অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে সেনানিবাস, বিমানঘাঁটি, নৌ-বাহিনীর জাহাজ, মেগাসেতু, সড়ক, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে নামকরণের এই মহোৎসব ছিল বাড়াবাড়ি।
অন্তর্বর্তী সরকার এই ৯৭৭টি নামের অধিকাংশই বদলে দিয়েছে। অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তনের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে তার মেয়ে শেখ হাসিনা যেমন শুধুই ‘নিজের বাপে’ এবং দেশটাকে তার ‘বাপের সম্পত্তি’তে পরিণত করেছিলেন, এখন নাম বদলের ক্ষেত্রেও মনে করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান শুধুই শেখ হাসিনার বাপ। ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সবার অদ্ভুত নিশ্চুপতার মধ্যেও সেই ভাবনার প্রতিফলন রয়েছে।
বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙার রাজনীতি বহু পুরোনো। শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙাও নতুন কিছু নয়। ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল ২০১৭ সালেও। ভাস্কর্য ভাঙার ইতিহাস যতটা পুরোনো তার চেয়ে পুরোনো ভাস্কর্য নির্মাণের ইতিহাস। দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরের টেরাকোটা এই দেশের প্রাচীন ভাস্কর্য নির্মাণের প্রাচীনতার সাক্ষী। এই দেশের মাটির নিচে এখনও পাওয়া যায় প্রাচীন সব মূর্তি।
ভাঙা-গড়ার মধ্যেই ছিল এতকাল এই সব কাণ্ড। জুলাই গণঅভ্যুথানের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের চিহ্ন মুছে দেওয়ার নামে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙার মধ্য দিয়ে ওই কাজটাই আরও সহজ হয়ে গেল। শুধু যে শেখ মুজিবের ভাস্কর্যই ভাঙা হয়েছে, তা নয়। মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক স্মৃতিগুলোও।
৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর করা হয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। হাতুড়ির আঘাতে ভাঙা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের মূর্তি ও শিশু একাডেমির দুরন্ত ভাস্কর্যটিও। এই সময়কালে ভাঙা হলো বীরশ্রেষ্ঠদের ম্যুরাল। মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে ছোট-বড় ৬০০টি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো।
আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির শহর কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম প্রস্তাবক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ম্যুরাল ভাঙচুর হয়েছে। এটি নির্মিত হয়েছিল কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে। এখানে বিষয়টি ব্যক্তি বিদ্বেষ নয়—ভাস্কর্য বিরোধিতা। রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ চিন্তাবিদ, ভাষা ও শিক্ষা আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক। তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তা আজ ইউনেসকোর ঘোষণা ও গৌরবময় ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তার ম্যুরাল ভাঙা মানে ইতিহাসের গায়ে হাত দেওয়া। ম্যুরালের পাশে একটি শহীদ মিনারেও ভাঙচুর করা হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনার। ঢাকায় পাকিস্তানি শাসনামলে চরম প্রতিকূল সময়ে প্রথম যে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটি ভাঙার পর আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছিলেন, “স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/ চারকোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য/ পারেনি ভাঙতে।”
এখন কোন রাজানুকূল্যে ভাঙা হচ্ছে শহীদ মিনার, বাঙালির ভাষা আন্দোলনের দিবসটিকে, যিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান এনে দিয়েছিলেন, সেই রফিকুল ইসলামের ম্যুরাল? এই নৃশংস কাজটি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর সরাসরি আঘাত; এর তাৎপর্য বহুমাত্রিক—এটি একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রচিন্তার বিরুদ্ধে বার্তা দেয়।
এই ঘটনার রেশ ধরেই ফিরে তাকাতে হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তের দিকে। সেখানে চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘ত্রিমাত্রিক শিল্প ও নকশা’ বিভাগ। নামটা আমাদের মতো মানুষের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার কথা, তবে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি পাঠ্যক্রম আধুনিকায়নের অংশ। নাম পরিবর্তনের কারণ হিসেবে শিক্ষকরা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তা অর্ধসত্য বলে প্রতীয়মাণ হয়। তারা আসলে ভয় পেয়েছেন। শুনেছি শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ আকস্মিক এই নাম পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ, কেউ কেউ নাকি খুশিও হয়েছেন। হতে পারেন, এই দেশে কে আর ভাস্কর হতে চাইবেন? কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি কেবল শিক্ষাগত বিবর্তন, নাকি ক্রমবর্ধমান মৌলবাদী চাপের কাছে আত্মসমর্পণ?
ভাস্কর্য বিভাগ মানে শুধু মূর্তি বানানো নয়—এটি একটি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রতিবাদ, স্মরণ ও সৃজনশীলতার জগৎ তৈরি করে। অথচ বাংলাদেশে ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি এখন কেবল শিল্প নয়, এটি একটি আদর্শের প্রতীক।
বহু বছর ধরে এই শব্দ ও শিল্পমাধ্যমটির বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো প্রচার চালিয়ে আসছে—ভাস্কর্যকে তারা ‘মূর্তিপূজার’ প্রতিভূ হিসেবে তুলে ধরেছে। এমনকি বিভিন্ন সময় বেফাঁস ও বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে রাজনীতিবিদরাও এই অপপ্রচারে ইন্ধন জুগিয়েছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে তাই নিরীহ একাডেমিক উদ্যোগ বলা যায় না। ‘ভাস্কর্য’ শব্দটিকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে ‘ত্রিমাত্রিক শিল্প’ বা ‘নকশা’ শব্দের ব্যবহার এক ধরনের নিরাপদ শব্দরাজি গঠনের চেষ্টা। উদ্দেশ্য হয়তো বিভাগটিকে ধর্মান্ধদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা—কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কী মূল্য দিয়ে তার অস্তিত্ব রক্ষা করছে?
কেউ বলতেই পারেন, নামে কিবা আসে যায়। কিন্তু যারা প্রতীক ও বর্ণমালার রাজনীতি বোঝেন, তারা জানেন—নাম বদল কখনোই নিরপেক্ষ নয়। নাম বেছে নেওয়া মানে একটি অবস্থান গ্রহণ। ভাস্কর্য শব্দ মুছে দেওয়া মানে ওই অবস্থান থেকে সরে আসা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, এই ধরনের আক্রমণ বা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। অধিকাংশ সময় প্রশাসন চুপ, সংস্কৃতি অঙ্গনের অংশগ্রহণ ক্ষীণ, নাগরিক প্রতিবাদ নেই। প্রশ্ন হলো, এই সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে শেষ হবে? কাল যদি ‘ত্রিমাত্রিক শিল্প’ শব্দেও আপত্তি ওঠে?